somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তাহাদের একুশ, আমাদের আট / তাহাদের ক্রুশ, আমাদের ছায়াঢাকা পুকুরঘাট

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ সকাল ১১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক.
সকাল আটটা বাজতে না বাজতেই ডেইভ ক্যাসেলের সামনের রাস্তাটা গাড়ির আনাগোনায় মুখরিত হয়ে ওঠে। রবিবার যে আজ। দুহাতে উপার্জনের নেশায় বিভোর মানুষগুলো আজ একদিন পরস্পরকে উইশ করে কাটাবে। পিজ্জাহাটে কিংবা পেস্ট্রিশপে, বারে ঢিলে তামে সময় চলে যাবে, সবুজ পার্কে নারীপুরুষ শিশুর পায়ে পায়ে হেটে বেড়ানো দেখে হেটে বেড়াতে ইচ্ছে করবে অদ্ভুত নীল ঘাসফড়িংয়েরও। আর সকাল আটটা থেকে এক ঘন্টার জন্য জমে উঠবে সাউথ স্প্রীং স্ট্রিট।

বাইরে যতই ব্যস্ত থাকুক সেইন্ট পল গীর্জার ঠিক সাড়ে আটটার ঘন্টা ধ্বনি ভেতরের এলামেলো চাপা জমাট কোলাহলকে মুহুর্তের মধ্যে স্তব্ধ করে দেয়, থেমে যায় ছোট্ট এ্যানের এলামেলো চাহনী। আলতো হাতে ধরা ম্যামের আঙ্গুল ছেড়ে দিয়ে অন্য সবার মত মনোযোগী হয়। ছোট্ট তবুও তার ক্যাথেড্রাল প্রিয়। রবিবার আসলেই গভীর আগ্রহে সকালের প্রতীক্ষা ।ক্যাথেড্রালের নিস্তব্ধ আবহাওযা তাকে অনেক দুরে অজানা কোন জগতে নিয়ে যায় যেন। বাইবেলের স্কবক পাঠ করে শুনায় পাদ্রী, ক্রুশের পায়ের দিকে চোখ যায় আস্তে আস্তে উপর উঠে মাথার দিকে। ভাল লাগে খুবই ভাল লাগে এই মধুর বীনার সুর।

পাশের বাসায নতুন এসছেন সালামভ নামক এক রাশিয়ান। মুসলমান হবে। ভদ্রলোকের সাথে খানিক সম্প্রীতি গড়ে উঠেছে এ্যানের। মাঝে মাঝেই দেখে সে যখন হাত বেধে মাথা ঝুকিয়ে দাড়িয়ে থাকে। সুর করে কিছু একটা পড়ে। তখন তাকিয়ে দেখতে এমনি ভাল লাগে।

সুর করে বাইবেলের স্তবক পাট করে সবাই, পাঠ করে এ্যানও। সবার শেষে পাদ্রী কিছু কথা বলেন। এ্যানের কানে শুধু আসে ২১ শে ফেব্রুয়ারী।
কয়েক বছর হলো ২১ শে ফেব্রুয়ারীর কথা সে শুনছে। মাদার ল্যাংগুয়েজকে ইস্টাবলিশ করার জন্য কয়েকজন লাইফ সেক্রিফাইস করেছে। ধা করে মনে পড়ে একটা কথা। বাঙ্গালী এক বন্ধুর মুখে শুনেছিল সালাম নামের কে একজন ছিল তাদের মধ্যে। সালাম আর সালামভ কি কাছাকাছি নাম! দুজনেকেই একই সমতলে কল্পনা করে। একজন জীবিত আরেকজন জীবনকে উৎসর্গ করেছে। এ মুহুর্তে মনে হল সালাম তার বড়ই আপন।

সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে আছে সমবেত জনসমস্টি। ধীর পায়ে তার মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসে অ্যান। কৌতুহলী সবার চোখের সামনে দিয়ে ছোট্ট বালিকাটি পৌছে যায় যীশুর পায়ের কাছে। এক মিনিট চুপচাপ দাড়িয়ে আস্তে করে গলায় ঝুলানো ক্রুশটা খুলে পায়ের কাছে রেখে দেয়। পিছন ফিরে পাদ্রীকে কিছু একটা বলে। বেরিয়ে যায় অন্য কাউকে কিছু না বলেই।



ডেইভ ক্যাসেলের সামনের রাস্তায় একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। এ্যান তার সকল ভালবাসাকে উৎসর্গ করেছে এক সালামের জন্য। যে কিনা , তার মায়ের ভাষার সন্মান রাখতে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছে।




দুই.
সেই বুড়াটার কথাটা মনে হতেই আমাদের ভীষন হাসি পেতো। বুড়াটাও ছিলো বেশ মজার। ছোটবেলায় দুস্টামীতে পাকা বান্দর ছিল মনে হয় যদিও স্বীকার করতে চায় না। ভাব দেখায় এমন যেন তার মত সুফী সাধক আর কেউ নেই।

