somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পটি টলস্টয় লিখেছিলেন

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ বিকাল ৪:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জগতে অনেক কিছুরই অপ্রাচুর্য আছে কিন্তু ভাবনার বিষয়বস্তুর কোন অপ্রাচুর্য নেই। চাইলেই ভাবতে বসা যায়, যা খুশি তাই নিয়ে ভাবো, বাস্তব-অবাস্তবের সীমারেখা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। হিসেবের গরু যেমন বাঘে খেতে পারে না তেমনি ভাবনার পাগলা ঘোড়াকেও বেড়া দিয়ে আটকানো যায় না। এ বাস্তবতা সবার জন্য সত্য, সত্য মোয়াজ্জেম তরফদারের জন্যেও। তরফদার একজন উঠতি বড়লোক, গার্মেন্টস মালিক। তাতে কিছুই যায় আসে না। হুমায়ুন আহমেদের ’হিমু রিমান্ডে’ প্রকাশিত হওয়ার দিন বইমেলায় হলুদ পাঞ্জাবী পরা হিমুদের মিছিলের খবরে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক বিব্রত হলেন কেন এ নিয়ে সে ভাবতে পারে অথবা আরো দু কাঠি এগিয়ে ফ্যান্টাসী ভাবতে পারে- কোন এক গভীর রাতে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক 'বাংলা' শব্দটির অপব্যবহার নিয়ে দূর্ভাবনাগ্রস্থ হয়ে পড়লেন (বাংলা ভাই, বাংলা বাংলা মদ, বাংলা সিনেমা, বাংলা তরীকা) এবং এ বিষয়ে গবেষণা কর্মের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে কি কি পদক্ষেপ নিলেন । ধান, গম, ভুট্টা সব বায়োফুয়েল বানিয়ে মনুষ্যপ্রজাতির দেহঘড়িটাকে খাবার না দিয়ে পরিমিত মাত্রার ফুয়েল দিয়ে টিকিয়ে রাখা যায় কিনা- এধরণের অতি প্রয়োজনীয় ভাবনা তো সময়ের দাবী। তাহলে আর কিছু হোক না হোক বিকাশমান গার্মেন্টস শিল্পে বিপ্লব ঘটে যেত। 'চাল ডালের দাম বাড়ছে, বেতন বাড়াতে হবে- এ জাতীয় বাকোয়াজ দাবী শুনতে হত না। যা হোক, এসব কোন কিছু না ভেবে মোয়াজ্জেম তরফদার ভাবছিল মহান লিও টলস্টয়ের একটি গল্পের কথা।

একেতো গার্মেন্টস মালিক, তার উপর নাম মোয়াজ্জেম তরফদার। আর সে কিনা ভাবছে টলস্টয়ের গল্পের কথা, বিষয়টা একটু খটকার হয়ে গেল না। সে খটকা দূর করতে হলে তরফদারের অতীত জীবনে সুলুক লাগাতে হবে। তবে এখনই আমরা তা করতে যাচ্ছি না। এ মুহুর্তে আমাদের সামনে উপস্থিত মোয়াজ্জেম তরফদার একটি জাজ্বল্যমান বাস্তব সমস্যার মধ্যে নিপতিত। এত বড় সমস্যা পাশ কাঁটিয়ে অন্য আলোচনার সূত্রপাত প্রাসঙ্গিক হয় না।

গত পরশু রাত থেকে ঘটনার শুরু। রুটিনমাফিক সব কাজ সেরে অভ্যেসমত দু’পেগ এ্যাবসলুট ভোদকা পান করে ঘুমোতে গিয়েছিল সে। ঘুমিয়ে এমনই এক স্বপ্ন দেখল যে তার ভাবন চক্রে আচ্ছামত প্যাচ লেগে গেল। বাংলা ভাষায় স্বপ্নের দুরকম মানে হয়। একটি স্বপ্ন হচ্ছে লক্ষ, ভিশন। অন্যটি ঘুমিয়ে দেখার স্বপ্ন, খোয়াব। লক্ষ নিয়ে তরফদারের কোন সমস্যা নেই। মাঝেমধ্যে লক্ষ বদল করে জীবনের এপিঠ-ওপিঠ ঘুরে ফিরে দেখার যে লক্ষ তাতে সে অবিচল আছে। তার সমস্যা খোয়াব নিয়ে। খোয়াবে সে দেখল, সে মোয়াজ্জেম তরফদার নয়, মেশিন অপারেটর মৌসুমি। তরফদারের গার্মেন্টসেই কাজ করে সে। স্বপ্নে সে একটা টাইট জিনস ও শর্টস পরে বসুন্ধরা মার্কেটে সানগ্লাস পরা এক লোকের হাত ধরে হাটছে। সে (মৌসুমি) নিশ্চিত নয় হাত ধরে হাটতে থাকা পাশের লোকটি কে? বড়লোকের মেয়েগুলির মত উচু হিল পরে কোমর দুলিয়ে হাটতে পেরে সে যেমন আনন্দিত তেমনই শংকিত সাথের লোকটিকে লোকটিকে নিয়ে। এই আনন্দময় ঘোরাঘুরির পেছনে সানগ্লাস পরা লোকটির ভূমিকা আছে তা নিশ্চিত হলেও মোয়াজ্জেম তরফদার যে আবার কিনা স্বপ্নের মৌসুমি সে শংকিত এই ভেবে যে, লোকটি তার কাছে কি চায়?এরকম উদ্বট স্বপ্ন মানুষ কখনোই দেখে না তা নয়। মাথা বিক্ষিপ্ত থাকলে বা পেট গরম হলে এরকম স্বপ্ন আকছার দেখে । তবে পরপর দু’রাত একই স্বপ্ন যদি ধারাবহিক নাটকের মত দেখা হয় তাহলে দূঃশ্চিন্তা না করে পারা যায় না।

মৌসুমি নামের একটি চরিত্র আমাদের সামনে হাজির হয়েছে, বেশ শক্তিশালী ভাবেই। সুতরাং তার একটু খোজখবর করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। তরফদার যদিও জানে না, মৌসুমির আসল নাম মৌসুমি নয় রোজিনা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দুইটা নামই দু’জন নায়িকার। নায়িকার নাম হলেও রোজিনা শব্দটি যতটা প্রোলেতারিয়েতিয় মনে হয়, মৌসুমি ততটা নয়। যদিও আমার মনে পড়ে, নায়িকা রোজিনা তার সময়ে যথেষ্ট লাস্যময়ী এবং স্মার্ট ছিলেন। এমনকি বলিউডি নায়ক মিঠুন চক্রবর্তী বাংলাদেশে ছবি করতে এসে তার ছবির নায়িকা হিসেবে রোজিনাকেই পছন্দ করেছিলেন। এতকিছু স্বত্বেও মানতে বাধ্য, মৌসুমি নাম যে লাস্যময়তা ধারণ করে রোজিনা তা করে না। রোজিনার মৌসুমি রূপান্তর অবান্তর ছিল না মোটেও। এক হাজার টাকার হেলপার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও নিজের কর্মদতার জোরে মৌসুমর আয় এখন চার হাজার টাকার উপরে। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাধারণ সাজসজ্জা, মাথার ওপর একস্তুপ রুক্ষ্ম চুল নিয়েও তার সৌন্দর্য এতটাই প্লাবন তুলতে পারে যে আশেপাশের অনেক কিছুকেই খড়কুটোর মত ভাসতে দেখা যায়। অন্যরাতো বটেই মৌসুমি নিজেও তা দেখতে পায়। তার সম্পর্কে আরো অনেক কিছুই বলা যায়। অন্য আর দশটা গার্মেন্টস কর্মীর মত তারও গড়পড়তা একটা করুণ ইতিহাস হয়তো আছে। তের চৌদ্দ বছর বয়স থেকে এই চব্বিশ বছর পর্যন্ত ’আপনা মাঁসে হরিনা বৈরী’ কাল কাঁটাতে তাকে অনেক ঝড়ঝাপটা নিশ্চয়ই পোহাতে হয়েছে। সেসব খোঁজে আমরা যাব না। এই গল্পে এত তথ্যের দরকার পড়বে না।

