somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি স্বপ্ন খুনের গল্প : প্রথম পর্ব - স্বপ্নের শুরু (মিরাজ)

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ সন্ধ্যা ৭:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(রাজনীতি বিমুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং আরো দুএকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ তরুণী একটা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিল । সেই তরুণ তরুণীদের অংশ হিসাবে কয়েকটি পর্বে তুলে ধরার চেষ্টা করব তাদের স্বপ্ন খুনের সত্য ঘটনা )

১৯৯৬ সাল । ঢাকার ধানমন্ডির আহসানিয়া মিশন এর ভবনের নীচতলায় দিন রাত খাবার স্যালাইন বানানোর কাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একদল তরুণ তরুণী । প্রায় সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, কয়েকজন আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের । অধিকাংশই পূর্ব পরিচিত আবার অনেকের সাথেই পরিচয় হচ্ছে কাজ করতে করতে । তিন দিন টানা কাজ করে ১ লক্ষ ২০ হাজার প‌্যাকেট খাবার স্যালাইন তৈরী হলো । আহসানিয়া মিশন এই খাবার স্যালাইনগুলো পৌছে দেবে দেশের বন্যা দূর্গত বিভিন্ন অন্চলে ।

বিশ্ববিদ্যালয়েরর ধরা বাঁধা ক্লাস বাদ দিয়ে যেই সব তরুণ তরুণী এই কাজ গুলি করলো তাদের মাঝে এই কাজটি একটা ভিন্ন অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করলো । তারা ভাবতে শুরু করলো আরো কিছু করা যায় কিনা? প্রায় সবাই পূর্ব-পরিচিত (বন্ধু কিংবা একই বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী) থাকায় নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনাও চলতে লাগলো । তারপর একদিন আবার তারা সবাই বসলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স লাইব্রেরীর পেছনে । ঠিক হলো সবাই মিলে দেশের মানুষের জন্য, মানবতার জন্য, সমাজের সুবিধা বন্চিত মানুষের জন্য সবাই একসাথে থাকবে, একটি সংগঠন করবে । নাম খুজে না পাওয়ায় সাময়িক ভাবে নাম ঠিক হলো "ষ্টুডেন্টস ফোরাম" । ষ্টুডেন্টস ফোরাম এর আহবায়ক হলাম আমি ।

কাজ শুরু
ষ্টুডেন্টস ফোরাম এর সদস্যদের মনে অনেক কিছু করে ফেলার চিন্তা । কিন্তু কি দিয়ে শুরু করবে সেটা নিয়ে কিছুটা দ্বিধান্বিত । তখন ঢাকায় শীত পড়তে শুরু করেছে । ঠিক হলো প্রথম কাজ হবে রাস্তায় শুয়ে থাকা মানুষ যারা শীতের মধ্যেও গায়ে একটু কাপড় (গরম কাপড়তো দুরের কথা) দিতে পারছেনা তাদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হবে । ব্যস লেগে পড়লো সবাই । শুরু হলো পুরাতন কাপড় এবং শীতের কাপড় সংগ্রহের পালা। স্টুডেন্টস ফোরাম এর সদস্য তখন প্রায় ২০ জন তাদের মধ্যে ১৩-১৪ জনই মেয়ে । যে দিন সবার কাপড় নিয়ে আসার কথা সেদিন দেখা গেল মেয়েদের সবার হাতে দুই তিন পলিথিন (তখনও পলিথিনের প্রচলন ছিল) ব্যাগ ভর্তি কাপড় আর অধিকাংশ ছেলেরাই বীরের (!) মত খালি হাতে । দেখা গেল সদস্য আর ক্লাসের বন্ধুদের কাছ থেকে যে পরিমাণে কাপড় উঠেছে তা বিতরণের জন্য যথেষ্ট নয় । শুরু হলো বিকল্প চিন্তা ।

ঠিক হলো ষ্টুডেন্টস ফোরাম এর সদস্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোয়ার্টার আর আজিমপুর কলোনীর অফিসার্স কোয়ার্টার থেকে পুরনো শীতের কাপড় তোলার একটা চেষ্টা করবে । তিনটা টিম করা হলো, প্রতিটি টিমে কমপক্ষে দুজন মেয়ে রাখা হলো, কারন মেয়েরা সাথে থাকলে নাকি কাপড় পাবার সম্ভাবনা বেশী এবং প্রতারক (তখন নাকি এরকমভাবে অনেকে কাপড় তুলে বিক্রি করতো) ভাবার সম্ভাবনা কম । য ভাবা সেই কাজ । প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের পড়ে শুরু হয় কাপড় সংগ্রহ অভিযান । এক সপ্তাহ পর পর্যালোচনায় বসলাম । সংগ্রহের পরিমাণ যথারীতি হতাশাজনক এবং সেই সাথে অনেক বিব্রতকর অভিজ্ঞতা । বেশ কয়েকটি বাসায় দরজাই খোলা হয়নি, আমাদেরকে কয়েক জায়গায় "মাফ" করতে বলা হলো ঠিক একেবারে যেভাবে ভিক্ষুকদের মাফ করতে বলা হয় ।

