somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চারিদিকে শুধু ভাঙ্গনের শব্দ শুনি..../ইমন।

১০ ই এপ্রিল, ২০০৮ ভোর ৬:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দেখতে দেখতে আমার লন্ডনে আসার বয়স হল সাড়ে পাঁচ। বিগত পাঁচটি বছরে পেয়েছি কিছু আবার হারিয়ে ফেলেছি অনেক কিছুই। সেটার হিসেবে আপাতত যেতে চাচ্ছিনা। শুধুমাত্র একটি ভুলের কারণে, ছোট্ট একটি ভুলের কারণে আমাকে এখনো এই লন্ডনে বসে বিনিদ্র রাত কাটাতে হচ্ছে। যদি সেই ভুলটি না হত তবে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে কবেই দেশে চলে যেতাম। সেটা আর হলো না। তাই এখনো স্বপ্নের এই শহরে আমি স্বপ্নহীন হয়ে পড়ে আছি। তারপরও আশাহত হওয়ার মানুষ আমি নই।

কিছুক্ষণ আগে আমার পিচ্চি বোনটার সাথে কথা বললাম। সে এবার এস.এস.সি দিচ্ছে। বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় একটু খারাপ হওয়ায় কান্নাকাটি করছিল। অনেক স্বান্তনা দিলাম। মনে পড়ে, ২০০৫ এর জুনে আমি যখন 'আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকে' ইন্টার্নশীপ করতে দেশে গিয়েছিলাম তখন তাকে প্রতিশ্রুতি করেছিলাম ওর পরীক্ষার সময়ে আমি দেশে থাকব। আরো বলেছিলাম সে 'গোল্ডেন এ' পেলে আমি তাকে 'ঢাকা টু লন্ডনে'র একটা ট্যুরের টিকেট উপহার দিব। আমার দেশে যাওয়া হয় নি। ওর পরীক্ষার আগে এখানে একটা পোষ্ট দেয়ার ইচ্ছে ছিল ( মূলত দোয়া চাইতে)। স্বার্থপর আমি সময়ের অভাবে সেটাও করতে পারি নি।

একটিমাত্র বোন আমার। সবার ছোট। পিচ্চিটার মেডিক্যালে পড়ার স্বপ্ন। তাই সে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হবে। কিন্তু সেখানে নাকি 'গোল্ডেন এ' না পেলে ভর্তি পরীক্ষাও দেয়া যাবে না (কতটুকু সত্য জানি না)। সেটা শুনে মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেল। সে সবটাতেই এ প্লাস পাবে এমনটাই আশা করছে স্কুলের শিক্ষকরা। আমার বোনকে নিয়ে আমি অনেক স্বপ্ন দেখি। ভবিষ্যতে আমি যদি কিছু হতে নাও পারি তাতে আমার কোন দুঃখ থাকবে না কিন্তু পিচ্চিটার কোন স্বপ্নভঙ্গ হোক সেটা আমি কল্পনাও করতে পারি না। আমি স্বার্থপর, কুলাঙ্গার ভাই হতে পারি, কিন্তু আমার বোনটা অনেক অনেক ভাল। এই বয়সেই সে আমার জন্য যে কত চিন্তা করে তার কোন হিসেব নেই। বাসায় ফোন করলে দৌড়ে এসে সবার প্রথমে সে ই কথা বলে।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে গতবছর আমার বাবা ব্যবসায় ত্রিশ লাখ টাকার মত লস দিয়েছেন। সারাজীবন যে বাবাকে অনেক সাহসী হিসেবে জানতাম সে বাবা এখন অনেক ভেঙ্গে পড়েছেন। আপনারা হয়ত ভাবছেন আমার বাবা রাজনীতি করতেন? না, বাবা রাজনীতি করেন না এমনকি ভোটটি পর্যন্ত দিতে যান না। আসলে রাজনীতি করার সময়ই তো বাবার ছিলই না। তার যখন দুবছর বয়স তখন আমার দাদা মারা গিয়েছেন। দাদীর ভিটেমাটি ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না। তাই ছয়বছর বয়স থেকে বাবাকে কাজ করতে হয়েছিল মানুষের দোকানে দোকানে। পড়ালেখা খুব বেশী করতে পারেন নি। অনেকটা কাজী নজরুল ইসলামের মত দোকানে কাজ করে অল্প পড়ালেখা করতে পেরেছিলেন। তারপর নিজে মুদির দোকান দিয়েছেন। পরে আস্তে আস্তে ব্যবসা বিস্তৃত করলেন। সারাটি জীবন অর্থের পেছনে ছুটেছেন শুধু। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ব্যস্ততা। যার কারণে বাবা আমাদের খুব একটা সময় দিতে পারেন নি। তাতে কি? বাসায় তো আমাদের কখনো অভাব অনটন দেখতে হয়নি। এই এখন বাংলাদেশে যে দূর্ভিক্ষ চলছে তাতেও আমাদের বাসায় কোন অভাব নেই। বাবার সাথে আমি খুব বেশী কথা বলতাম না। কিন্তু, কেন জানি এখন তার সাথে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে। তার সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যত পরিকল্পনা করতে পারার ক্ষমতা আমাকে সবসময় মুগ্ধ করে। ইদানীং আমি ফোনে কথা বললে আমাকে শুধু বলেন দেশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। তারপরও হা-পিত্যেস করেন না। হতে পারে আমি টেনশন করব বলে আমাকে বেশী কিছু বলেন না।