মোয়াজ্জেম তরফদার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিল এবং ওখানেই গোলমালটা লাগে। এ আর নতুন কি! বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই গোলমালের জায়গা। বেতন-ফি বাড়লে গোলমাল, জরুরী অবস্থা ডাকলে গোলমাল, কলকারখানা বন্ধ হলে এমনকি চালের দাম বাড়লেও গোলমাল। ভরসার কথা, রাস্ট্রপরে সুনিপুণ তত্বাবধানে সে গোলমাল দিন দিন কমে আসছে। তরফদারের বিবর্তনের ইতিহাসে সে ছোয়া পাওয়া যায়। ছাত্রাবস্থায় তরফদার সেসব গোলমালে ভালমতই জড়িয়ে পড়েছিল, অর্থাৎ বামপন্থী রাজনীতিতে যুক্ত হল। এবং আশৈশব তার যে স্বপ্ন (খোয়াব নয়) বড়লোক হব, তা কয়েক বছরের জন্য বিস্মৃত হল। তাতে ক্ষতি বিশেষ হয় নাই। চৌকষ, ত্যাগী, তরুন বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি খেতাবে যে সে ভূষিত হল তার ক্ষেত্র তো এটাই। ছাত্রত্ব শেষ হলেও রাজনীতির ডামাডোল তাকে ছাড়ল না। ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত হয়ে তার দক্ষতা ও সাংগঠনিক ক্ষমতার নানামুখী পরিষ্ফুটন ঘটল। অল্পদিনের মধ্যেই বিকাশমান গার্মেন্টস শ্রমিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে দাড়াল মোয়াজ্জেম হোসেন তরফদার। বিচ্ছিন্ন, বিশৃংখল ও লবিহীন আন্দোলন গুলিকে একসুতোয় গাঁথাকেই সে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিল। বছর তিনেক আগে নূন্যতম তিন হাজার টাকা মজুরীর দাবীতে ব্যাপক সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে উঠল। লাখো শ্রমিক মাঠে নেমে এলেও আন্দোলন ছিল সুশৃংখল। কোন জ্বালাও পোড়াও বা ভাংচুর হল না। ফলে আন্দোলন দমন করাও সহজ হল না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, আন্দোলনের সফলতা সময়ের ব্যাপার। তরফদারের সাথে আলোচনায় বসলেন বিজেএমই নেতারা। মালিকপক্ষ তেমন কোন ভূমিকা ছাড়াই বিশ লাখ টাকার ক্যাশ এবং তিরিশ লাখ টাকা প্রতিশ্র“তির প্যাকেজ অফার করল। যেহেতু সময় ছিল খুবই কম ' কম দামে বিক্রি হয়ে যাচ্ছি কিনা' এ ছাড়া অন্য কোন কিছু ভাবার অবকাশ পাওয়া গেল না। বাকীটা সময় কৌশলগত শলাপরামর্শ করতেই পার হয়ে গেল। রক্তচক্ষু নিয়ে টলতে টলতে মিটিং থেকে বেরিয়ে এসে মোয়াজ্জেম তরফদার ঘোষণা দিল, কুত্তার বাচ্চা মালিক শ্রেণী তাদের দাবী মানবে না। অতএব সোজা আঙ্গুলে কাজ হবে না, আঙ্গুল বাঁকা করতে হবে। কারখানায় জ্বালাও-পোড়াও এর আহবান জানিয়ে দিল তরফদার। মূহুর্তেই আগুন ছড়িয়ে গেল চারিদিকে। শ্যাওড়াপাড়া, তেজগা, টঙ্গী রণত্রে হয়ে গেল। সাভারে যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরানো হলে মারা গেল বেশ কয়েকজন সাধারণ যাত্রী। যদিও সাভারের গার্মেন্টস শ্রমিকেরা কেউই সনাক্ত করতে পারল না, তাদের মধ্যে কারা এ ঘটনা ঘটাল। আইন শৃংখলা রাকারী বাহিনীসহ রাস্ট্রের সব ধরণের সংস্থাই নৈরাজ্য দমনে সর্বাত্মক ঝাপিয়ে পড়ল। রপ্তানীমুখী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই খাত রা করতে এবং দেশ ও জাতিকে নৈরাজ্যের হাত থেকে বাঁচাতে পত্রপত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা হল, বুদ্ধিজীবীরা সেমিনার করলেন এবং সচেতন নাগরিকরা গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে মানববন্ধন করলেন। দুদিনের মধ্যেই আন্দোলন এমনভাবে দমন হল, মৃত সাত গার্মেন্টস শ্রমিকের লাশ নেয়ার জন্য মর্গে আসার মত কেউ থাকল না। এর মধ্যে উচ্ছেদ হতে বাকী থাকা বস্তিগুলি উচ্ছেদ করা হল, কারণ ঐ বস্তিগুলিই উচ্ছৃংখল শ্রমিকদের আস্তানা। মোয়াজ্জেম তরফদার গ্রেপ্তার হল এবং দশদিনের মধ্যেই ছাড়া পেল। 'অতঃপর গার্মেন্টস শ্রমিকেরা ১১৬০ টাকা বেতন পাইয়া ৩৬ টাকা কেজি দরে মোটা চাল কিনিয়া খাইয়া সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল।'

যে রাজনৈতিক দলের সাথে তরফদার যুক্ত ছিল তারা তাকে হটকারী বলে সমালোচনা করলে সেও পার্টিকে আপোষকামী আখ্যা দিয়ে পার্টি ছাড়ল। ব্যর্থ শ্রমিক আন্দোলনের দায়ভার কাঁধে নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতিতেও ইস্তফা দিল। বছরখানেকের মধ্যেই গোটা দুই গার্মেন্টস ইন্ডাষ্ট্রি ও একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার মালিক হয়ে গেল সে। ষড়যন্ত্র করে তাকে শ্রমিক রাজনীতিতে থাকতে দেয়া হয় নাই, সে বিজ্ঞাপনও যথেষ্ট বাজার পেল। নিজের বিজ্ঞাপনী সংস্থা থাকলে এ আর এমন কঠিন কি?

'ডিক্লাসিফিকেশন অব সেক্সুয়ালিটি' বলে একটি ধারণা তরফদারের বন্ধু মহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সম্প্রতি। আনিসুল ও জাফর নামে তার দুই বন্ধু এ ধারণার প্রবর্তক। ধারণাটিকে একটি সমস্যা বা লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ঘরের সুন্দরী বউ বা উচ্চমূল্যে কেনা উচ্চ শ্রেণীর নারী (কলগার্ল)- মোটা দাগে নিজেদের শ্রেণীতে যৌনচর্চায় চরম অনীহা এ লণের প্রথম ধাপ। লণের দ্বিতীয় ধাপেও একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য সবার ক্ষেত্রে অভিন্ন হচ্ছে; অপুষ্টিজনিত রোগাপটকা গার্মেন্টসের মেয়েগুলির প্রতি আগ্রহ। ভাল করে খেতে না পেয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মেয়েটি, যার হাত পা গুলি লম্বা লম্বা কাঠির মত, খালি পায়ে নির্জীব হাটার সময় পেছন থেকে যাকে কোনভাবেই যুবতী নারী হিসেবে সনাক্ত করা যায় না- এরকম একটি মেয়েই হয়ে উটছে যৌন উত্তেজনার আধার। বাংলায় একে কি বলা যায়? শ্রেণীচ্যুত যৌন প্রেষণা? বৃহস্পতিবারের সাপ্তাহিক মুক্ত পানোৎসবে এ প্রসঙ্গ উঠলে তরফদার চোখ বন্ধ করে নিজেকে ঝালাই করে নেয়। নাহ, তার মধ্যে এ লক্ষণ ওঠে না। রোগাপটকা মেয়েগুলির প্রতি তার কোনরকম আকর্ষণই বোধ হয় না। তবে মৌসুমির মুখটি মনে পড়ে। চুড়ো করে বাধা রুক্ষ্ম চুলের নিচে ও লাল টেট্রনের জামার ফাক দিয়ে বেরিয়ে থাকা ঘাড় ও পিঠের খোলা অংশটুকু চোখে ভাসে। স্বপ্নে নয়, বাসতবে কোন একদিন এই দৃশ্যের টুকরোটি তার স্মৃতিতে গাঁথা হয়েছিল। মৌসুমির শরীরটা ঠিক অন্যান্য গার্মেন্টস কর্মীদের মত অপুষ্টি আক্রান্ত নয়। এদিন রাতেই পুরোনো ধারাবহিক স্বপ্নটির আরেক পর্ব দেখতে পায়। মোয়াজ্জেম তরফদার নয়, সে গামর্ন্টেস কর্মী মৌসুমি। বাতরোগী মাকে নিয়ে চরম দূঃশ্চিন্তা করতে করতেই গুলশান এলাকার কোন এক অভিজাত রেস্টুরেন্টে খাচ্ছে সে। স্বপ্নের ধরণে তেমন