somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা দেশের নদ-নদী

১৬ ই মার্চ, ২০০৮ সন্ধ্যা ৭:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বহু অর্থেই কপিল ভট্টাচার্য রচিত বাংলা দেশের নদ-নদী ও পরিকল্পনা একটি যুগান্তকারী গ্রন্থ। প্রথমত, বাংলাদেশের নদী, এর বৈচিত্র্যপূর্ণ গঠন ও প্রবাহ নিয়ে বাংলাভাষায় এটাই প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ; দ্বিতীয়ত, যে প্রজ্ঞা ও বোধ থেকে লেখক এই গ্রন্থটি রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, তার অভাব আজও এ দেশের নদী-বিশেষজ্ঞ ও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পকদের মাঝে নিত্য দৃশ্যমান।

একজন নদী বিশেষজ্ঞ হিসেবে কপিল ভট্টাচার্য সর্বদা উপলব্ধি করেছেন নদী এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের প্রাণ। এর সুষ্ঠু প্রবাহ নিশ্চিত করেই কেবল এখানে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধি ও বিকাশ নিশ্চিত করা সম্ভব। সে কারণে ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত বইটির প্রথম সংস্করণেই তিনি ঘোষণা করেন, সরকারি পরিকল্পনার ভ্রান্তি ও ভাঁওতা সাধারণ জনগণকে বোঝানোই তাঁর এই গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য। তথাকথিত নদী উন্নয়নের নানা পরিকল্পনা যে জনগণের জন্য সমূহ বিপদই বয়ে নিয়ে আসছে, এবং সে বিষয়ে তাদের সচেতন প্রতিরোধ গড়ে তোলাই যে বাঁচার একমাত্র পথ; তা তিনি নিজে যেমন বিশ্বাস করতেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনের কাতারে হাজির থেকে সে বিশ্বাসের প্রমাণও তিনি দিয়েছেন।

ঔপনিবেশিক যুগের রেল ও সড়ক যোগাযোগের ‘প্রগতি’তে প্রশ্নহীন আনুগত্য নেই কপিল ভট্টাচার্যের। বরং ফ্রান্সসহ বহু ইউরোপীয় দেশের উদাহরণ দেখিয়ে তিনি জলপথের নাব্যতা সংরক্ষণের গুরুত্ব প্রদর্শন করেছেন। এমনকি নদীপথকে বিপর্যস্ত করা সড়ক ও রেলপথের প্রতিক্রিয়ায় দেশে জমির উর্বরতা বিনষ্টিসহ বিপুল জলাভূমির আবির্ভাবে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব এবং জনস্বাস্থের হানিও তাঁর চোখ এড়ায়নি।

এমনকি প্রত্যক্ষ উপনিবেশের উত্তর কালেও বিদেশী পরিকল্পনাকারী, যন্ত্রপাতি নির্মাতা এবং পুঁজি বিনোয়াগকারীদের কর্তত্বেও নদী শাসন পরিকল্পনা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বাঁধ নির্মাণ অব্যাহত থাকল, তার বিরুদ্ধেই আজীবন লড়েছেন কপিল ভট্টাচার্য। ফারাক্কা বাঁধসহ দামোদর বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প যে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে গ্রহণ করা হচ্ছে, তা স্পষ্ট করে ঘোষণা করতে কোনো দ্বিধা করেননি কপিল ভট্টাচার্য। শুধু পরিকল্পক ও নীতিনির্ধারকদের চিঠি দিয়েই তিনি তার দায়িত্ব সমাপ্ত করেননি, বরং নিয়মিত পত্রিকায় লিখে ও জনমত সংগঠিত করে যথাসাধ্য প্রতিরোধের চেষ্টাও করেছেন। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী গণ্ডীতে আবদ্ধ না থেকে নদী ব্যবস্থাপনার নীতি গ্রহণে যে ভারত ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সহযোগিতা ও পরস্পরের মিত্রতা জরুরি, তাও তিনি বারংবার উল্লেখ করেছেন। ফারাক্কা প্রশ্নে তাঁর এই আপোসহীন অবস্থানের কারণে সরকারি মহল তাকে যথারীতি উপেক্ষা ও হয়রানি করতেও কসুর করেনি।

কপিল ভট্টাচার্য বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীসুলভ পশ্চিম অনুকরণের ব্যাধি থেকেও মুক্ত ছিলেন। কোনো বিশেষ পরিকল্পনা আমেরিকায় সফল হলেও বাংলায় তার পুনরাবৃত্তি ভ্রান্ত হতে পারে, তা তিনি হাতে-কলমে দেখিয়েছেন। নদী পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কপিল বরং প্রতিটি নদীর পৃথক আচরণ, বাহিত পলির ধরন, তার অববাহিকার গঠন ইত্যাদি শর্তকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করাকে আবশ্যক মনে করেছেন। আরেকটি বিষয় তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। সেটি হলো বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে দরিদ্রতর জনগোষ্ঠীকে নিদারুণ অবহেলা ও উপেক্ষা করে সম্পদ ও প্রভাবে যারা বলশালী, তাদের প্রতি প্রকট শ্রেণী পক্ষপাত।

কপিল ভট্টাচার্য তাঁর নদী পরিকল্পনার রূপরেখায় পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান ও প্রতিবেশগত প্রশ্নে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুগের চিন্তার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে যেতে পারেননি। সুন্দরবন এলাকায় ভূমি ‘উঠিত’ করানো, বা ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের সুপারিশ সেই সীমাবদ্ধতারই বাস্তব দৃষ্টান্ত। সেক্ষেত্রে পাঠক উপলব্ধি করবেন, তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিও বহুজাতিক পুঁজি বা ভাড়াটে গবেষণা থেকে উৎসারিত নয়; বরং সমকালীন বৈজ্ঞানিক প্রবণতারই প্রতিফলন। অন্যদিকে, মূলধারার নদী পরিকল্পনা যেভাবে জীবিকা, জনস্বার্থ ও বিনোদন সকল দিক দিয়েই অধিকাংশের প্রতি প্রতিকূল হয়ে উঠছে ক্রমাগত, তা তিনি বহুবার দেখিয়েছেন। বিচিত্রতর উপায়ে জনগণের জীবিকার সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন তাঁর সকল পরিকল্পনার মূলভাব ছিল সর্বদাই।

নদী বিশেষজ্ঞের পরিচিতির বাইরেও কপিল ভট্টাচার্য ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। ১৯৭০-এর দশকে ভারত জুড়ে বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের সেই নৃশংস দিনগুলোতে, প্রতিদিন অজস্র গুমখুন, বিনাবিচারে গ্রেফতার আর বেয়োনেট ভরা সময়টিতে কপিল ভট্টাচার্য অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। আরেক প্রবীণ বুদ্ধিজীবী, দাদু নামে খ্যাত সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০২-৭৬)-এর নেতৃত্বে আরো ক’জন সমমনা মিলে গড়ে তোলেন গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর)। সেই ত্রাসভরা দিনগুলোতে কেউই যখন সমিতির সভাপতি হতে ভরসা পাচ্ছিলেন না, শেষপর্যন্ত কপিল ভট্টাচার্য-ই সভাপতি হলেন এবং তাঁর বাসভবনেই সমিতির অফিস করা হলো। রাজনৈতিক হত্যা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং রাজবন্দিদের আইনি সহায়তার ক্ষেত্রে সমিতি সেই সময় অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি আইনে শিগগিরই সমিতিকে বেআইনি করা হয়। তাকে বহুবার পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা হয়রানি করে। কিন্তু জীবনের শেষ আঠারো বছর এক মুহূর্তের জন্যও তিনি তার লড়াই থেকে পিছু হটেননি, এমনকি গুরুতর অসুস্থ হয়ে শেষবার নার্সিং হোমে ভর্তির আগ পর্যন্ত তিনি এপিডিআরের অফিসে কর্মরত ছিলেন।

ঋজু ও সরল ব্যক্তিত্বের ছাপ জীবনভর তাঁর সকল কর্মকাণ্ডে প্রকাশিত ছিল।
সংহতি প্রকাশন বাংলাদেশে প্রথম এই গ্রন্থটির একটি সংস্করণ প্রকাশ করতে পেরে সম্মানিত বোধ করছে। এপিডিআরের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সুজাত ভদ্র গ্রন্থটি প্রকাশের অনুমতি বিষয়ে কপিল ভট্টাচার্যের পরিবারের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব নিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। এই সংস্করণে আমরা তাঁর বানান ও ভাষারীতি যথাসম্ভব অক্ষুণ্ন রেখেছি। কেবল কিছু মুদ্রণ ত্রুটিই সংশোধন করা হয়েছে। তাছাড়া গ্রন্থের সাথে সংযোজিত মানচিত্র ও অন্যান্য ছবিগুলোও বহাল থাকছে।
প্রকাশক সংহতি প্রকাশন

গ্রন্থটি আজিক সুপার মার্কেট এর বই-এর দোকানগুলোতে পাওয়া যাবে।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×