somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সন্ধ্যা

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০০৮ দুপুর ২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ২ নভেম্বর ১৯৩৫, ময়মনসিংহে। তার পৈত্রিক বাড়ি বিক্রমপুরে। ১০ বছর পর্যšত্ম সেখানেই ছিলেন তিনি। তার প্রথম বই বেরোয় ১৯৬৭ সালে। নাম ঘুণপোকা। মানবজমিন, দূরবীণ, পার্থিব, যাও পাখি, পারাপারÑঅনেক বিখ্যাত বইয়ের লেখক তিনি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ২৭ মার্চ বাংলাদেশে আসেন। ২৯ মার্চ পরিবাগের সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে শিল্পকর্মী ও ভক্তদের সঙ্গে এক সান্ধ্য আয়োজনে মিলিত হন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।

ফুরফুরে বাতাস বইছে। চারপাশে কয়েকটি নারকেলগাছ, আমগাছ, একটি নিমগাছ। নিমগাছে ঝাকড়া ফুল। ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়াতে নিম ফুলের হালকা সুবাস নাকে এসে লাগল। ফাকা ছাদ। অবশ্য সে হিসেবে ফাকা বলা যায় না, কারণ পুরো ছাদ জুড়ে অসংখ্য চেয়ার পাতা। একেবারে সামনের দিকে একটা ব্যানার ঝোলানো। তাতে লেখা ‘শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়-এর সঙ্গে একটি সন্ধ্যা’। এবার বোধহয় আর সব খোলাসা করে বলার দরকার নেই। ওপার বাংলার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এখন বাংলাদেশে। পরিবাগের সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের ছাদের আজকের এই ছোট্ট সান্ধ্য আয়োজন তাকে উপল—গ করেই। ইতিমধ্যেই কয়েকজন চলে এসেছেন। তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে। অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে অর্ধেক চেয়ারও ভরবে না। হুট করে কিছু পায়ের শব্দ। কাফেলার মতো করে দুপাশের চেয়ারের মাঝখান দিয়ে লোকজন আসছে। শুর¤œ থেকে দ্বিতীয়জনের ওপর চোখ পড়তেই ভেতরে ভেতরে আপনিই একটা শ্রদ্ধার ভাব চলে এল। কেউ না বলে দিলেও বোঝা গেল ইনিই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। মাঝারি গড়নের সৌম্য, শান্তু চেহারার মানুষ। দেখলেই কেমন একটা সমীহ ভাব জাগে। লেখক আসন গ্রহণ করতেই দেখলাম ক্রমে ক্রমে ছাদটা ভরে যাচ্ছে। আজব ব্যাপার! এই মানুষগুলো এত—গণ ছিল কোথায়? অনুষ্ঠানের সঞ্চালকের দায়িত্ব নিলেন ইমদাদুল হক মিলন। শুর¤œতেই তিনি বলে নিলেন, এটা আসলে সেরকম অর্থে কোনো অনুষ্ঠান না, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একধরণের খোলামেলা আলোচনা। আমরা লেখকের কথা শুনব, ফাকে ফাকে গান আবৃত্তি হবে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছেলেবেলা কেটেছে ময়মনসিংহে। সেই ছেলেবেলার স্মৃতি দিয়েই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে কথা শুর¤œর অনুরোধ জানান ইমদাদুল হক মিলন। ‘তখন ময়মনসিংহ ছিল পুরোপুরি গ্রাম, এখনকার মতো এত রা¯ত্মাঘাটের কথা তো কল্পনাই করা যায় না। বাড়ির কাছেই ছিল নদী।’ এভাবেই ছেলেবেলার স্মৃতিতে ঢুকে যান শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বলেন সারাদিন কীভাবে গাছে-বাঁদাড়ে মেতে থাকতেন, নদীতে সাঁতার কাটতেন। গর¤œর মতোই নাকি খিদা ছিল তখন, সারা—গণই ফল-পাকুড়, এটা-সেটা খাচ্ছেন কিন্তু পেট আর ভরে না। চারপাশের সবুজ প্রকৃতি, তাদের সেই বাড়ির সুন্দর ছবিটি এখনো তার মনে গেঁথে আছে। তার লেখায় বারবার উঠে আসে সেই ছবি। ‘একরাতে ঘুম থেকে তোলা হলো, স্মৃতিটা আবছা আবছা মনে পড়ে, আমরা ট্রেনে চড়লাম।’ দেশভাগের সময় এভাবেই একরাতে তাদের চিরতরে ময়মনসিংহ ছেড়ে চলে যাওয়া। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সূচনা বক্তব্যের পর একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত, তারপর শুর¤œ হয় উন্মুক্ত প্রশ্নপর্ব। বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করলেন শীর্ষেন্দু ভক্তরা। শীর্ষেন্দু নামটা কে রাখলেন থেকে শুর¤œ করে, তার লেখক হওয়ার গল্প, তার লেখায় কোকিলের ডাক, ঠাকুর অনুকুলচন্দ্রের কথা, নতুন লেখকের জন্য পরামর্শÑ কী আসেনি প্রশ্ন হিসেবে। বাউল গান, আবৃত্তি আর কথার ফাকে ফাকে চলতে থাকে এই প্রশ্নোত্তর পর্ব। আমরাও একটু একটু করে শুনি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথা, তার শীর্ষেন্দু হয়ে ওঠার কথা। শীর্ষেন্দু নামটি রেখেছিলেন তার বাবা। তার ডাকনাম র¤œনু। লেখক হওয়ার কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, সে বড় সুখের সময় নয়। বড় কষ্ট, ভীষণ কষ্ট। প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে নিজের সংগ্রাম। তারপরও এগিয়ে যাওয়া। আমার একটা গল্পের কথা বলি ‘স্বপ্নের ভিতর মৃত্যু’। পৌনে দুই বছর লেগেছিল গল্পটা শেষ করতে। গল্পটা বের¤œনোর পর অন্যদের কাছে হয়তো তেমন কিছু মনে হয়নি কিন্তু গল্পটা লিখতে পেরে, শেষ করতে পেরে আমি যে আনন্দ পেয়েছিলাম তা বলে বোঝানোর নয়। লেখককে এভাবেই নিজের সাথে সংগ্রাম করে লিখে যেতে হয়। লেখা কি অভিজ্ঞতা না কল্পনা থেকে লেখেন? এর উত্তরে তিনি বলেন, পুরোটা বা¯ত্মব তো নয়, অভিজ্ঞতা থাকে। এর খানিকটা দেখেছি, ওর খানিকটা দেখেছি। এসব নিয়ে কাটাছেড়া করতে হয়, একে বলে লেখকের রান্নাঘর। মূলত কল্পনার জগৎ নিয়েই লেখালেখি। কোকিলের ডাকে দুপুরটা দেউলিয়া হয়ে গেলÑ তার লেখায় এভাবেই ঘুরেফিরে আসে কোকিল। বললেন, একদিনের একটি কোকিলের ডাক আজো মনে পড়ে, এমন ডাক আর কখনো শুনিনি। কোকিলের ডাক সত্যিই উতলা করে আমায়। ঢাকায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বুড়িগঙ্গা দেখতে গিয়েছিলেন। দুঃখ করে বললেন, চোখে জল এল। একেবারে মরে গেছে। এখনো হয়তো উদ্যোগ নিলে একে বাঁচানো সম্ভব। নদীর সাথে সভ্যতার সম্পর্ক। নদী সংস্কার না হলে সভ্যতা বাঁচে না। কলকাতায় গঙ্গাও দূষিত কিন্তু বুড়িগঙ্গার মতো এতটা না। একজন লেখক কোনো ঠাকুরের শিষ্য! বিষয়টা অদ্ভুত শোনালেও শীর্ষেন্দু ভক্তরা জানেন তিনি ঠাকুর অনুকুলচন্দ্রের ভক্ত। এ সম্বন্ধে লেখক বললেন, আমি তখন মৃত্যুর মুখোমুখি, জীবনের কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম না, সামনে আত্মহত্যা ছাড়া পথ নেই। সেই সময় ঠাকুরের সাথে সা—গাৎ, তিনি আমার পথ আটকালেন। তিনি জীবনবাদী মানুষ। আমার জীবনে ফিরে আসা তার কল্যাণে। জীবন আমরা ভুলভাবে জানি। জীবনে রস-রূপ-গন্ধ আছে। ঠাকুর আমায় বাঁচতে শিখিয়েছেন। তার কাছে জীবনের বর্ণমালা শিখেছি। প্রত্যেক লেখকের ওপরই বড় লেখকদের প্রভাব থাকে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ওপর কাদের প্রভাব? বললেন প্রথম যৌবনে তার লেখা ছিল দ¯ত্ময়ভস্কির অনুসরণ। কিন্তু দ্র¤œত সে প্রভাব থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন। এছাড়াও কাফকা ও টি. এস. এলিয়ট তার ভীষণ প্রিয়। বাংলা সহিত্যের লেখকদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র, বিভূতিভূষণ ও জীবনানন্দের প্রভাব তার ওপর রয়েছে। আরো অনেক লেখকের প্রভাব পরো—গ ভাবে রয়েছে, সেটা তিনি নিজেও বোঝেন না। লেখালেখিতে তিনি নিজের মতো করে দুনিয়াকে অনুবাদ করার চেষ্টা করেন। দেশ বিভাগকে আপনি কীভাবে দেখেন? এ প্রশ্নের ছোট্ট উত্তরে তিনি বলেন, রাজনীতি আছে, একে তো অস্বীকার করার উপায় নেই। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখালেখির পঞ্চাশ বছর হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে তার লেখায়ও ঘটেছে পালাবদল, অনেক বাঁক। ভাষার বদল তো রয়েছেই। এই যেমন বললেন তার ছেলেমেয়েরা যখন কথা বলে তখন অনেক শব্দই নাকি তার কাছে অচেনা ঠেকে, তাদের ভাষা অনেক বেশি কম্পিউটারবিষয়ক। তবে নিজেকে নতুন সময়ের সঙ্গে খাপখাওয়াতে পারছেন না, এমনও নয়Ñ হলে তো অনেক আগেই লেখা ছেড়ে দিতেন, বললেন তিনি। নতুন লেখকের প্রতি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কী পরামর্শ? প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। পৃথিবীতে সব গল্পই লেখা হয়ে গেছে, কিছুই বাকি নেই। কেবল পুরনোকেই নতুন করে উপস্থাপন করা। একজন যখন লেখালেখি করতে আসবে পৃথিবীর তাবৎ লেখক তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী। সকলের সঙ্গে তাকে পাঞ্জা লড়তে হবে। সম¯ত্ম লেখককে পতিত করতে হবে। তার ভাষা, শব্দ, বাক্য গঠন, স্টাইল সব অন্যরকম হতে হবে। লেখায় নতুন মাত্রা থাকতে হবে। আর নয়তো লেখা গতানুগতিক হয়ে যাবে। ঘড়ির কাটা যে কখন দশ ঘরে গিয়ে পৌঁছেছে, কারো খেয়ালই ছিল না। অনুষ্ঠান সঞ্চালক ইমদাদুল হক মিলন প্রায় হুমকিই দিলেন, আর একটি প্রশ্ন কেবল করা যাবে। অনুষ্ঠানের শেষে বাংলাদেশের সাহিত্য এবং বাংলাদেশ নিয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বললেন, এখানকার গদ্যে নিজস্ব স্টাইল এসেছে। গদ্যসাহিত্যের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। এখানকার কবিতাও আপ¯œুত করে। আর এটা সত্যি যে ওপার বাংলার চেয়ে এখানে আমার পাঠক বেশি। এখানকার মানুষের কাছে যে ভালোবাসা পেয়েছি, এতটা কখনো ওখানেও পাইনি।


৯টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দিশ হারা

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২

তোয়াত্তন আ`‌রে কেন লা‌গে?
গম লা‌গে না হম লা‌গে?
রাই‌ক্কো আ‌রে হোন ভা‌গে
ফেট ফু‌রে না রাগ জা‌গে?

তোয়া‌রে আত্তন গম লা‌গে
ছটফড়াই আর ডর জাগে
ছেত গরি হইলজা ফাড়ি
হইবানি হোন মর আগে।

হোন হতার হোন ইশারা
ন'বুঝি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। VF 3 Mini: মাত্র 60 মিনিটে 27 হাজার বুকিং!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:০৪



আমার ব্যাক্তিগত গাড়ি নেই কিন্তু কর্মসূত্রে বেঞ্জ , ক্যাডিলাক ইত্যাদি ব্যাবহার করার সুযোগ পেয়েছি । তাতেই আমার সুখ । আজ এই গাড়িটির ছবি দেখেই ভাল লাগলো তাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

খাদ্য পন্যের মান নিয়ন্ত্রন

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১২

মশলা প্রস্তুতকারী কিছু ভারতীয় সংস্থার মশলায় ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান পাওয়া গিয়েছে।সম্প্রতি এমনই তথ্য প্রকাশ্যে এনেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘সেন্টার ফর ফুড সেফটি’। সংস্থা জানিয়েছে, ভারতীয় বাজারে জনপ্রিয় বেশ কিছু সংস্থার মশলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ময়লাপোতার কমলালেবুর কেচ্ছা!! (রম্য)

লিখেছেন শেরজা তপন, ২১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৩


বাংলাদেশের বিশেষ এক বিভাগীয় শহরে ময়লাপোতা, গোবরচাকা, লবনচোরা, মাথাভাঙ্গা, সোনাডাঙ্গার মত চমৎকার সব নামের এলাকায় দারুণ সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস।
আমার এক বন্ধুর আদিনিবাস এমনই এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাময়িক পোস্ট: বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন

লিখেছেন করুণাধারা, ২১ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন! view this link

সামহোয়্যারইনব্লগ থেকে কয়েকজন ব্লগার আলাদা হয়ে শুরু করেছিলেন সচলায়তন বা সংক্ষেপে সচল ব্লগ। এটি বন্ধ হবার মূল কারণ উল্লেখ করা হয়েছে দুটি:

১)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×