কোন পরিবর্তন না হলেও একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে। তরফদার অর্থাৎ স্বপ্নে মৌসুমি এদিন তার সাথে সানগ্লাস পরা লোকটিকে চিনতে পারে। এ লোকটির নাম মোয়াজ্জেম তরফদার, সে যে গার্মেন্টসে কাজ করে এ লোকটি তার মালিক। এরপরের ঘটনা প্রবাহ তরতর করে এগাতে থাকে। তার বিস্তারিত চিত্রনাট্য মোয়াজ্জেম তরফদারের স্বপ্নেই রচিত হয়েছিল। বসুন্ধরা শপিং মল থেকে গুলশানের রেস্তোরা সবখানেই সে চিত্রনাট্যেও বাস্তব মঞ্চায়ণ ঘটে। এখন আমরা একলাফে চলে যাব কাইমেক্সের দিকে। স্থান- উত্তরা পাঁচ নম্বর সেক্টরে তরফদারের একটি ফ্যাট। সময় বিকেল চারটা। বাইরে লাঞ্চ সেরে এখানেই এসেছে তরফদার ও মৌসুমি। যে পটভুমি রচিত হতে এত ঘটনা ঘটল, সেদিকেই যাচ্ছিল তারা। বলা উচিত, তরফদার যাচ্ছিল ও মৌসুমিকে যেতে হচ্ছিল। যে কোন কাজই নিশ্ছিদ্র ও ঝামেলামুক্ত রাখার পূর্বাপর অভ্যেসমত এবং বাহুলগ্না মৌসুমির ভতিসন্ত্রস্ত্র ভাব কাঁটাতে তরফদার তাকে জানাল, তাদেও আসন্ন মিলনের পর্বটিকে নিরাপদ ও ঝুকিমুক্ত করার যথাযথ প্রস্তুতি আছে, অতএব দূঃশ্চিন্তা না করে সে সহজ হতে পারে। এই অতিরিক্ত দ্বায়িত্বশীল মনোভাব কোন কাজে না এসে বরং হীতে বিপরীত হল। একটা ঘটনা ঘটে যাওয়া এবং বলে কয়ে ঘটানো- এ দুয়ের মধ্যকার মাত্রাগত তারতম্যের ফ্যাক্টরে মৌসুমি তরফদারের শরীর থেকে ছিটকে গিয়ে নিরাপদে অবস্থান নিয়ে দাবী জানাল, এখনই সে এখান থেকে কের হয়ে যেতে চায়। এ দাবী মানা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। এ ফ্যাটে তরফদার ঢুকেছে লুকিয়ে, বেরোতেও হবে রাত ন’টার পরে লুকিয়ে। তার বউ নাহিদার শুভানুধ্যায়ী নেই এরকম জায়গা ঢাকা শহরে বিরল। এত তুচ্ছ ব্যাপারে পারিবারিক শান্তি নষ্ট করতে চায় না সে। আরেকটি কারণ, এক মাসের এই প্রকল্পে এর মধ্যেই তরফদারের ষাট হাজার টাকা খসে গেছে। 'মাথা ঠান্ডা রেখে যথেষ্ট ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হবে' মনে মনে ভাবল সে। কিন্তু হঠাৎ করে গোয়ার বনে যাওয়া মৌসুমি ধৈর্য্য পরীক্ষর কোন অবকাশই দিল না। ধস্তাধস্তি, আচড়-কামড়, চিৎকার-চেচামেচি করে একটা শোরগোল তুলে দিল। ভীত তরফদার তার মুখ চেপে ধরলে সে লাথি মেরে গোটা দুই পটারি ও আস্ত একটা টেবিল ল্যাম্প গুড়িয়ে দিল। বিকট শব্দে কেঁপে উঠল বাড়িটা। আর কোন উপায় ছিল না, নির্বোধ মেয়েটিকে বিছানার ওপর শুইয়ে ফেলে বালিশ চাপা দেয়া ছাড়া। ঠিক খুণী প্রকৃতির লোক যাকে বলে তরফদার তা নয় কিন্তু মৌসুমি তার হাতে খুন হয়ে গেল।

