বড় পরিচালকদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই যার সিনেমা দেখার ভাগ্য হয়েছিল তার নাম সত্যজিৎ রায়। বিভিন্ন সীমান্ত শহরে থাকার সুবাদে আমাদের শাদাকালো টিভিতে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো ডিডি ওয়ান, ডিডি সেভেন দেখা যেতো। মনে পড়ে স্কুল পড়ার সময় ডিডি সেভেনে সত্যজিৎ রায় রেট্রোস্পেকটিভ হয়েছিল টিভিতে। সম্ভবত তার মৃত্যুর পর এটা হয়েছিল। একে একে তার সব সিনেমা দেখানো হয়েছি। দেখানো হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর তৈরি করা তার রবীন্দ্রনাথ ডকুমেন্টারি এবং তার সত্যজিতের ওপর করা শ্যাম বেনেগালের ডকুমেন্টারিটিও। সেবার অনেক সিনেমা দেখানো হলেও কীভাবে যেন পথের পাঁচালী মিস করে গিয়েছিলাম। সেই যে পথের পাঁচালী না দেখা শুরু হলো, এই না দেখা চললো গতকাল পর্যন্ত। স্কুল জীবনের পর, ঢাকা এসে ইনডিয়ান কালচারাল সেন্টারে দেখলাম আবার তার রেট্রো। ধানমন্ডির ২ নম্বর রোডের কালচারাল সেন্টারে। কত সাল? ১৯৯৯ বা ২০০০ হবে। সেবারও মিস করলাম।
সত্যজিতের প্রতি আমার আকৈশোর মুগ্ধতার অবসান ঘটলো এই দ্বিতীয় দর্শনে। টানা প্রায় ১৫টি মুভি দেখার পর মন অবসন্নতায় ভরে গেল। সত্যজিতের ব্যকরণ মানা, রেনেসাঁসের চৈতন্য আমাকে পীড়িত করতে থাকলো। পাটভাঙা মুভির নন্দনতত্ত্ব থেকে মনটা একটা সরে গেল।
তারপর প্রায় পাঁচ ছয় বছর আর সত্যজিৎ দেখিনি। অন্য অনেকের বহু দেশের, বহু ভাষার সিনেমা দেখেছি। বড় পরিচালকদের নাম জেনে মুভি দেখার চেষ্টা করেছি। মুভি দেখে নাম জানার চেষ্টা করেছি। অবশেষে, হঠাৎ করে টিভিতেই একদিন অপুর সংসার দেখলাম। একদিন চিড়িয়াখানার ডিভিডি এনে দেখলাম। একদিন দেবী, চারুলতা, শাখাপ্রশাখা, আগন্তুক এইভাবে এক এক করে দেখতে থাকলাম। জয়বাবা ফেলুনাথ, সোনার কেল্লা দেখলাম। সত্যজিৎ আসলে একজন নন। সত্যজিৎ বহু। একের ভেতরে অনেক। এই ব্যাপারটা ধীরে ধীরে টের পেতে থাকলাম। তার নিজস্ব ভাষা সেই ভাষায় প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর সমালোচনা, সেইভাষায় রাগ ও ক্ষোভের বহিপ্রকাশ। সেই ভাষার ডিটেইল নতুন করে দেখতে থাকলাম। ঘরে বাইরে যতবার দেখি, কিংবা অরণ্যের দিনরাত্রি মনে হয় একেবারে নতুন করে পড়তে পারা যাচ্ছে। কিংবা তার সবচেয়ে বিপ্লবী মুভি হিরক রাজার দেশে।
না সত্যজিতের সিনেমা একভাবে এক দর্শনে পড়ে ফেলার কোনো উপায় নাই। বহুতলীয় একেকটি মুভিকে বহুভাবেই দেখতে হবে। এই বোধ আমাকে এক ধরনের অপরাধ বোধের মধ্যে ফেলে দিল। সেই অপছন্দের অপরাধবোধ।
জীবনের একেকটা বাঁকে একেক গতিপথে সত্যজিতের মুভিকে একেক ভাবে পাঠ করা সম্ভব। একবার দেখে দেখছি বললে শেষ হয়ে যায় না।
পথের পাঁচালী আমি গতকাল পর্যন্ত দেখিনি। কেন? ঠিক যে কারণে পথের পাঁচালী পড়িনি। ঠিক যে কারণে গড অব স্মল থিংস হাতে তুলিনি। সবাই যখন অকুণ্ঠ প্রশংসা করে তখনই মনে হয় কোথাও নিশ্চয়ই একটা ফাঁক রয়ে গেছে। কোথাও একটা ঝামেলা আছে। অজনপ্রিয় বিষয় নিয়ে জনরুচিকে খুব বিপজ্জনক মনে হয়।
তাই পথের পাঁচালী দেখলেই চোখ সরিয়ে নিয়েছি।
কিন্তু এবার আর চোখ সরালাম না।
খুব মুগ্ধ হয়েছি? অবশ্যই। এক মহাকাব্যিক বেদনা বোধ টের পেলাম। কলকাতায় রায় পরিবারে বড় হওয়া একজনের পক্ষে এত বিস্তৃতভাবে অন্য আরেক শৈশবের এতো ডিটেইল ছবি তোলা কীভাবে সম্ভব হলো? সত্যজিৎ তাহলে কি নিজের জীবনে অন্যের জীবনও যাপন করতেন?
সত্যজিত রায়ের জন্মদিনে প্রথমবারের মতো পথের পাঁচালী দেখা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
আমার মায়ের চৌহদ্দি
আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন
ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু
খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!
নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?
শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন
জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি
পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি
বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন