somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘোরাঘুরি ব্লগ: উত্তর মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ/ সমুদ্র যেখানে মা (৭ম অংশ)

২০ শে মার্চ, ২০০৮ বিকাল ৫:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৮.
সারাদিন ম্যারিন স্পোর্টস করে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে যখন হোটেলে ফিরি, তখন সারা শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল, এক্ষুণি অন্ততঃ ঘন্টা দুইয়ের একটা বিশাল নাকডাকা ঘুম দেয়া জরুরী। কিন্তু উপায় নেই, সুকেশদারা দাওয়াত দিয়ে রেখেছে, হয়ত সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা/সাতটার দিকেই নিতে আসবে তপনদার গাড়ী। কাজেই গোসল করে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় এলিয়ে পড়াটা সম্ভব হলোনা, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে সুকেশদারা আসার আগ পর্যন্ত যে আধঘন্টা/একঘন্টা হাতে আছে সে সময়টা হোটেলের আশপাশটা ঘুরে দেখব। প্লুমেরিয়া হোটেলের উত্তর পাশেই একটা বিশাল বাগান, সম্ভবতঃ হোটেলেরই। সবুজ ঘাসে ছেয়ে আছে পুরো বাগানের উঠোন, আর উঠোন থেকে পশ্চিমে এগুলেই ঘন নারকেল/সুপারী গাছের সারি। বাগানে দুচারটা বার্বিকিউ ছাউনীও আছে। তাছাড়া, এখন পর্যন্ত আমরা হোটেল থেকে বের হয়ে সবসময় ডানে, মানে দক্ষিণ দিকেই গিয়েছি। উত্তরে যাওয়া হয়নি। কারণও আছে, উত্তরে নিক্কো হোটেল আর মারিয়ানা রিজোর্ট হোটেল ছাড়া আর কিছুই নেই বলতে গেলে। কে যাবে? ভাবলাম উত্তর দিকটায় খানিকটা হেঁটে আসি।

সমস্যা যেটা হলো, সাইপানে তো আর আমার হাতে মোবাইল ফোন নেই। গ্লোবাল রোমিং ফোন এখনও নেইনি, শুনেছি বিদেশে গিয়ে খরচ করলে একেবারে ফতুর করে ছেড়ে দেয়। এখন মোবাইল না থাকায় তো বেরও হওয়া যাচ্ছেনা, কারণ কখন সুকেশদা আসবে, এসে যদি রূমে ফোন করে আমাদের না পায়? ভালো সমস্যা! অগত্যা সিদ্ধান্ত নিলাম আমিই ফোন করি সুকেশদাকে। বলে রাখি যে আমরা একটু হাঁটাহাঁটি করব, তো একটা টাইম ফিক্স করে সেসময়টাতেই যেন উনি আসেন। ফোন করতেই ওপাশে সুকেশদার গলা, খানিকটা বিমর্ষ, বললেন,
"মুকিত ভাই, আমিই আপনাকে ফোন করতাম।"
"আরে না সুকেশদা, ব্যাপারনা" বলেও শেষ করতে পারলামনা সুকেশদা বলতে লাগলেন,
"ভাইয়া আপনারা আছেন কয়দিন?"
আজকের প্রোগ্রাম নিয়ে কিছু একটা সমস্যা হলো মনে হয়, আঁচ করতে করতে বললাম, "আর দুইদিন আছি, কেন?"
"হইছে কি ভাইয়া, একটা ঝামেলা হইয়া গেছে। এক রেগুলার জাপানীজ কাস্টমার, হ্যায় ধরছে হ্যার লগে খাইতে হইব আজকে, বুঝলেননা? জাপানী কাস্টমার তো, ফালাইতে পারিনাই, জানেনই তো, এরাই টাকা উড়াইয়া দ্বীপটারে টিকাইয়া রাখছে।"

সুকেশদার কথা একশো'ভাগ সত্যি। জাপানী পর্যটকদের মতো এত খরচ আর কেউ করেনা, জাপানীদের মতো এত দলে দলে আর কেউ সাইপানে আসেওনা। সাইপানে আমার থাকা গোটা চারদিনের পর্যবেক্ষণে আমি দেখেছি, ইউরোপ থেকে যারা আষেন, বেশ ভালো সংখ্যকই আসেন, তারা সাধারণত হোটেল আর সৈকতে আয়েশ করে ছুটিটা কাটিয়ে দেন। এমনকি হোটেলের রেস্টুরেন্টেই সাধারনত খাবারদাবার সেরে ফেলেন, যেজন্য সৈকতে গেলে যে পরিমাণ ইউরোপিয়ান পর্যটক দেখা যায়, বাইরের রেস্টুরেন্ট, মানাগাহায় সে পরিমাণ দেখা যায়না। কোরিয়ানরা আসে দলবেঁধে ঘুরতে, আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হলো এরা খুব আহারপ্রিয় জাতি। খাওয়াদাওয়ার অংশটা এদের দখলে। চীনারাও প্রচুর ঘুরতে আসে, তবে প্রায় সবাই যে জিনিসটায় সবচেয়ে মজা পায় সেটা হলো টেনিয়ানের ক্যাসিনোতে। ওরা নাকি এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি টেনিয়ানে চলে যায়, একদম ক্যাসিনো হোটেলের রূমে উঠে তারপর বোচকা খোলে। সেহিসেবে জাপানীরা দুহাতে উড়ায়, ম্যারিন স্পোর্টস, খাওয়া দাওয়া এবং তারচেয়েও যেটা বেশী ওরা করে সেটা হলো ব্র্যান্ডের জিনিস কেনাকাটা। অবিশ্বাস্য রকমের খরচ করে। পাঁচ-দশ হাজার ডলারে একটা হ্যান্ডব্যাগ কেনা! ভাবাই যায়না।

তো যাই হোক, সুকেশদা যখন বললেন যে জাপানী কাস্টমারের জন্য আজকের দাওয়াতটা ক্যানসেল হলো, আমি ব্যাপারটা পুরোপুরিই বুঝলাম। সামান্যও মন খারাপ করিনি। বরং খানিকটা ভালো বোধ করলাম। কারণ আড্ডায় গিয়ে ঠিক কি করব এই নিয়ে খানিকটা দ্বিধা ছিল, মোনাইবা বঙ্গদার জাপানী বউয়ের সাথে কতটা কম্যুনিকেইট করতে পারবে -- এসব নিয়ে একটু চিন্তা যে ছিলনা সেটা অস্বীকার করা যাবেনা। কিন্তু সুকেশদার আন্তরিকতার অভাব ছিলনা, উনি বারবার বলতে চাইলেন যে তাহলে পরদিন অথবা শেষদিন রাতটা উনাদের জন্য রেখে দিতে। কিন্তু এদিকে আমাদের একটা নিজেদের এক্সক্লুসিভ হানিমুন ডিনারের প্ল্যান আছে, আর একরাত মোনা একটু ঘুরে ঘুরে দেখবে কি কি স্যুভেনির কেনা যায়। তাই সত্যি বলতে আমাদের সময়ও ছিলনা। সুকেশদাকে বুঝিয়ে বললাম, মেনে নিলেন।

কিন্তু সমস্যাটা হলো, উনাকে ম্যারিন স্পোর্টসের টাকাটা দেব কিভাবে? আমি জিজ্ঞেস করলাম,
"সুকেশদা, টাকা তো এখনও দেয়া হয়নাই। কিভাবে দেয়া যায়, বলেনতো?"
সুকেশদা বললো, "আপনে গারাপানের দিকে আসবেন? তাইলে তখন নিয়া আইসেন।"
আমার মাথায় তখন ইনস্ট্যান্ট যে প্ল্যানটা ঢুকে গেল সেটা হলো আজ তাহলে আমরা গারাপানের দিকে না গিয়ে উত্তরে নিক্কো হোটেল আর মারিয়ানা রিজোর্ট হোটেলে যাই, পরে কাল গারাপানে হার্ডরক ক্যাফেতে ডিনারে যাব। আমি বললাম,
"সুকেশদা, কালকে তো আমরা ডিনারে যাব, তখন আপনি গারাপানের সুবিধামত কোথাও আসলেই হবে।"
উনি বললেন, "দাদা কোথায় ডিনার করবেন ঠিক করছেন?"
আমি বললাম, "হার্ডরক ক্যাফে, ডিএফএস গ্যালেরিয়ার ভেতরে, দোতলায়।"
"আমি চিনি, আমি চিনি দাদা। ঠিক আছে আমি ওখানে সাড়ে সাতটার দিকে থাকুমনে, ঠিক আছে না?"
সাড়ে সাতটা ভালো সময়। আমি বললাম, "ওকে, তাহলে কাল সাড়ে সাতটায়।"
উনি বললেন, "আর দাদা আমি না আসতে পারলে তপনরে পাঠাইয়া দিমু।"
সব ঠিকঠাক হলো, তারপর সুকেশদা কিছুক্ষণ জাপানীদের সঙ্গদেয়া পার্টি নিয়ে গ্যাঁজালেন। লজ্জায় লজ্জায় বলতে চাইলেন যে এমনিতে লালপানি বা বীয়ার খাননা, তবে কাস্টমারকে সঙ্গ দিতে খেতে হয়, উপায় নাই। সুখদুঃখের কথা বলে ভালোমানুষ সুকেশদা ফোন রেখে দিলেন, কিন্তু বেশী কথা হবার কারণেই হোক, অথবা সুকেশদার ভুলোমনের কারণেই হোক, বেশ লজ্জাস্কর এই ফোনের কথাবার্তা পরবর্তীতে আমাকে একটা লজ্জাস্কর পরিস্থিতে ফেলেছিল।

বাঙালী খাবারের দাওয়াত ক্যান্সেল হয়ে যাওয়াতে এখন আমাদের মাথায় যেটা চেপে বসল, সেটা হলো যে আজ ভালো কিছু খেতেই হবে। মন প্রস্তুত খেয়েদেয়ে একটা তৃপ্তির ঢেকুর তোলার, বেড়াতে এসেছি বলে কথা, মনকে তো আর নিরাশ করতে পারিনা! বেড়াতে এসে মনভালো না হলে আর আসার মানে কি। এরকম অনেক কিছু বুঝিয়েই নিজেকে প্রলুব্ধ করলাম দুইঘন্টার টানা ঘুম থেকে বিরত রাখতে। স্ত্রী সম্পর্কে আমার যে ধারনাটা ছিলনা, সে নিজেও অল্পঘুরেই কাহিল হবার মানুষনা। দেখলাম সারাদিন এতসব ছুটোছুটির পরও সে ক্লান্ত না, এবং দাওয়াত বাতিল হবার পর তার মাঝেও টানা ঘুম দেয়ার কোনো লক্ষণ নেই। আমরা বেরিয়ে পড়লাম নিক্কোহোটেলের উদ্দেশ্যে।


৯.
প্লুমেরিয়া হোটেল থেকে নামলেই যে রাস্তাটা উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি বিস্তৃত, সেটাই সাইপান দ্বীপের মূল সড়ক। আগেও বলেছি হোটেল থেকে বের হয়ে এযাবৎ আমরা শুধু রাস্তার দক্ষিণ দিকেই গিয়েছি, দক্ষিণে খালি রাস্তায় মিনিট দশ গেলে গারাপান, আর দ্বীপের দক্ষিণপ্রান্তের সাইপান বিমানবন্দরে যেতে লাগবে হয়ত মিনিট বিশ-পঁচিশ। উত্তরে শুধু নিক্কো হোটেল আর মারিয়ানা রিজোর্ট হোটেল, এবং আমাদের হোটেলের কাউন্টারের ভদ্রমহিলার ভাষ্যমতে উত্তরের শেষ বসতি মারিয়ানা রিজোর্টে যেতে ডিএফএসগ্যালেরিয়া বাসে তিন মিনিটের বেশী লাগেনা। এতদিন আমরা ডিএফএসের বাসে চড়ে শুধু গারাপানই গেছি, এখন ধরতে হবে উল্টো বাসটা, মানে যেটাতে চড়ে আমরা এতদিন গারাপান থেকে হোটেলে আসতাম, সেটায় চড়ে হোটেল থেকে নিক্কোতে যাবো। কিন্তু ঝামেলা হলো সেখানেই! মিনিট পনের অপেক্ষা করার পর যখন বাস এলো, আমরা উঠতে গেলাম আর তখনই ড্রাইভার দুহাত উঁচিয়ে ক্রস চিহ্নের মতো ইঙ্গিত দেখাল, যার মানে হলো বাসে চড়া যাবেনা। প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে তার দিকে তাকাতেই সে বলল,
"ওনলি ডিএফএস গ্যালারিয়া।" দুহাতের ইশারার সাথে সাথে বলতে লাগল, "হোটেল গ্যালারিয়া, গ্যালারিয়া হোটেল, ওনলি"
বোঝা গেল লোকটা কি বলতে চায়; যেহেতু ডিএফএস গ্যালেরিয়ার স্পন্সরের বাস, সেহেতু শুধু ওখানে কেনাকাটা করতে বা ওখান থেকে কেনাকাটা শেষে ফিরতেই এই বাস ব্যবহার সম্ভব, অন্য কোন উদ্দেশ্যে না। অথচ প্রায় পুরো বাসই খালি! হায়রে পুঁজিবাদ!!

বাসের পাদানীতে আমার থমকে যাওয়া দেখে বাসড্রাইভার বলল, "ট্যাক্সি, ট্যাক্সি"। মানে পরিস্কার, "বেড়াতে এসেছ, খরচ করো।"
মনে মনে পুঁজিবাদ আর এর প্রবক্তাকে (ঠিক কে যে পুঁজিবাদের প্রবক্তা জানিনা, হয়ত প্রথম মানবই হবেন) বকাঝকা করতে করতে রাস্তায় এসে দাঁড়াই। কিন্উ এমন অজ অঞ্চলে ট্যাক্সির দেখা পাওয়া ভার। এখানে আছে শুধু তিনটে হোটেল, সব হোটেলেই বাস যায়। তাই ট্যাক্সির আনাগোনা নেই। তবে তাছাড়া আরেকটি কারণও আছে যেজন্য এদ্বীপের গারাপান অঞ্চল ছাড়া অন্যখানে ট্যাক্সি পাওয়া কষ্ট। কারণ হলো প্রাইভেট কার রেন্টের ব্যাবস্থা। সাইপানে যানজট জিনিসটা নেই, ছোট দ্বীপ, লোকজন যে যার বাসার কাছে ব্যবসার জন্য দোকানপাট খুলে বসেছে, লোকের যাতায়াত করতে হয় খুব কম। তাই বিদেশীরা এখানে এসেই প্রথমে যেটা করে সেটা হলো একটা গাড়ী ভাড়া করে নেয়। একদিন পঞ্চাশ ডলারে গাড়ী পাওয়া যায়, সারাদিন যত ইচ্ছে ঘোরা যায় হিসেবে বেশ চলনসই দাম। জীবনে বোধহয় এই প্রথম ড্রাইভিং না জানার বিষয়টা আমাকে ব্যাথিত করল, ভাবলাম, ড্রাইভিং জানলে কত মজা করা যেত। ছাদবিহীন স্পোর্টস কার নিয়ে এই উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত বিস্তীর্ণ খালি রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াতাম গাড়ী, একেবারে বাতাসে উড়িয়ে নেয়া যাকে বলে আর কি। সাইপান বেড়াতে গেলে অবশ্যই ড্রাইভিংটা জেনে তারপর যাবেন -- এ উপদেশটা আমি পাঠকদের দিতেই পারি, এবং একই সাথে বিনে পয়সায় আরো একপ্রস্থ পরামর্শ, দেশ থেকে ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে ভুলবেননা।

আপাততঃ স্পোর্টস কার উড়িয়ে নেয়ার ইচ্ছেটা চাপা বেরিয়ে পড়তে হলো। ট্যাক্সি পাওয়া যাহেতু সম্ভব না, তাই ঠি করলাম হেঁটেই চলে যাব। বাসে যদি তিন মিনিট লাগে, তাহলে হেঁটে তো আর কয়েকঘন্টা লাগবেনা! বড়জোর আধঘন্টা লাগবে। আর সাথে সাথে পথের দুপাশে পড়া সাইপানও দেখে যাওয়া যাবে। আমরা যখন হোটেল নিক্কোর অভিমুখে রওয়ানা দেই, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সাইপানের সন্ধ্যা সমুদ্রের তীরে না কাটালে সাইপানে কাটানোও যা, জাপানেও তা। নীরস রাস্তার ওপর সন্ধ্যা আর কতটুকুই রোমাঞ্চকর হতে পারে! কিন্তু পথে একটি দোকান খাবারের পড়ায় আমরা যখন ওটাতে ঢুকে গেলাম চিপস-টিপস সহ আরো কিছু কিনতে, এবং সস্তা পেয়ে অনেকটা সময় দোকানের ভেতরেই কাটিয়ে দিলাম, তখন দোকান থেকে বের হয়ে বুঝলাম সামথিং ইজ রং! হ্যাঁ, রাস্তায় লাইটের সংখ্যা খুবই কম, বেশ দূরে দূরে একটা করে সোডিয়াম বাতির পোস্ট, রাস্তার সোধিকাংশ জুড়েই অন্ধকার। তারওপর এরাস্তায় গাড়ীঘোড়া তেমন না থাকায় যে দুএকটা দেখা যায়, ওগুলো যেন বিদ্যুতের বেগে ছুটে যায়। ভীষন সাবধানে তো চলতে হবেই, তার সাথে সাথে বুঝতে পারলাম যে ভয়ে গা ছমছম করা শুরু করছে, কারণ এই জনমানবহীন রাস্তায় কেউ এসে যদি পেটে ছোরা ঠেকায়, তাহলে ওখানেই শেষ!

এসময়ই পথ হাঁটতে হাঁটতে সাইপানের সাধারন সিস্টেমগুলো পর্যবেক্ষণ করি। লম্বা রাস্তার একপাশে প্রতি দু'তিন কিলোমিটারে একটা করে খাবারের দোকান, অনেকটা ছোটখাট সুপারমার্কেটের মতো। দোকানগুলোতে চাল, তেল, থেকে শুরু করে মাছ, মাংস পর্যন্ত থাকে। আর প্রত্যেকটা দোকানেই ঢোকার পথে দেখা যায় বড় বড় করে লেখা, "উই টেইক ফুডস্ট্যাম্প"। ফুডস্ট্যাম্প কি? জিজ্ঞেস করে জানা গেল , লোকাল চামোরো অধিবাসীদের জন্য প্রচলিত বিনাপয়সায় বসে বসে খাবার ব্যবস্থা। প্রতিমাসে মাথাপিছু দেড়শ ডলার সমপরিমাণ ফুডস্ট্যাম্প দেয় আমেরিকান সরকার একেকজন চামোরোকে। তবে দেড়শ ডলার মোটেও যথেষ্ট নয় সাইপানে খাবার খরচ হিসেবে। তাও হয়ত পাঁচজনের সংসারে মোট সাড়ে সাতশ ডলার আসলে খারাপনা, মনে মনে হিসেব শুরু করি। মজার ব্যাপার হলো, সাইপানে বিলানো এই বিনে পয়সার ফুডস্ট্যাম্প নিয়ে খোদ আমেরিকান মেইনল্যান্ডে অসন্তোষ আছে বলে শুনেছি। এমনকি "সাইপান-সাকস" নামে একটা ওয়েবসাইটও নাকি আছে! জানুয়ারীতেও আমেরিকান রিসেশন এখনকার মতো এতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেনি, তখনই ফুডস্ট্যাম্প নিয়ে যে বিষোদগার দেখেছি ঐ "সাইপান-সাকস" ওয়েবসাইটে, না জানি এখন কি ধুন্দুমার কান্ড চলছে!

যেটা বলছিলাম, প্রতি একদুই কিলোমিটারে থাকা এই সুপারমার্কেটের পাশে অবধারিতভাবে থাকবে একটা দুটা রেস্টুরেন্ট আর লাল-নীল আলোঝলমলে নিয়নসাইনসমৃদ্ধ জুয়ার ঘর। নিয়নসাইনে লেখা থাকে "পোকার"। আর বিল্ডিংয়ের দোতলা থেকে শুরু করে চার-পাঁচতলা পর্যন্ত ছোটছোট এ্যাপর্টমেন্ট থাকে। একদুজনের পরিবার, বা কখনও কখনও একজন থাকার মতো এ্যাপার্টমেন্ট। এই এ্যাপর্টমেন্টগুলোতেই সাইপানের বিদেশীরা, অর্থাৎ ফিলিপিনো, চীনা, বাঙালী যারা কাজ করতে আসে তারা থাকে। বিদেশীরা দখল করে নিয়েছে শহরের আশপাশটা, যেখানে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বেশী চলে। আদিবাসী চামোরোরা পাহাড়ে ঘেরা গ্রামগুলোতে থাকে, অনেক বেশী জায়গা নিয়ে ছড়ানো ছিটানো বড় বড় ঘরে। এ এক চমৎকার মিথস্ক্রিয়া।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে এমনি এক সুপারমার্কেটের সামনে চলে আসলাম, তেষ্টা পেয়েছিল, পানীয় কেনার জন্য ভেতরে ঢুকি। বের হয়ে যখন রাস্তায় উঠলাম, দেখি সেই দোকান সংলগ্ন পোকার খেলার রূমের বাইরে একলোক দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে। খানিকটা ভয় তো পেলামই, তাও তোয়াক্কা নাকরেই হাঁটা দেই। খানিক পর মনে হলো লোকটাও পিছু পিছু আসছে, আমি ফিরে তাকাটে দেখি আসলেই বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে রাস্তার পাশেই এক গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি আমাদের দিকেই! এবার আমি সত্যি সত্যি ভয় পেলাম, বুঝে ফেললাম হোটেল নিক্কো দেখার চেয়ে নিজের নিরাপত্তা বেশী জরুরী। এখন সমস্যা হলো, ফিরতে হলে তো লোকটার সামনে দিয়েই যেতে হবে। কি আর করা, আমরা রাস্তা পেরোই, তারপর উল্টোদিকে প্লুমেরিয়া হোটেলের দিকে হাঁটা দেই। এসময়টা আর তাকিয়ে দেখারও চেষ্টা করিনি যে লোকটা আসলেই কি করছে। কোনভাবে দ্রুত হেঁটে সম্মুখে দৃশ্যমান গ্যাসোলিন স্ট্যান্ড পর্যন্ত আসি, তারপর নিক্কো হোটেল থেকে গ্যালেরিয়াগামী একটা বাসকে আসতে দেখে ঊর্ধ্বশাসে দৌড় শুরু করি হোটেলের দিকে। হোটেলে পোঁছে বাস মিস করি ঠিকই, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসেনা। নিজের মনের মধ্যে গড়ে তোলা ভীতির হাত থেকে রেহাই পেয়েছি --সেটাই অনেক। হয়ত লোকটা খারাপ কেউ নেই, হয়ত কিছুই করতনা, হয়ত আমাদের এই ভয় পাওয়া দেখে লোকটা ভেবেছে "শালার ট্যুরিস্ট, ভাব লয়!" -- আরো অনেক হয়ত যোগ হতে পারে এখানে। কিন্তু বিপদের সম্ভাবনা মনের মধ্যে তৈরী হয়ে গেলে, সেটাকে আর বাড়তে না দেয়াই ভাল, তাতে কারো অপমান হলেও করারা কিছু নেই। আমি শুধু ভাবি, আমিএ কজন সাদা ইউরোপিয়ান আর লোকটা একজন কালো আফ্রিকান হলে আমার আচরণকে বর্ণবাদী ল্যাবেল দেয়া হতো, কিন্তু ব্যাপারটা যতটানা বর্ণগত, তারচেয়ে অনেকবেশী ব্যক্তিগত।

হোটেলে ফিরে আমরা পরের বাসে গ্যালেরিয়াতে যাই, রাত আটটার বাস। সোজা একটা কোরিয়ান রেস্টুরেন্টে ঢুকি, খুবই মজার খাবার ওদের। জাপানীজ ডিশ চুজ করি, আমি গরুর জিহবার, গিন্নী চিকেন উইং। বেশ মজা করে কোরিয়ান কিমচি'র সালাদ, জাপানীজ মিসোশিরু(মিসো নামক একধরনের বীনস্যুপ) আর গ্রীলড বীফটাং দিয়ে উদরপূর্তি করে দাওয়াত বাতিল হবার কষ্ট ভুলি। যেটা বলা হয়নি, পরদিন সকাল সাড়েনয়টার জাহাজে আমাদের টিনিয়ান দ্বীপে যাবার কথা। তপনদা'র সাথে কথা হয়ে আছে, সকালে উনি এসে আমাদের পোর্টে নিয়ে যাবেন। বলেছেন, "আপনি খুশী হয়ে যা দেন তাতেই হবে" আমি পুরোপুরি বাংলাদেশী আন্তরিক সার্ভিসের গন্ধ পাই। মনে মনে ভাবি, জাপানে কি এটা সম্ভব? ট্যাক্সিড্রাইভার বলবে আপনি যাখুশী তাই দিয়েন! তপনদা আসবেন সকাল নয়টার, আজকের অভিজ্ঞতা বলে উনি সময়মতো আসবেন। রাতে যখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছি, তখন পর্যন্ত আমি জানিনা পরদিন সকালে আমাকে এতবড় লজ্জায় পড়তে হবে!!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০০৮ বিকাল ৫:১৬
২৯টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×