মাঝে মাঝেই পুকুরঘাটে বিশাল আড্ডা হয়ে যেতো আমাদের। কত যে গল্প তার কি ইয়ত্বা আছে! কতদিন যে বুড়ার গাল টিপেছি। দাত ছিলনা একটা তবে দারুন সুড়সুড়ি ছিল। মাঝে মাঝে কানের মধ্যে মুরগীর পালক আলগোছে ঢুকিয়ে দিলে সেকি লাফালাফি তার। ভীষন কান চুলকাতো তখন। তার প্রেমের গল্প শোনার জন্য আমরা ঠেসে ধরতাম। প্রেমের গল্প মানে বুড়ির সাথে মান অভিমানের গল্প। বুড়ি আবার ছিল ভীষন চ্যাতা পাবলিক। একদিন টের পেলো বুড়া তার নামে বদনাম করছে আমাদের কাছে আর যায় কোথায়! হাতের বটি উচিয়ে বুড়াকে তাড়া করে পিছন বারান্দার পেযারা তলা থেকে পশ্চিমের বাগান হয়ে উঠোন পেরিয়ে কলতলা পর্যন্ত গিয়ে ক্ষ্যান্ত দিল। আমরাও বুড়ির পক্ষ নিয়ে হই হই রই রই করে পিছু ছুটতাম। আস্তে আস্তে দৌড়াতাম পাছে আবার ওনাদের কস্ট হয়। লুকিয়ে লুকিয়ে একটু আধটু বিড়ি টানার অভ্যাস ছিল। যেদিন আমরা টের পেয়েছি সেদিন আর রক্ষা নেই, বুড়া হয়েছে এখনও বিড়ি খায় ইত্যাদি ইত্যাদি সক্রোধে পকেট থেকে সব বের করে পা দিয়ে থেতলে মাটির সাথে মিশিয়ে তারপর যা হবার হবে। এবারের মত মাফ করার জন্য বুড়ার যত অনুনয় বিনয় সব মাঠে মারা যেতো।

সেই পুকুর ঘাট ফাল্গুন এলই চোখের সামনে আসে। একটা কৃষ্ণচুড়া গাছ ছিলো পাড়ে। লাল লাল ফুল সব ফুটে থাকত। মাটিতে পড়ে ঢেকে যেত পথ। বুড়া মাঝে মাঝে উদাস হয়ে বসে থাকত। বুড়া কি কৃষ্ণচুড়া ফুল দেখলে অমন ইদাস হয়ে যেতো !

শীতের শেষে দুপুরের দিকে একটু আধটু গরমের দেখা পেলে বাতাস খাওয়ার জন্য আমাদের ভরষা পুকুরঘাট। বুড়ো আর কতগুলি দুস্ট ছেলেদের মিলনমেলা। বুড়োকে মুখ ভার দেখলে ভাল লাগতো না। হাসানোর চেস্টা করতাম। মাঝে মাঝে কাজ হতো আবার হতো না। একদিন সবাই মিলে অনেক চেস্টা করছি কাজ হচ্ছে না। একটা প্লান করলাম। সবাই মিলে ধুপ করে বুড়োকে পুকুরে ফেলে দিলাম। বুড়া উঠে হাসবে না কাদবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না। গজর গজর করতে লাগল। বান্দর ছান্দর পোলাপাইনগুলা আয়ে কোয়াইন্দা। আমাদের হাসি চলতে থাকে। বুড়া নিজেও একসময় হাসতে শুরু করে। আমরা গামছা এনে দেই গা মুছে সেদিনের মত হাসি ঠাট্টার পর্ব সমাপ্তি ঘটে।

আচ্ছা বুড়া, তুমি মাঝে মাঝে এমন ভাব নিয়া বসে থাকো কেন ? বুড়া কয় কই নাতো।
শেষে স্বীকার করে ফাল্গুন চৈত্র মাসে যখন গাছে ফুল ফোটে তখন তার বিভিন্ন কথা মনে পড়ে।

একদিন বুড়া তার গল্প শোনায়। সালামকে চিনিস তোরা। বাংলার মিছিল করতে গিয়ে মারা গিয়েছিল যে সালাম।
হ্যা চিনি মনে নাম জানি। সবাই নাম জানে।
সালাম আমার জানের দোস্ত ছিলো।
তাই নাকি। আগে আগে তো কখনো বলনি।
আগে বললে কি হতো। তোদের বোঝার বয়স হয়েছে !
বয়স হয়নি মানে। কি মনে হয় আমাদের। একজন তেড়ে আসে মনে হচ্ছে আবারো বুড়াকে পানিতে ফেলা হবে
ভাব বুঝে কথা ফেরত নেয়। আচ্ছা ঠিকাছে বুঝছি তোগো বয়স হয়েছে শোন।

একদিন এই পুকুরপাড়ে বসে সালামের সাথে কত সময় ধরে যে গল্প করলাম। আহ বেচারা তার কয়দিন পরেই মরে গেল। বড় ভালো ছিল। তোরা জানিস সেদিন কয় তারিখ ছিল্।
২১ শে ফেব্রুয়ারী । আমরা যার যার মত সাড়া দেই।
তোরা তো শুধু একুশে ফেব্রুয়ারী চিনবি। ফাল্গুনের ৮ তারিখ ছিলো তা জানবি না। বুড়োর ক্ষোভে আমরা বাতাসে উড়ে যাই।
সেদিন থেকে পুকুর পাড়ে কৃষ্ণচুড়া গাছের নিচে মনখারাপ বুড়োকে দেখলে আমারও মন খারাপ হয়।

পুকুর, বিল কি খালের পাশে কৃষ্ণচুড়া কিংবা শিমুল কিংবা পলাশ গাছ দেখলে আমার সেই বুড়ার কথা মনে পড়ে। আমি একটু থমকে দাড়াই, উকি দেই টলটলায়মান স্বচ্ছ পানিতে । একটা চেনা পরিচিত মুখ বিম্বিত হয়। ওটা কি সালামের মুখ। আমি চিনতে চাই কিন্তু চেনার আগেই ছোট ছোট ঢেউয়ের সাথে মিলিয়ে যায়।
১৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×