somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘোরাঘুরি ব্লগ: উত্তর মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ/ সমুদ্র যেখানে মা (৫ম অংশ)

১৩ ই মার্চ, ২০০৮ সকাল ১০:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৬.
মানাগাহা দ্বীপে

মানাগাহা দ্বীপ -- নামটাই কেমন যেন গল্পে উপন্যাসে পড়া কোন রহস্যময় স্থান, যেখানে জাহাজডুবি বাবিমানদুর্ঘটনার ফলে কিছু মানুষ এসে শুরু করবে বেঁচে থাকার লড়াই। হঠাৎ সামনাসামনি দেখলে সেরকমই মনে হয়, রবিনসন ক্রুসোর একা একা দ্বীপে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের দৃশ্যগুলো মনে পড়ে যায়। কংক্রীটের যে রাস্তাটা আপনাকে নিয়ে দ্বীপের কাছে পোঁছে দেবে সেখান থেকে ডানে-বাঁয়ে দুদিকেই সৈকত, যেকোনদিকেই যেতে পারেন। তবে দেখবেন, বাঁয়ে মানুষ অনেক বেশী, সম্ভবতঃ এ অংশটা সাঁতার কাটা বা সাগরের বুকে লাফালাফি করার জন্য বেশী উপযোগী, মানে অগভীর। আমরা দৌড়ে ছুটে যাই সৈকতের দিকে, সাগর যেন এখানে আরো সুন্দর; আরো আকর্ষণীয় নীলে নীলাম্বরি। সৈকতে গিয়ে প্রথমেই আমাদের কাজ ছিল ভিনাইল শীটটাকে বিছিয়ে সেখানে ক্যামেরা/ভিডিওক্যামেরা, বেনতোবাক্সদুটো আর ব্যাগট্যাগ এসব রাখার ব্যবস্থা করা। একাজটা করতে গিয়েই টের পেলাম পুঁজিবাদের পাল্লায় পড়েছি। সেটা ব্যাখ্যা করার আগে একটু ভুমিকার দরকার।

আমাদের পাউপাউ ট্যুরটা আসলে খুবই সাশ্রয়ী, আগেই বলেছি। জাপানে যে কোম্পানীটি আয়োজন করেছে ট্যুর, সেটার নাম "টেল মি ক্লাব" -- এরা গরীবের ভরসা। জাপানের বনেদী ট্যুর কোম্পানী হলো "জেটিবি", পর্যটন খাতে এদেশে প্রায় মনোপলি ব্যবসা এদের। যেমন উদাহরন দেয়া যাক। আমাদের ট্যুরে বিমানভাড়া আর পাঁচরাত হোটেলভাড়া মিলে মাথাপিছু পড়ল ৬৫ হাজার ইয়েন। একই কোর্স যদি আমরা জেটিবি'র সবচেয়ে সস্তা প্ল্যানেও নিই, তাহলে মাথাপিছু পড়ত ৯৯ হাজার ইয়েন, আমি সবার আগে জেটিবিতেই খোঁজ নিয়েছিলাম। আর এই ৯৯ হাজার থেকে শুরু করে তিন লাখ পর্যন্ত নানান কোর্স আছে তাদের। তিন লাখ গুনলে আপনি হাইয়্যাট রিজেন্সীতে হয়ত কিংসুইটে থাকতে পারবেন।

মানাগাহার সৈকতে গিয়ে দেখি সৈকতে শুয়ে শুয়ে সমুদ্র দেখার জন্য লাইন ধরে বসানো আছে ইজিচেয়ার টাইপের প্লাস্টিকের বেঞ্চি (এগুলোকে কি বলে জানিনা) আর সেগুলোকে ঢেকে রেখেছে বিশালাকায় ছাতা গুলো (এই ছাতাগুলোকে প্যারাসোল বলে)। আমরা মহানন্দে চলে গেলাম একটার কাছে, কিছুক্ষণ চোখ মুদে সৈকতে শুয়ে শুয়ে ভিটামিন ডি খাওয়া যাবে -- এই ভেবে। কিন্তু গিয়েই পেলাম পুঁজিবাদী ধাক্কাটা, দেখি প্রত্যেকটা বেঞ্চির মাথার দিকে যে ছাউনীর মতো কাপড়গুলো ঝুলে আছে, সেখানে লেখা, "বুকড বাই জেটিবি"। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল!! সবচেয়ে ভালো জায়গাগুলো জেটিবি দখল করে রেখেছে। কেউ কিছু বলছেনা!! অগত্যা একটু ভেতরের দিকে গিয়ে সৈকতের বালুর উপরই ভিনাইল শীট বিছাতে হলো।

তার পরপরই সব ভুলে গেলাম, জেটিবিই কি আর টেল মি ক্লাবই বা কি। কিছুক্ষণ পুঁজিবাদ, জেটিবিকে বকাঝকা করে আমরা নেমে পড়লাম সমুদ্রে। মানাগাহার সৈকতের নুড়িগুলো আরো পরিস্কার, আর সেদিনটা ছিলও অসম্ভবরকম আলো ঝলমলে। মনে হলো বিশাল উৎসবে মেতেছে মানাগাহার সমুদ্র। বাবা-মা'রা বাচ্চাদের নিয়ে নেমে পড়েছে, বাচ্চাগুলো সবাই ডোনাট আকৃতির লাইফবোটের মাঝখানে ঢুকে ভেসে বেড়াচ্ছে সমুদ্রে, ইচ্ছেমতো চীৎকার চেঁচামেঁচি। বড়রা মূলত করে বেড়াচ্ছে স্নোরকেলিং; সাগরে ঢেউও নেই তেমন -- এব্যাপারটাতেও অবাক হই। কারণ জাপানে প্যাসিফিকের সৈকতগুলো বা আমাদের বঙ্গোপসাগরের সৈকতে তো বিশাল বিশাল ঢেউ আসে। এই সাগর সুন্দর, না হয় সেটা মানা গেল, তাই বলে ঢেউও থাকবেনা!! প্রকৃতির সব পক্ষপাতিত্ব একই দিকে!! তবে এসব হাইথট দার্শনিক চিন্তার আগেই যে কষ্টটা আবার চাড়া দিয়ে উঠল, সেটা হলো -- আমদের দুজনের কেউই সাঁতার জানিনা। ঢাকা শহরে বড় হওয়ার এই এক জ্বালা, সারা শহরে গোসল করা তো দূরের কথা নেমে লাফালাফি করার মতোও একটা পুকুর নেই। কয়জনের সাধ্য আছে বেইলীরোড অফিসার্স ক্লাব বা ঢাকা ক্লাবের সদস্য হয়ে বাচ্চাদের নিয়ে যাবে সাঁতার শেখাতে। আর এই যানজটের যুগে সে সময়ই বা কোথায়? আমরা সমুদ্রের উপরকূলেই কিছুক্ষণ লাফালাফি/দাপাদাপি করি, দুধের সাধ পানিতে মিটে কি মিটেনা, এ অবস্থা।

যারাই সমুদ্রে গেছে তারা সবাই স্বীকার করে যে সমুদ্রের কাছে গেলে একসময় আত্মসমর্পন করতে হয়, সাগরের ডাক অবহেলা করা যায়না। আমাদের এই ডাক অবহেলা করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী কিছু কারণ ছিল। প্রথমটাতো বললামই, সাঁতার না জানা। তার ওপর যোগ দিল, বাঙালী কালচারাল শক। সাগরের কাছে গিয়ে বুঝলাম, এখন যদি পরনের প্যান্ট আর শার্ট ভেজাই, তাহলে আজ সরাবেলা এই ভেজা কাপড়েই কাটাতে হবে -- আমার জ্বরের ধাত মারাত্মক। আমার পক্ষে সেটা সম্ভবইনা। মোনারও একই অবস্থা। তখন হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, যস্মিন যদাচার। এদের মতো মজা করতে হলে এদের মতোই পোষাকে আসো। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব না, হাজার হোক মধ্যবিত্ত বলুন আর প্রতিক্রিয়াশীলই বলুন, ওরকম নেংটি পরে খোলা আকাশের নিচে নামা তো আমাদের মতো হাড়হাভাতে বাঙালীর দ্বারা হবেনা। আমরা হাঁটুপানি পর্যন্ত নেমে কিছুক্ষণ হাঁটি, কিছুক্ষণ দৌড়াই। এভাবেই কেটে যায় মিনিট দশ বিশ। কিন্তু আর কত!! সমুদ্রের ডাক কতক্ষণ উপেক্ষা করা যায়। আমি মোনাকে বলেই ফেলি,
"দেখো, ঢেউ একদমই কম, চলো আরো দূর পর্যন্ত যাই।"
"জামাকাপড় সব ভিজে যাবে তো!"
"আরে অসুবিধা নাই, রোদের যা তাপ, দশ মিনিটেই শুকিয়ে যাবে।"
"হুমম, সেটা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা তুমি এক কাজ করো, শার্টটা আমাকে দাও, ওখানে রেখে আসি।"
বুঝতে পারছি আমরা দুজনেই সমুদ্রে নামার পক্ষে কিছু কারণ বের করতে চাচ্ছি। তাছাড়া আমার ট্রাউজারটা ছিল সিনথেটিক কাপড়ের, এগুলো ভিজলেও পানি ভেতরে ঢোকেনা। সো নো প্রবলেম।
মোনা দৌড়ে গিয়ে আমাদের আস্তানায় আমার শার্টটা রেখে, টাওয়েল নিয়ে আসল, তারপর টাওয়েল শালের মতো জড়িয়ে বলল, "চলো।"

আনন্দে লাফাতে লাফাতে বেশ দূরে চলে গেলাম, আমার প্রায় ঘাড় অবধি পানি পর্যন্ত। আহ, কি দারুণ! আমি আর পারলামনা, দিলাম এক ডুব, কতক্ষণ নিঃশ্বাস আটকে দেখার চেষ্টা করলাম, সাগরের নীচে। কিন্তু দু'সেকেন্ডের মধ্যেই চোখ ঝাপসা হয়ে যায়, কিছু দেখা যায়না, পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই যেন হাঁপিয়ে উঠি, সাগর ফুঁড়ে বের হয়ে আসি পাতালে! মোনা বেচারী ডুব দিতে পারলনা, বলল, সমুদ্রের নোনা পানি চুলে নিয়ে আজ সারাদিন ঘুরলে পরে তার ন্যাড়া হওয়া ছাড়া আর কোন গতি থাকবেনা। আমি মনে মনে হাসি, ভাবি, "ভাগ্যিস, মাথায় টাক পড়েছিল!"

সাগরের ডাক উপেক্ষা না করে ভালো করেছিলাম। ভালোভাবে উপভোগ করতে পারছিনা বলে যে কষ্ট ছিল, কিছু ডুব, আপাদমস্তক ভেজা কাপড়ে কূলে এসে সেই কষ্টটা চলে গেল। তবে মজার ব্যাপার হলো দশপনের মিনিটের মাথায় আসলেই জামাকাপড় সব শুকিয়ে যায়। পরে শুনলাম তপনদার কাছে, প্রতিদিনই প্রায় দশটা এগারোটার দিকে রৌদ্রজ্জ্বল থাকে সাইপানের আকাশ। আমরা উঠে গিয়ে সৈকতে রাখা হাত-পা ধোবার শাওয়ারে ভালো মতো স্যান্ডেলের বালু ঝেড়ে, ধুয়ে মুছে দ্বীপটা ঘুরে দেখার প্রস্তুতি নেই।