ওই সময়টাতে সবার মনোবল ঠিক রাখাটাই ছিলো একটা প্রধান চ্যালেন্জ । পরিচিত বিভিন্ন জায়গা থেকে আরো বেশ কিছু গরম কাপড় সংগৃহীত হলো। এরপর শুরু হলো কাপড় বাছাই - বিভিন্ন সাইজ, বয়স এবং ছেলে মেয়ে এইভাবে আলাদা করা । দেখা গেলো নিজেদের উদ্যোগে আনা কাপড়গুলি ছাড়া সংগ্রহ করা কাপড়গুলির অবস্থা খুব করুণ । অধিকাংশ কাপড়ই ছেড়া, বেশ কিছু পুরোপুরিই পড়ার অযোগ্য । সমাজের সবচাইতে উচু শ্রেণীর কিছু মানুষের অমানবিকতায় অবাকই হলাম আমরা । যা হোক সব বাছাই এর পর দেখা গেল প্রায় এক হাজার পিস মোটামুটি দেবার মত কাপড় পাওয়া গেছে । এরপর আসল এগুলি বিতরণের পালা । ঠিক হলো রাত্র ১২টার পর আমরা বের হবো, রাস্তায় শুয়ে থাকা যেসব মানুষের কাপড় প্রয়োজন মনে করবো, তাদেরকে বেছে বেছে দেবো । যেহেতু রাত ১২ টার পর বের হবো তাই মেয়েদের যাওয়া চলবেনা । তীব্র আপত্তি আসল মেয়েদের কাছ থেকে কারন কাপড় সংগ্রহে ওরাই ছিল অগ্রণী । কয়েকজন গার্জিয়ান সাথে নিয়ে ১২টার পরে থাকার অনুমতিও আদায় করে ফেলল । কিন্তু আমরা রাজি হলামনা, মেয়েরা এত রাতে সাথে থাকলে আমাদের কাপড় দেয়াটাই কঠিন হয়ে যাবে । তখনো জানতামনা কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য এবং কত সঠিক একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ।

নির্দিষ্ট রাতে আমরা আটটি রিকশা ভাড়া করলাম । প্রতিটি রিকশাতে দুজন করে আর প্রতিটি রিকশাতে বড় কালো পলিথিন (সাধারণ সাইজের চার-পাচগুণ বড়) ভর্তি কাপড়। ঠিক করা হলো কোন রিকশা কোন রুটে যাবে এবং কিভাবে কাপড় দেওয়া হবে । কাপড় দেওয়া শেষে রাত ২টার সময় আমাদের আবার এই জায়গায় ফিরে আসতে হবে । রাস্তায় নেমে শুরুটা কঠিন মনে হলোনা । বের হয়েই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে অনেকেই রাস্তায় শুয়ে আছে । একজন রিকশা থেকে কাপড় দিচ্ছে আর অপরজন বেছে বেছে লোকজনের কাছে দিচ্ছে । কিন্তু একটু পড়েই টের পেলাম আসল বিপদ । কিভাবে যেনো অনেক মানুষ টের পেয়ে গেলো যে আমরা কাপড় দিচ্ছি । হঠাত করেই দেখি রিকশার আশে পাশে ২০-২৫ জন ছিন্নমুল মানুষ এবং সবার লক্ষ্য একটা কাপড়। এর মাঝে কার আসলেই দরকার বোঝার উপায় নেই । কোন রকমে কিছু কাপড় অন্ধের মতো দিয়ে রিকশাআলাকে বললাম সামনে যেতে, উদ্দেশ্য সেগুনবাগিচার দিকে ঢুকবো । কিন্তু রিকশা এমনভাবে টেনে ধরা হয়েছে যে বেচারা রিকশাআলা রিকশা সামনে নিতে পারছেনা । কোনমতে সেখান থেকে বের হয়ে সেগুন বাগিচার দিকে ঢুকলাম । এবার রিকশা দুরে রেখে হাতে বিভিন্ন প্রকার কাপড় নিয়ে দেখে দেখে লোকজনকে ঘুম থেকে ডেকে ডেকে দিতে লাগলাম। এক বুড়ো চাচা, বয়স কমপক্ষে ৭০ হবে, পাতলা একটা গেন্জি গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন । তাকে যখন ডেকে হাতে একটা সোয়েটার ধরিয়ে দিতেই আমাদের দুজনকে অবাক করে কাদতে লাগলেন চাচা। সোয়েটারটি গায়ে দিয়ে তার কান্না আরো বেড়ে গেলো, ওই যে কান্না আমার পরবর্তী জীবনে যে কতবড় একটি প্রভাব ফেলবে, সেটা ওই মুহুর্তে বুঝতে পারিনি ।