দেশের খবর নিতে এখন ইচ্ছে করে না। শুধু কান্না পায়। আমি খুবই দুর্বল মনের মানুষ। পত্রিকাতে যখন মানুষের হাহাকারের জীবনকথন পড়ি আমি চোখ না মুছে পারি না। যখন ছবিতে দেখি নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলো হাত পাতছে কোন মার্সিডিজ কিংবা কালো গ্লাসের বি.এম.ডব্লিউ'তে তখন হু হু করে কেঁদে উঠে আমার ভেতরটা। তাই এখন আর পত্রিকা পড়ি না। দেশের বন্ধুদের যখন বলি 'আমার এখানে ভালো লাগে না, আমি দেশে চলে যাব, দেশেই সেটলড হব'। তারা হাসিতে উড়িয়ে দেয়। অনেকে মনে করে আমি ঠাট্টা করছি। এইতো সেদিন বন্ধু টিটোর সাথে কথা হচ্ছিল। কম করে হলেও দশবার বলেছে 'দোস্ত, দেশে আসিস না, এখানের অবস্থা খুবই খারাপ'। গতকাল সিহাব চৌধুরীর সাথে কথা বলছিলাম, সেও একই কথা বলে। তাহলে কি আমরা সুদানের (যে দেশটিকে সবচে গরীব হিসেবে এতদিন জেনেছি) থেকেও গরীব হয়ে গেছি? চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের কথা বাবার কাছে শুনেছি কিন্তু দেখতে হয় নি। এখন কি আমরা নিজেদের চোখে আরেকটা দুর্ভিক্ষ দেখব? কে জানে কোন একদিন হয়ত আমার ছেলেমেয়েদের বলতে হতে পারে 'বাছারা আমাদের দেশে দুবার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, একবারের কথা আমরা শুনেছি আরেকবার স্বচক্ষে দেখেছি'।

আমার কিছুই ভালো লাগে না। চারিদিকে শুধু ভাঙ্গনের খেলা দেখছি। এখানের বন্ধুদের বলতে গেলে তারা বলে দেশকে নিয়ে এত চিন্তা করে কি করব? কিন্তু আমি যে সারাদিনের ক্লান্তি নিয়েও ঘুমুতে পারি না। কেউ কি আমাকে একটু স্বস্তি এনে দিতে পারে? অন্তত একটা ভাল খবর যেটা শুনে আমি ঘুমুতে যাব। অন্তত একটি সকালে বাংলাদেশর সীমানায় সূর্য্য উঠবে, অন্তত একটি দিন বাংলাদেশের সাফল্যের কথায় আমার চোখে আনন্দের অশ্র ঝরাবে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০০৮ বিকাল ৪:৩৩
২৭টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×