somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মার্চেই জন্ম সবুজ গারোর

০৭ ই মার্চ, ২০০৮ দুপুর ১২:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৭ই মার্চ। বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে স্বাধীনতার গোড়াপত্তনকারী দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান নিশ্চই। একটা দিন দিয়ে যেমন ইতিহাসকে বোঝা যায় না; তেমনি কখনো একটা দিনই হয়ে ওঠে সামগ্রিক বহি:প্রকাশের বহ্নিশিখা। যে শিখাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দিতে থাকে স্বপ্নের গোড়াপত্তনের কথা, মানুষের মাঝে স্বাধীনতা আকাংখার বীজ স্ফূরিত হবার কথা। মনে করিয়ে দিতে থাকে কখনো ভুলে না যাবার কথা। আর সেই ভুলে না যাবার দলের অতন্দ্র সেনানী সবুজ গারো। তাঁকে খুঁজে পাওয়া যে কোন অর্থেই অপ্রত্যাশিত। অত:পর সেই আকষ্মিক প্রাপ্তির ঘোর সামলে কেবল নত মস্তকে শুনতে থাকা, একজন মুক্তিযোদ্ধার জবানীতে ‌’আত্মপরিচয়ের’ গল্প।
তাঁর বাড়ীটা ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র কয়েকশ গজ দূরে। দূর্গাপুরের লেংগুরা ইউনিয়নের প্রান্তসীমার একটি গ্রামে। বাড়ীটাকে ডানদিকে রেখে আর খানিকটা পথ এগুলেই ১৯৭১ এ ৬ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে নির্মিত (১৯৭৭ সালে) শহীদ মীনার। যেটার অবস্থান বাংলাদেশ ভারত নো-ম্যান্স ল্যান্ডে। বছরের একটা বিশেষ দিনে (২৬শে জুলাই) বৃহত্তর ময়মনসিংহের মুক্তিযোদ্ধা, সরকারী কর্মকর্তারা এখানে জড়ো হন দিবসটিকে উদযাপনের জন্য। সবুজ গারো নিজেও পরিবারসহ উপস্থিত হন সহযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য।
মাতৃপ্রধান ব্যবস্থায় বিয়ের পর থেকে সবুজ গারো বসবাস করছেন স্ত্রী আর শ্বাশুড়ির সাথে। তার বড় ছেলে পল্লী চিকিৎসক, মেঝ ছেলের এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশুনা আর একমাত্র মেয়ে জামাই সমেত এ বাড়ীতেই বসবাস করছেন।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ জুড়ে সবুজ ‘নিজের’ দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। ভারতে যেয়ে ট্রেনিং নিয়েছেন। এলএমজি চালানো শিখেছেন, গ্রেনেড ছোঁড়া শিখেছেন। গেরিলা আক্রমণে শত্রুদের নাস্তানাবুদ করেছেন। আর এর সবই করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য, নিজের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য। তাঁর কাছে গারো আর বাঙ্গালী পরিচয় বলে ভিন্ন কিছু নেই, এদুটোই সমার্থক; একটা আরেকটার পরিপূরক প্রতিদন্দ্বী নয়। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সারাংশ তিনি শুনতে পান বন্ধুদের মারফত। ঢাকা থেকে দূর্গাপুর হয়ে তার গ্রাম পর্যন্ত এই ভাষণের খবর পৌছাতে লেগে যায় কয়েক সপ্তাহ। এরপর মে মাসের মাঝামাঝিতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া। একমাত্র কারণ নিজের মত করে বেঁচে থাকার অধিকার রক্ষা করা। অর্জিত স্বাধীনতার তিন যুগ পরে যখন তিনি ‘বাঙালী’ আত্মপরিচয়ের আধিপত্য দেখতে পান চারপাশে; তখন কেমন লাগে, এ প্রশ্নের জবাবে নিশ্চুপই থেকে যান সবুজ। প্রথমেই উত্তর করেন আদিবাসী-বাঙ্গালী এই বিভাজন তিনি মানেন না। এটা সবারই দেশ, নিজের দেশের জন্যই তো যুদ্ধ করা। এরপর বলে ওঠেন, আমার পূর্বপুরুষরা দীর্ঘকাল ধরেই এখানে বসবাস করছেন। হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে রীতি, রেওয়াজ, আচারে অনেক পার্থক্য, কিন্তু সবাইতো এই ভিন্নতা সমেতই বসবাস করছে, তাহলে গারো, হাজং আর বাঙ্গালী মধ্যকার বিভাজন কেন। ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ বলে কোনকিছুকে তিনি প্রথমেই অস্বীকার করেন। যদিও এরপরই বলতে থাকেন যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলে অভিবাসিত অনেক বাঙ্গালীর জোর করে জমি দখলের কথা, নিপিড়নের কথা। এ যেন নিজের আত্মীয়ের অপরাধের কথা বাইরের মানুষকে না জানানোর চেষ্টা। যদিও কষ্ট আর হতাশার দগদগে ক্ষত বুকের ভেতরে। একসময়কার দীপ্ত মুক্তিযোদ্ধা চোখের বিষণ্নতা আড়াল করতে পারেন না কোনভাবেই।
সবুজ বলে ওঠেন, নিজের দেশের জন্য যুদ্ধ করে তিনি গর্বিত। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কথাগুলো তাকে ভীষণভাবে উদ্দিপ্ত করেছিল। নিজের ভূমি, নিজের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যদি তার প্রাণও দিতে হোত তাহলেও তিনি কুন্ঠা বোধ করতেন না। বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে বলতে যেয়ে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন যে পাকিস্তানীদের সাথে টেবিলের কথাতে কোন কাজ আর হবেনা, কিন্তু শেষ পর্যণ্ত তিনি চেষ্টা করে গিয়েছিলেন।‘
সবুজ গারোর অনেক নিকট আত্মীয়ই বাঙ্গালী। গারো ও বাঙ্গালী বিয়ে হয়েছে এমন উদাহরণ পাওয়া মোটেও কঠিন নয়। সীমান্তের ওপারের গারোদের সাথে এ পারের গারোদের বিয়ের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। সবুজ বলেন, ভারতীয় গারোরা বাঙ্গালী গারোদের হেয় করে দেখে। যদিও আত্মীস্বজনদের মধ্যকার যোগাযোগ নিয়মিতই হয়, তারা সাহায্য সহযোগীতা করে। কিন্তু ভারতে তিনি যতবারই গিয়েছেন ততবারই তার মনে হয়েছে যে ভারতীয় গারোরা বাঙ্গালী গারোদের সমমর্যাদা দেয় না। ওপারের সাধারণ মানুষজনও বাঙ্গালীদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। এই পুরো বিষয়টি তার কাছে অমর্যাদাকর। তিনি খুব প্রয়োজন না হলে ভারতে যেতে চাননা। নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে তার ইচ্ছা করেনা।
দুটো দেশের, দুটো রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষীজীবি মুক্তিযোদ্ধা সবুজ গারোর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, কষ্ট, মায়া, অপরাধবোধ আর নাড়ীর টানের এক মিশ্র জটিল অনুভূতি নিয়ে আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি। এক সময় তার মেঝ ছেলে ছুটতে ছুটতে এসে জানালো সীমান্তে আবারো কড়াকড়ি শুরু হয়ে গেছে, শহীদ মিনার দেখার ইচ্ছা থাকলে এখনি চট করে ঘুরে আসা যেতে পারে, পরে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যেতে পারে। তার কাছ থেকেই জানা গেল কড়াকড়ি হবার কারণ। “বিশ্বকাপ ক্রিকেটে প্রথম রাউন্ডে বাংলাদেশের কাছে ভারতের হারের ফলে সীমান্তবর্তী মেঘালয় রাজ্যের সমার্থকরা খুব আশাহত হয়েছে। এদিকে বিএসএফও ভারতীয় হারকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি, তাই সীমান্তে কড়াকড়ি করে দিয়েছে। আগে যাও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কম দামে আনা যেত সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। নো ম্যান্স ল্যান্ডে হাঁটা চলা, গরু ছাগলদের ঘাস খাওয়ানো, বন থেকে কাঠ আনা সব বন্ধ হয়ে গেছে।“