কাপড় দেয়া শেষ করে নির্দিষ্ট সবার একত্র হবার জায়গায় ফিরে আসলাম আমরা । এসে দেখি আমরা বাদে সবাই এর মধ্যেই ফিরে এসেছে । দেখি মুখ কালো করে বসে আছে কয়েকজন । ওদের দেয়ার কাপড় দেবার দায়িত্ব ছিল কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে । গোমড়া মুখে ওরা জানালো ওদের সব কাপড় লুট হয়ে গেছে । দুই রিকশাতে চারজন ছিল ওরা, কাপড় দেওয়া শুরু করতেই, একদল লোক এসে সব কাপড় লুট করে নিয়ে গেছে ওরা ঠেকাতেতো পারেইনি বরং কোনমতে পালিয়ে এসেছে । কিন্তু এর বাইরে প্রায় সবার মুখ থেকেই জানা গেল আরো অনেক ঘটনা যার অধিকাংশই ভালো লাগার মতো । উদোম সন্তানের জন্য কাপড় পেয়ে মায়ের চোখে আনন্দাশ্রুর মতো অনেক ঘটনা ।

পরদিন যখন সবার সাথে শেয়ার করলাম রাতের ঘটনা তখন দেখলাম প্রায় সবার চোখের কোনেই চিকচিক করছে পানি । প্রথম উদ্যোগর অভিজ্ঞতা আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করলো সুবিধাবন্চিত মানুষদের জন্য আরো অনেক কিছু করার জন্য । শুরু হলো একটি সংগঠনের যাত্রা ।

২য় উদ্যোগ
আমাদের সাথে যেহেতু বেশ কিছু ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র - ছাত্রী ছিল । ওদের সাথে কথা বলে ঠিক করলাম আমরা এরপর বস্তিতে যাবো একটা মেডিকেল টিম নিয়ে । ওদের দায়িত্ব ডাক্তার যোগাড় করা । ওরা চারজন ইন্টার্ণি বড় ভাইকে রাজী করিয়ে ফেলল । আমি সাথে পেলাম একজন পরিচিত ডাক্তারকে যিনি আমাদেরকে একদিন সময় দিতে রাজী হলেন । ঠিক হলো আগারগাঁও বস্তিতে যাবো । যেহেতু সারা দিনের প্রোগ্রাম তাই ঠিক হলো একটা শুক্রবার যাবো যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের সমস্যা না হয় । নির্দিষ্ট তারিখের আগে আমরা দুজন বস্তিতে গেলাম বস্তিবাসীদের সাথে আলাপ করে একটা জায়গা ঠিক করার জন্য । ইউজিসির পাশে তখন বেশ বড় একটা বস্তি, সেখানে একটা আধাভাঙ্গা ক্লাব ঘরে ঠিক হলো আমাদের মেডিকেল টীমের বসার জায়গা ।

এবার যেহেতু দিনের বেলা যাচ্ছি তাই মেয়েদের কথা হলো তারা সবাই যাবে আর এর বাইরে দুয়েকজন ছেলে যেতে পারে সবকিছু ম্যানেজমেন্টে সুবিধার জন্য । তথাস্তু, আমরা মোট প্রায় ১৫ জন গেলাম (ডাক্তার বাদে) তার মধ্যে ১০জনই মেয়ে । শুরু হলো একটা লম্বা ক্লান্তিকর দিন ।

যেয়ে প্রথমেই বুঝলাম একটা বড়ো ভুল করেছি । আমরা সাথে ডাক্তার নিয়েছি কিন্তু কোনো ওষুধ নেইনি । আসলে ওষুধ কেনার সামর্থ্য ছিলোনা আমাদের । ক্লাবঘরের বাইরে লম্বা লাইন, ছেলে বুড়ো, মায়ের কোলে শিশু, মহিলা সবার লম্বা লাইন। ক্লাবঘরের মধ্যে ছোট একটা পার্টিশন দিয়ে একপাশে পুরুষদের আর অপর পাশে মহিলাদের দেখার ব্যবস্থা করা হলো । শুরু হলো বিরামহীন রোগী দেখা, সবার সমস্যা প্রায় একই রকম খোস পাচড়া, ডায়রিয়া, জ্বর, দুর্বলতা । আমাদের ডাক্তাররা তাদের বিনামুল্যে দেখছেন তাতেই তারা খুশী, সাথে ওষুধ নেই জেনে অনেকেই হতাশ হলেও দেখলাম বেশীর ভাগ লোকই ব্যাপরটিকে পজেটিভলিই নিচ্ছেন । তবে সাথে ওষুধ না থাকার অপরাধবোধ কুরে কুরে খেলো আমাদের, এই লোকগুলির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলাম এদের সিংহভাগেরই ওষুধ কেনার মত টাকা নেই ।