দ্বীপের মাঝখানের সেই রেস্টুরেন্টে দেখলাম কোরিয়ান খাবারের ব্যাপক আয়োজন, সম্ভবতঃ এদ্বীপে কোরিয়ানরা খুব আসে। আশপাশেও প্রচুর কোরিয়ান ভাষা শোনা যাচ্ছে। এখানকার আরেকটা ব্যাপার দেখলাম, রেস্টুরেন্টের ওয়েইটার ওয়েইট্রেসরা জাপানী রেস্টুরেন্টগুলোর মতো ফরমাল না। ফিলিপিনো এক ওয়েইটার রীতিমতো লুকোচুরি খেলে খাবার সার্ভ করছে, যেমন, কেউ জাপানীজ রামেন (স্যুপসহ নুডলস) অর্ডার করেছে। ওয়েইটার রামেন নিয়ে তার টেবিলের দিকে যাচ্ছে, তাকে দেখে জাপানী কাস্টমারও উঠে আসল সেটা নিতে। জাপানী কাস্টমারটি কাছাকাছি আসতেই ওয়েইটার রামেনের ট্রে হাতে অন্যদিকে ভোঁ দৌড় দিল। চারপাশে সবাই হা হা হা করছে, জাপানী ছেলেটা কাঁচুমাচু হয়ে গেছে, বুঝতে পারছেনা কিভাবে সে তার রামেন পুনরোদ্ধার করবে! আমি হাসতে হাসতে মোনা বললাম, "জাপান হইলে তো এখনই এই ওয়েইটারের চাকরী যায়!" পুরো রেস্টুরেন্ট মাতিয়ে রেখেছিল সেই ওয়েইটার, এর মাঝেই হঠাৎ ঘোষনা হলো রেস্টুরেন্টের উঠোনে হাওয়াইয়ান ড্যান্স শো হবে। আমি ভাবলাম কি না কি! মহা উৎসাহে বউয়ের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ক্যামেরা ভিডিও নিয়ে রেডি, এখনই শট নেয়া হবে। একটু পরে যা দেখলাম, তাতে তো রীতিমতো হতাশ! বাচ্চা দুটো মেয়ে লাজুক মুখে হাসতে হাসতে পলিনেশিয়ান নাচ পরিবেশন করল, তবে নাচ ভালো হয়েছে। চারপাশে দেখলাম লোকজনও হাততালি দিয়ে দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে।

গরম গরম এক কাপ কফি গিলে বের হয়ে পড়লাম দ্বীপটা দেখতে। সারা দ্বীপ জুড়ে বেশ কিছু পিকনিক ছাউনী আছে, ইটের তৈরী। প্রতিটি ছাউনীতে আবার বারবিকিউ, বসে খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। একটা ছাউনীতে দেখলাম একদল টিন এজার চামোরো ছেলে আড্ডা দিচ্ছে, আমার কৈশোরের আড্ডার কথা মনে পড়ে গেল। এদের অলস নড়াচড়ার সাথে আমাদের বেশ মিল। দ্বীপের পূবপাশে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েকটা কামানের অবশিষ্টাংশ সাজিয়ে রাখা আছে। দ্বীপের একদম মাঝামাঝি অংশটায় এখনও কারো হাত পড়েনি, পঞ্চাশ মিটার ব্যাসের একটা জঙ্গল হবে হয়ত। এই প্রথম আমার জনমানবহীন দ্বীপ দেখা, তবে এত ছোট এই দ্বীপে রেস্টুরেন্ট/ ছাউনী, আরো এটাসেটা তৈরীর পর সেই উত্তেজনা আর ধরে রাখা যায়না। ঠিক যে অনুভূতি নিয়ে দ্বীপটায় ঢুকেছিলাম, সেটা পাইনি, স্বীকার করতেই হবে। ঘুরতে ঘুরতে কখন সাড়ে বারোটা বেজে গেল টেরও পাইনি, খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা আবার টোলগেটের কাছে চলে আসলাম, ঠিক একটায় বঙ্গদার এখানে আমাদের নিতে আসার কথা, তখন প্যারাসেইলিং হবে।


