somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কিত আমার অপরাধবোধ

২৯ শে এপ্রিল, ২০০৮ দুপুর ১:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাব
ছোট্ট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়ত মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাপড়ির জন্যে
এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্যে
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো।
(আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো :
হুমায়ুন আজাদ)
সাহিত্যের ইতিহাসে চোখ দিলে দেখা যাবে, প্রায় সব দেশে সব ভাষাতেই কিছু লেখক, কবি বা সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটেছে যারা নিজ সৃষ্টির পাশাপাশি ব্যতিক্রম জীবনযাপন বা ব্যক্তিগত চমকপ্রদ আচার-আচরণের কারণেও আলোচিত বা আকর্ষনীয় চরিত্র হয়ে ওঠেন। কখনো যেন ওই লেখক-চরিত্ররা পাঠকভেদে হয়ে ওঠেন কল্পলোকের চমকপ্রদ স্বপ্নমানুষ।
পাঠকরা ওইসব লেখকচরিত্র নিয়ে প্রায়ই ভাবতে বা কথা বলতে আমোদ বোধ করেন। ফলে, ইংরেজী সাহিত্যের লর্ড রায়রনের কথা মনে পড়লেই আমাদের চোখের সামনে ভাসে, এক সুদর্শন স্টাইলিস্ট কবির খোঁড়া পায়ে পিস্তল হাতে ছুটে চলার কথা। ফরাসী সাহিত্যের র‌্যাবো, বোদলেয়ার বা জ্যাঁ পল সার্ত্রের জীবনের কথা ভাবলে বাস্তব ভাবনা মুখোমুখি হয় অভাবনীয় চ্যালেঞ্জের। বাংলায় মাইকেল মধুসুদন দত্তকে মনে হয় কোনো উপন্যসে পড়া চমকপ্রদ নাটকীয় চরিত্র, যার না-দেখা চলাফেরাও যেন আমরা চলচ্চিত্র দেখার মতো করে চোখের সামনে দেখি; নম্র বাতাসে কান পেতে শুনি তিনি বলছেন ` রাজনারায়ন দত্তের ছেলে কাউকে গুনে পয়সা দেয় না।' কিংবা দেখি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঋষিসুলভ আচরণ, জীবনানন্দ দাশের শান্ত উদাসীন চাহুনী, কাজী নজরুল ইসলামের রোমান্সভরা বিদ্রোহী রূপ, শামসুর রাহমানের দেবদূতের মতো হাসি বা বিনয় মজুমদারের শিশুসুলভ নিশ্চিত পবিত্র উন্মাদনা।
হুমায়ুন আজাদ তেমন একজন লেখক-চরিত্র, যার লেখার পাশাপাশি ব্যক্তিগত আচার আচরণ বা কথনভঙ্গি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পাঠকদের কাছে তিনি, অলৌকিক স্টিমারের হুইসেল বাজানো কবি থেকে একে একে ভাষাবিজ্ঞানী, সাহিত্য সমালোচক, গদ্যকার, ঔপন্যাসিক যেমন হয়েছিলেন, তেমনি হয়েছিলেন নতুন ভাবনার ধারালো কথকও।
বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তাকে দেখা গেছে শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি থেকে শুরু করে বিচিত্র বিষয়ে দ্বিধাহীনভাবে মন্তব্য করতে, সমালোচনা করতে। পাঠকদের কাছে তার সাক্ষাৎকার ছিল যেন ঢেকে রাখা সত্য উদ্ধারের ভাষণের মতো চমকপ্রদ এবং জনপ্রিয়। ফলে অসংখ্য মিত্রের পাশাপাশি তার শত্রুও তৈরি হয়েছিল অনেক; সালমান রুশদি বা নাগীব মাহফুজের মতো মৌলবাদিদের কাছ থেকে হুমকির পর হুমকি পেতে হয়েছিল তাকে বহুবার। এবং শেষপর্যন্ত তো দুর্বৃত্তের নৃশংস আঘাতেই প্রিয় ছোট ঘাসফুল, শিশিরবিন্দু বা এক বৃষ্টির রঙ-রস ফেলে হারিয়ে গেলেন অকালে মৃত্যুর জগতে।