শুরুতেই তরফদারের ভাবনায় টলস্টয়ের একটি গল্পের প্রসঙ্গ পাড়া হয়েছিল। এখন অন্তত গল্পটি না বললে রাস্তার ঐ ক্যানভাসারের মত কাজ হয় যে বিশেষ এক পাতার নাম শোনাবে বলে লোক জড়ো করে তাবিজ বেঁচে কিন্তু পাতার নাম আর বলে না। যদিও চুড়ান্ত বিচারে গল্প কথক আর ক্যানভাসারের ফারাক খুব কমই আছে। গল্পটি বলছি-

আসিরিয়ার রাজা এসারহাদ্দন পাশের দেশে রাজা লাইলীর রাজ্য অভিযান করে দখল করে নিল। শহর-নগর সব পুড়িয়ে দিলো, অর্ধেক মানুষ মেরে ফেলে বাকী অর্ধেককে দাস হিসেবে তার রাজ্যে নিয়ে এল। সেনাদের কাউকে শুলে চড়াল, কারো বা জ্যান্ত চামড়া ছুলে নিল। স্ত্রী-পূত্র-কন্যাকে হত্যা করে স্বয়ং রাজা লাইলীকে খাচায় পুরে রেখে দিল। রাতে শুয়ে রাজা এসারহাদ্দন ভাবছিল কিভাবে লাইলীকে হত্যা করা হবে তা নিয়ে। এমন সময় বিছানার পাশে খসখস শব্দ শুনে পাশ ফিরে দেখল পাকা দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ তার দিকে তাকিয়ে আছে। ’কি , নিজের মৃত্যুর পরিকল্পনা করছ?’বৃদ্ধ জানতে চাইল। তা হবে কেন? প্রতিবাদ জানিয়ে বলল এসার হাদ্দন। ’আমি লাইলীকে মারার পরিকল্পনা করছি। ’তুমিইতো লাইলী, বলল বুড়ো। ’পার্থক্য হচ্ছে যে তুমি ভাবছ তুমি লাইলী নও।’ এ বলে বুড়ো তাকে শহরের প্রান্তে এক জলাশয়ের কাছে নিয়ে গেল। বুড়োর কথামত এসারহাদ্দন জামাকাপড় খুলে ঐ জলাশয়ে ডুব দিল। ডুবেই সে ল করল, সে বিছানায় শুয়ে আছে, তার পাশে এক সুন্দরী নারী। নারী তাকে বলল, উঠুন মহামান্য লাইলী। রাজপূত্র এবং সেনাপতি রাজসভায় অপো করছেন। রাজসভায় গিয়ে সংবাদ পেল, প্রবল প্ররাক্রমশালী রাজা এসারহাদ্দন তার দেশের দিকে সৈন্য অভিযান পরিচালনা করেছেন। রাজপূত্ররা ও সেনাপতি রাজ্য রক্ষার অনুমতি নিয়ে চলে গেলেন। সবাই উদ্বিগ্ন, কিন্তু বিনা বাঁধায় তো রাজ্য ছেড়ে দেয়া চলে না। ভার কাঁটাতে রাজা শিকারে গিয়ে কয়েকটি হরিন শাবক মারলেন। ফিরে এসে তিনে নিজেও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেও লাইলী রাজ্যরক্ষা করতে পারলেন না। তার সামনে তার স্ত্রী-পূত্র-কন্যাদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হল। সাজানো রাজ্য ছারখার করে দিয়ে তাকে একটি খাচায় বন্দী করে রওনা হল এসারহাদ্দনের বাহিনী।