প্যারাসেইলিংয়ে আকাশে উড়ি, বৃষ্টির মাঝে সাগর দেখি

সময়মতো বঙ্গদা চলে এলো, সাথে সকালের সেই মাঝি আর তার হেল্পার। আমাদের সাথে আরেক ব্রাজিলিয়ান জুটিও উঠল, মেয়েটি সম্ভবতঃ জাপানীজ ব্রাজিলিয়ান, ছেলেটি সাদা। ছেলেটি চুপচাপ ভাবুক মনে সাগর দেখছে আর মেয়েটি একাএকাই বোট দাপাচ্ছে। কতক্ষণ পর হেল্পার এসে ওদের কে প্যারাস্যুটের সাথে বেঁধে দিল, নিয়ে গেল নৌকার পেছনের পাটাতনে। বঙ্গদা তার নৌকার অটোডিভাইস থেকে দড়ি ছাড়া শুরু করল। ধীরে ধীরে পাখা মেলে ধরেছে প্যারাস্যুট, আমাদের চোখের সামনেই ব্রাজিলিয়ান জুটিটি ধীরে ধীরে ছোট ছোট দুটো বস্তুতে পরোণত হয়ে গেল যেন। নৌকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সাগরে, প্যারাস্যুট আকাশে। আমরাও আকাশে ভাসার প্রস্তুতি নেই। ওড়ার সময় বঙ্গদাকে ভিডিও ক্যামেরা আর চামোরো মাঝিকে ক্যামেরাটা দিয়ে গেলাম, উড়তে উড়তেই দেখতে পেলাম মাঝি মহাআগ্রহে বঙ্গদার কাছ থেকে ভিডিও ক্যামেরাটা নিয়ে নিল। আমাদের ওড়ার সারাটা সময় সে ভিডিওই করে গেল, ক্যামেরার কথা গেল বেমালুম ভুলে। ফলাফল, কোন ছবি নেই!

আকাশে যখন আমরা উড়ছি, তার মাঝপথেই হঠাৎ ঝুমবৃষ্টি। আমি ভয় পেয়ে গেলাম, কিন্তু দেখলাম বৃষ্টি নামার সাথে সাথেই চামোরো মাঝি আমাদের দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে অভয় দিচ্ছে। আর কি সমস্যা। "আকাশে বৃষ্টির লগে সাগর দেখি" --- কি জানি মনে পড়ে পড়ে করেও পড়ছেনা। আমার সবসময় নিজেকে প্রিভিলেজড মানুষ মনে হয়, মনে হয় স্রষ্টা সবসময় আমার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছেন। বৃষ্টিটা নামার সেই মুহূর্তেও মনে হলো, "আকাশে ভাসতে ভাসতে বৃষ্টির পানির ছোঁয়া" -- এ অভিজ্ঞতা কি আর কখনও হবে? আমরা দুজনেই একথা ভাবতে ভাবতে করতে আকাশে উড়ছি, আমার মনে হলো পরম করুণাময় সেসময় মিটিমিটি হাসছিলেন।

দুজন বাঙালী কাস্টমার পেয়ে বঙ্গদা উল্লসিত। পনের মিনিটের জায়গায় তিনি আমাদের পঁচিশ মিনিটের মতো আকাশে ওড়ালেন, নেমে আসার পর গভীর সমুদ্রের দিকে ইঞ্জিনের নৌকা নিয়ে গেলেন, সাগরে ডুবে যাওয়া জাপানীজ ডুবোজাহাজের ভগ্নাংশ দেখাবেন বলে। আমি শিহরিত হয়ে ছবি তুলছি সেই ভগ্নাংশের, বন্ধুবান্ধবদের ইতিহাস দেখাবো বলে। তখনই সেই চামোরো হার্ডরক হেল্পার দিল ঝাঁপ সাগরে। সাগর বেশ গভীর সেখানে, তার ওস্তাদ আর বঙ্গদা দুজনেই চেঁচামেচি জুড়ে দিল।পাগলটা মিনিট পাঁচেক সাগরে দাপিয়ে ফিরে এলো। বঙ্গদা বললেন, কতক্ষণ পরপর সাগরে না নামলে ওর ভালো লাগেনা।

জেটস্কীর যন্ত্রণা
দুটোর দিকে আমরা আবার ফিয়েস্টা রিজোর্টের সৈকতে, অর্থাৎ মানাগাহা থেকে সাইপানে ফিরে এলাম। সুকেশদা দৌড়ে এলো, কেমন লাগল জিজ্ঞেস করে নিজেই বঙ্গদার উচ্ছসিত প্রসংশা করতে লাগল। বলল, "ভাই আমরা কাস্টমারের ঝাড়ি খাইছি, জাপানীগুলা বিশেষ কইরা পাঁচ মিনিট দেরী হইলেই মেজাজ দেখায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত বঙ্গের নামে কেউ কিছু কয়নাই।" আমিও ভাবলাম, হুমমম, আসলেই চমৎকার এক অভিজ্ঞতা হলো আমাদের। সাইপানে যেই বেড়াতে যাবেন, বঙ্গদার প্যারাসেইলিং যাতে মিস না করেন -- এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। একটু পরেই সুকেশদা বলল, "মুকিত ভাই, আজকে রাতে আপনাদের প্ল্যান প্রোগ্রাম নাই তো?"
আমি বললাম, "না"।
"তাইলে দাদা আমাদের সাথে চাইরটা ডাইলভাত খাইতে হবে, আমি বঙ্গ তপনে মিলা রানমুনে। বঙ্গর বউও থাকবো, জাপানী খাবারও রানতে পারে। আপনেরে তাইলে সাতটার দিকে নিতে আসুমনে।"
"তাই নাকি?" আমি খুশী হয়েই বললাম,"খারাপ না তো।"