খুব বেশি আগে নয়, বঙ্গবন্ধুর এদেশকে ভালোবাসার যে সমগ্রতা তা অনুপ্রাণিত করেছিল, মহানগর থেকে অনেক দূরের সবুজ গারোকেও। তিনিও দেখেছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্ন। আজকের সবুজ গারোর সবকিছুর সাথেই তাই জড়িত হয়ে আছে ৭ই মার্চ। আসলে আরো অনেকের মতই গড়ে তুলেছে পুরো একটা জীবন। মহানগরের টেবিল রাজনীতি থেকে খুব খুব ভিন্ন একটা কিছু। শহরের দলীয় মাইক বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে যখন ক্যানভাসিং এ নামিয়ে দিয়ে ঐক্যের উল্লাস করছে। তখন সবুজ গারোর সংস্পর্শে আমি বুঝতে শুরু করি ৭ই মার্চের আহবানের তাৎপর্য। অনেক কষ্টে অর্জিত বাঙ্গালী আত্মপরিচয় নিয়ে আমি বিমর্ষই থাকি। দালালরাজাকারসামরিকসিভিলকর্পরেটের উল্লাস আর অন্য জাতিসত্তার দমনে আমি কোন স্বস্তি পাইনা। আমার মধ্যে ধ্বণিত হতে থাকে.....‌’এবারের সংগ্রাম....আমাদের.......’ । আমি শেষ করতে পারিনা, যদিও একই স্বরে শেষ করতে পারলেই আমি সবচেয়ে সুখী হতাম।
(আত্মপরিচয় নিয়ে নিজের গবেষণা কাজের সূত্রে, মুক্তিযোদ্ধা সুবজ গারোর সাথে আমার পরিচয়। তার গোপনীয়তাকে সম্মান করেই কিছু তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। তার সাথে আমার যোগাযোগও বেশ আগেই। বুদ্ধিমান পাঠক নিশ্চই সময়টাও অনুমান করতে পারছেন।)
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