২.
পাবলো নেরুদার একটা বিখ্যাত উক্তি আছে `তোমরা ফুলটাকে কেটে ফেলতে পারো, কিন্তু ফুলের গন্ধটাকে নিবৃত করতে পার না'। ২০০৪ সালে হুমায়ুন আজাদের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলা, হুমায়ুন আজাদের সৃষ্ট সাহিত্যকে ম্লান করতে পারেনি। তিনি বরং আমাদের মধ্যে আরও শক্তিমান, ধীমান কিংবা প্রশ্নময় হয়ে উঠেছেন। এই হমায়ুন আজাদকে চাইলেই মুছে ফেলা সম্ভব না।
মনে পড়ছে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার ওপর হামলা করা হলে, তাকে যখন চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানো হয়; এর কয়েক মাস পর বাংলাবাজারে গিয়েছিলাম ব্যক্তিগত কিছু কাজে । প্রায় ৮/১০ বছর পর সেখানে দেখা হয়ে গিয়েছিল গতিধারার প্রকাশক সিকদার আবুল বাশারের সাথে। সম্পর্কে তিনি আমার দুসম্পর্কের চাচা। অনেক দিন পর দেখা হওয়ায় তিনি কিছুটা আবেগ-আপ্লুত হয়েছিলেন এবং তার প্রকাশনীর কয়েকটা বই উপহার দেন। সেখানেই হঠাৎ পরিচয় হয় কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরীর সাথে, তিনিও আমাকে তার একটি বই উপহার দেন। পরে, ওই বইগুলি নিয়ে ফেরার সময় যখন বাসে উঠলাম দেখলাম সেখানে বিভিন্ন সিটে ছড়ানো অবস্থায় বসে আছে কয়েকজন লোক। তাদের মধ্য থেকেই একজন হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,`ওইগুলো কি শয়তানের বই'। বলেই লোকটা হাসছিল, তার সাথে আরও দু'তিনজনকেও দেখা গেছে হাসতে। এখানে শয়তানের বই বলতে ইঙ্গিতটা ছিলো হুমায়ুন আজাদের বই কিনা এই বিষয়ের দিকে। আমি কিছুটা অস্বস্তি আর ভয় নিয়ে অপর এক সিটে বসলাম। তাদের মধ্যে একজন বইগুলি নিয়ে দেখলো, নিশ্চিত হলো ওইগুলো হুমায়ুন আজাদের বই নয়। আমি ওই মুহূর্তে ওই লোকগুলোর পৈচাশিক আচরনের প্রতিবাদ করতে গিয়েও শেষপর্যন্ত প্রতিবাদ করতে পারিনি। এই নিয়ে এখনো আমার মধ্যে মাঝেমধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে, কেন সেদিন আমি চুপ ছিলাম।
যদিও জানি হুমায়ুন আজাদ নামটাই আজ মৌলবাদ বিরোধী প্রতিবাদ। হুমায়ুন আজাদের ক্ষেত্রে হয়ত তার নিজের কবিতাই সত্য `আমি ভুল সময়ে জন্মেছিলাম/ আমার বৃক্ষ কখনো অঙ্কুরিত হয়নি।/আমি ভুল নদীতে স্রোত হয়ে বয়েছিলাম।/আমার নদী তখনো উৎপন্ন হয়নি।/আমি ভুল মেঘে ভেসে বেরিয়েছিলাম।/আমার মেঘ তখনো আকাশে জমে নি।/ আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।'/(আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে)। ২৮ এপ্রিল ছিল হুমায়ুন আজাদের জন্মদিন, এক তরুণ কবির পক্ষ থেকে তাকে স্যালুট।
১৭টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজকের ব্লগার ভাবনা: ব্লগাররা বিষয়টি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪১


ছবি- আমার তুলা।
বেলা ১২ টার দিকে ঘর থেক বের হলাম। রাস্তায় খুব বেশি যে জ্যাম তা নয়। যে রোডে ড্রাইভ করছিলাম সেটি অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাপ, ইদুর ও প্রণোদনার গল্প

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৪

বৃটিশ আমলের ঘটনা। দিল্লীতে একবার ব্যাপকভাবে গোখরা সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। বৃটিশরা বিষধর এই সাপকে খুব ভয় পেতো। তখনকার দিনে চিকিৎসা ছিলনা। কামড়ালেই নির্ঘাৎ মৃত্যূ। বৃটিশ সরকার এই বিষধর সাপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২১


(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×