সুদূর সাইপানে এসেও পেটে বাঙালী খাবার পড়বে কে ভেবেছিল। আমি খালি কৃতজ্ঞই হতে পারি।

খানিক পরে জেটস্কী'র লোক এসে আমাদের নিয়ে গেল স্কী করাতে। সেইফ গার্ড টাইপের এই ভদ্রলোক একজন ফিলিপিনো। জেটস্কীর নিয়ম হলো বিশাল সাইজের মোটরবাইক টাইপের একটা যান সাগরের বুকে ভাসিয়ে বেড়ানো। মোটর বাইকের মতোই একসেলারেটর, ব্রেক আছে। ব্রেকটা বেশ মজার, একটা স্টপ লেখা বাটন, ওটা চাপলেই বাইকা থেমে যায়। মাটিতে চলা বাইকের মতো হুমড়ি খায়না। এখানে স্বীকার করে রাখি যে একটা কাজ কোনদিন আমাকে দিয়ে হবেনা, সেটা হলো ড্রাইভিং। এমনকি বাইসাইকেলও না। একজন একটা বাইক চালানোর কথা, কিন্তু বাইক চালানোর সাহস আমার নেই। আমি নির্ঘাৎ পানিতে ডুবে যাবো -- এই বলে আগেই সারেন্ডার করলাম। আমার বউয়েরও একই অবস্থা, কখনও কোন যান চালায়নি। শুধু পার্থক্য হলো, তার সাহস আছে।

দেখলাম, মোনা নির্বিকারভাবে ড্রাইভারের সীটে বসল, আমি কাচুমাচু হয়ে পেছনে বসলাম। স্টার্ট বাটনে চাপ দিয়ে দিলো এক ছুট, আমাদের ফিলিপিনো সেইফ গার্ড "থামো থামো" বলে ছুটে এলো। এখানে সুবিধা হলো, বাইক উল্টে আমরা যদি পড়েও যাই, তাও শরীর আর বাইকের সাথে বাঁধা একটি দড়ি আর লাইফ জ্যাকেটের মাধ্যমে শরীর ভেসে থাকবে, সেইফ গার্ড কাছাকাছিই তার নিজের বাইক নিয়ে ঘুরতে থাকে। কেউ টসকে গেলে সাথে সাথে বাঁচাতে চলে আসবে। মিনিট বিশেক সাগর দাপিয়ে বেড়ালো মোনা, ভেজা বেড়ালের মতো পেছনে বসে ভয়ে কাঁপতে লাগলাম আমি। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, কখন শেষ হবে এই যন্ত্রণা, কখন!!!

সাগরের পাড়ে ফিরে এসে আমি ভাবছি এরপর তো আরো বড় ঝামেলা, স্কুবা ডাইভিং!! হঠাৎ মনে হলো, "ধূরো, কেন যে এই ছাতার ম্যারিন স্পোর্টস করতে আসলাম!" মেজাজ খানিক খারাপ, সিগারেট খেতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু গিন্নী বড় কড়া। তবে স্বস্তির বিষয় হলো, স্কুবা ডাইভিংয়ে গিয়ে সব উশুল হয়ে গিয়েছিল। সেটা ভালো অভিজ্ঞতা না হলে হয়ত এ লেখাটাই লিখতামনা। স্কুবা ডাইভিংয়ের কথা আসবে পরের পর্বে।

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০০৮ বিকাল ৩:০৯
২৭টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×