EU বাংলাদেশ, আফ্রিকা ও আরবদের সাহায্য করার চেষ্টা করে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১০ ই জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৩



EU বাংলাদেশকে বিবিধভাবে সাহায্য করে আসছে স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু থেকে; বিশেষ করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গুলোকে সচল করার জন্য সহযোগীতা করতে চায়। আমাদের দেশে ও আফ্রিকায় ভালো যা ঘটছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে কোকের আতারোট শিল্প অঞ্চলের কারখানা: ফিলিস্তিনি স্টেইটহুড, স্বনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে অসমম্মান করে।

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১০ ই জুন, ২০২৪ রাত ১১:১৭

কোকা-কোলার পূর্ব জেরুজালেমের আতারোট শিল্প অঞ্চলের কারখানাটিকে ঘিরে শুরু থেকেই তীব্র বিতর্ক আছে। এই এলাকাটি আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের অধিকৃত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

জঘন্যতম রেফারির বলি বাংলাদেশ

লিখেছেন অধীতি, ১১ ই জুন, ২০২৪ রাত ১২:২১

আজকে রেফারি খেলছে মূল খেলা। গতকালকে পাকিস্তান লর্ডগিরি করে হারছে কিন্তু এই দিক থেকে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছে। দুইটা ওয়াইড দেয়নি। রেফারি তিনটা আউট দিছে তাড়াহুড়ো করে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিপক্ক প্রেম: মানসিক শান্তি

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১১ ই জুন, ২০২৪ রাত ২:৩০






জীবনের নির্দিষ্ট একটি সময়ে পৌঁছানোর পর, মানুষ যখন পরিপক্ক হয়ে ওঠে, তখন প্রেমের মাপকাঠি বদলে যায়। তখন আর কেউ প্রেমে পড়ার জন্য শুধু সৌন্দর্য, উচ্ছ্বলতা, কিংবা সুগঠিত দেহ খোঁজে না।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রবীন্দ্রনাথের শেষ কটা দিন কেমন কেটেছিল?

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১১ ই জুন, ২০২৪ সকাল ১০:১১




১৯৪১ সালে জীবনের শেষ দিনগুলোয় অসুখে ভুগছিলেন কবি। সারা জীবন চিকিৎসকের কাঁচি থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছেন, এবার বুঝি আর তা সম্ভব নয়। হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি চলছেই। কিন্তু কিছুতেই কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন

×