রাজা লাইলী , যে কিনা প্রাক্তন রাজা এসারহাদ্দন নিস্ফল ক্রোধে খাচায় বন্দী হয়ে গজরাতে লাগল, কিন্তু কিছুই করার ছিল না। একদিন তাকে শুলে চড়ানোর প্রস্তুতি নেয়া হল। তিনি চিৎকার করে বলতে চাইলেন, না, আমিই এসারহাদ্দন। কিন্তু তার কথায় কেউ কর্নপাত করল না। হঠাৎ করে তার মনে হল, তিনি একটি ক্ষুদ্র হরিন শাবক যাকে ঘিরে রয়েছে শিকারীরা, সামনে ঘনিয়ে আসছে অনিবার্য মৃত্যু................

মোয়াজ্জেম তরফদার চব্বিশ বছর বয়সী তরুণীর মুতদেহে নিজেকে আবিস্কার করে টের পেলেন, ঘরে অপেক্ষা করছে বাতরোগী মা যার সাথে আর কোনদিনই দেখা হবে না। দেখা হবে না লাজুক চেহারার সুপারভাইজার সেলিমের সাথে যে সাহস করে ভালবাসার কথাটা বলতে পারল না। সানগ্লাস পরা অচেনা এক লোক কার সাথে যেন শলা পরামর্র্শ করছে, লাশটি টুকরো টুকরো করে কয়েক জায়গায় পুতে ফেলতে হবে। চাপাতি হাতে এগিয়ে আসছে কেউ একজন। লোকটিকে চেনা যাচ্ছে তো। এতো তারই বিশ্বস্ত ইদ্রিস আলী। ইদ্রিস তাকে টুকরো করবে? ভয় নয়, আতঙ্ক নয়; বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু মৃত তো আর কাঁদতে পারে না!






সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ বিকাল ৫:০৩
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কৃষ্ণচূড়া আড্ডার কথা

লিখেছেন নীলসাধু, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:০২



গতকাল পূর্ব নির্ধারিত কৃষ্ণচূড়ায় আড্ডায় মিলিত হয়েছিলাম আমরা।
বছরের একটি দিন আমরা গ্রীষ্মের এই ফুলটির প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে প্রকৃতির সাথে থাকি। শিশুদের নিয়ে গাছগাছালি দেখা, ফুল লতা পাতা চেনাসহ-... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×