হাই স্কুলের কমপ্লেক্স বাক্যরচনার একটা উদাহরণ ছিল এই রকম। বাক্য রচনার সূত্র হলো : প্রথমে নো সুনার, ক্রিয়া : হ্যাড, জোড়া দেয়ার পর দ্যান দিয়ে শুরু। ডাক্তার আসতে আসতেই রোগী মারা গেল। শিক্ষক আসতে আসতেই ক্লাস আওয়ার শেষ হয়ে গেল। এই বাক্যগুলোও একইভাবে গঠন করা যায়।
ইদানিং বাক্য গঠনের এই রীতিটা খুব মনে পড়ে। হাই কোর্ট বনাম সুপ্রিম কোর্ট টম অ্যান্ড জেরি গেম দেখতে দেখতে প্রতিদিন খালি এই বাক্যটার কথাই আমার মনে পড়ে। হাই কোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের যে কোনো রায়ের পর একটা করে টক শো দেখে ঝাল মেটাই। সেইরকম কেউ বক্তা এলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য করার সীমাবদ্ধতা এবং কনটেমপ্ট অফ কোর্টের বিধান মনে রেখে যতটুকু বলেন ততোটুকুই আমরা শুনি। আকলমান্দ কে লিয়ে ইশারা হি কাফি। বুঝদার ব্যক্তি ইশারা করলেই কফি খেয়ে নেয়। ইশারা থেকে যতদূর বুঝি তার সার কথা হইলো :
১. সুপ্রিম কোর্ট হাই কোর্টকে তার যথাযথ সম্মানজনক স্থানে সবসময় স্থান দিচ্ছে না।
২. সুপ্রিম কোর্ট স্বাধীনভাবে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না।
৩. কোর্টের বাইরে কোনো কোনো বিচারপতি সরকারি কর্মসূচিতে এমনভাবে সন্তোষ ব্যক্ত করছেন যে তা অনেককে বিস্মিত করছে।
আর অধিক কিছু বলা ঠিক হইবে না। অবশ্য ইতিমধ্যে বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে গেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কোনো নজির এ পর্যন্ত জাতি দেখে নাই। কিন্তু স্বাধীন হওয়াটা দেখেছে। দুই দুইটা পাথরে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা লিখে পর্দা সরানো হয়েছে। আমি নিজে লাইভ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। বাংলাদেশের জন্য এর বেশি স্বাধীনতা হয়তো দরকার নাই। বাংলাদেশের নিম্ন আদালতের জন্য চোখে দেখা স্বাধীনতাই কাফি।
অনেকে বলেন, এ রকম একটা পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগ কী-ই বা করতে পারে? অনেকে বলেন, তারাও তো বাংলাদেশেরই একটা প্রতিষ্ঠান। কেউ কেউ বলেন, বিচার বিভাগ রায়ের ব্যাপারে মোর ক্রিয়েটিভ হইতে পারে। ক্রিয়েটিভ হইতে গিয়া পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি হউক সেইটাও হয়তো আমরা চাই না। কিন্তু টম অ্যান্ড জেরি খেলাটা ক্রিয়েটিভলি হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে না চইলা সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে চললে জনগণের আস্থা আরও বেশি অক্ষুণ্ন থাকতো। বাংলাদেশের সংকটে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সেরাম ক্রিয়েটিভ কখনো হইছিল বইলা আমাদের জানা নাই। জিয়া ও এরশাদের সামরিক শাসন আসার পর কোনো বিচারপতি মৃদু প্রতিবাদের কথাও শোনা যায় না। বরং তারা এ যাবত খুশী মনেই মার্শাল ল' অ্যাডমিনেস্ট্রেটরদের শপথ করিয়েছেন।
গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় যে কোনো ব্যাপারে তাদের ক্রিয়েটিভির কোনো নজির আমরা দেখি নাই। যে সব ব্যাপারে তারা সিদ্ধান্ত দিলে জাতি বাঁচতো, সে সব ব্যাপারে তারা কার্যত নিরবই থেকেছেন। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছিল। সেই রিটের ভাগ্যে স্টে জুটেছে। বিচারপতি আজিজ এক সময় টু বি অর নট টু বি'র নির্বাচনে কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন। তার দুইটি সাংবিধানিক পদে থাকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট হয়েছিল। সীতার ধ্যানে অজ্ঞান এই বিচারপিতির দুই পদে থাকা অবৈধ হয় যখন তখন রায় ঘোষণার তাত্ত্বিক গুরুত্ব ছাড়া আর কোনো গুরুত্বই নেই। সে রামও নেই সে অযোধ্যাও নেই। যে কোনো গুরুতর সাংবিধানিক বিষয়ে আমাদের কোর্টের এর বেশি ভূমিকা কেউ দেখে থাকলে আওয়াজ দিয়েন।
এখন সুপ্রিম কোর্ট ও হাই কোর্টের মধ্যে যে জাজমেন্ট ও স্টে'র ব্যাপার চলছে তা নিয়ে জাতির হতাশ হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নাই। এই টম অ্যান্ড জেরি গেমের মধ্যেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা আজম জে চৌধুরীর মামলা অবৈধ ঘোষণা করলো হাই কোর্ট। এই মামলা নিয়ে আগামী কাল বা পরশু একই রকম একটি কমপ্লেক্স বাক্য গঠিত হবে কি না আমরা জানি না, এখনও। সুপ্রিম কোর্ট এ রায় স্থগিত, বাতিল যাই করুক, সকলের চোখ এখন তাদের দিকে। এ রায়ের ওপর সরকারের দুর্নীতি বিরোধী গর্জনের বর্ষণ নির্ভর করছে। খালেদা-হাসিনার ভবিষ্যতও নির্ভর করছে। হাই কোর্ট যেভাবে রায় দিয়েছে, তাতে সাম্প্রতিক সময়ের স্মরণীয় এ রায়টির দিকে সবার দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এখন সুপ্রিম কোর্টের অপেক্ষায় জাতি। তারা কি ক্রিয়েটিভ হবে? নাকি স্কুলে শেখা সেই পুরানা বাক্যটাই আবার আওড়াতে হবে?