সকাল থেকে কোনো বিরতি ছাড়া সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রোগী দেখার পরও দেখরাম বাইরে অনেক বড় লাইন । এদিকে ডাক্তাররা সারা দিন না খাওয়াতে ক্লান্ত (খাবার ছিলো কিন্তু খাবার সময় ছিলোনা, কয়েক কামড় বিস্কুটই ভরসা) । বুঝলাম আর চালানো যাবেনা এখন বন্ধ করা দরকার । অনেক কষ্টে অপেক্ষমাণদের বুঝিয়ে পরের সপ্তাহে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলাম ।


আরো সংগঠিত হওয়া

পরপর দুটি প্রোগ্রাম আমাদের সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের করুণ অবস্থা সম্পর্কে আমাদের পরিস্কার ধারণা দিলো । আমরা বুঝতে পারলাম এতটা বিচ্ছিন্নভাবে বড় কিছু করা সম্ভব নয় । আমরা যখন এ নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম তখন টের পেলাম সবাই মোটামুটি ক্ষুদ্ধ, ক্ষুদ্ধ পিছিয়ে থাকা মানুষদের অবস্থা দেখে, ক্ষুদ্ধ তাদেরকে উপেক্ষা করা রাজনীতিবিদদের দেখে, আর সেই সাথে ক্ষুদ্ধ আমাদের অসহায়তা দেখে । তবে এই বোধটাই আমাদের সাহায্য করলো আরো সংগঠিত হতে । ঠিক করলাম আমরা পরামর্শ নেবো কিছু মানুষের, কিভাবে আমাদের এই চিন্তাগুলিকে কাজে লাগানো যায়? কিভাবে সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষের কাজে ছাত্রদের অংশগ্রহণকে আরো বাড়ানো যায়? এবং কিভাবে আরো কার্যকরভাবে এইসব পিছিয়ে পড়া মানুষদের আরো বেশী সাহায্য করা যায়? আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় কিভাবে এই কাজগুলি করার জন্য যে অর্থের দরকার সেই অর্থ যোগাড় করা যায়?

ঠিক হলো আমরা আমাদের চিন্তাভাবনাকে শেয়ার করবো আমাদের কিছু শিক্ষক এবং সমাজে আমাদের কিছু প্রিয় মানুষের সাথে । সবার মধ্যে সিনিয়র আমি আর আহবায়ক হিসাবে আমার দায়িত্বও বেশী । এতগুলি তরুণ তরুণীর স্বপ্ন সাথে নিয়ে শুরু হলো যোগাযোগ আর আলোচনা পর্ব । সব সদস্যের মধ্যে বিশেষ করে যারা সবচাইতে সক্রিয়ভাবে সামনে এগিয়ে আসলো তারা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের একদল উজ্জল ছাত্র-ছাত্রী । আমি এবং ষ্টুডেন্টস ফোরামের সাধারণ সম্পাদিকা যে প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলো সবার চিন্তাভাবনাকে একত্র করে আলাপ শুরু করলাম কিছু নির্বাচিত মানুষের সাথে ।

প্রথমে গেলাম ঢাকা কলেজ এবং বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সুবাদে পরিচয় থাকায় আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার এর কাছে । স্যার সব শুনলেন, উৎসাহ দিলেন, পরামর্শ দিলেন এবং সাথে থাকার কথা জানালেন । স্যারকে সাথে পেয়ে আমরা যে কি পরিমাণে অনুপ্রাণিত হলাম সেটা বোঝানো সম্ভব নয় ।

এরপর গেলাম অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ স্যারের কাছে । বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের দুএকটি প্রোগ্রামে আগেই যাবার কারণে স্যারের সাথে সামান্য পরিচয় ছিলো । আমাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং এই পর্যন্ত করা কাজের কথা শুনে স্যার বললেন সাথে আছি তবে তোমাদেরকে সক্রিয়ভাবে পরিবেশ আন্দোলনের সাথে থাকতে হবে । কেন পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন সমাজের সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমাদের বোঝালেন । আমাদের ভিতরে ঢুকলো পরিবেশ রক্ষায় সংকল্পবদ্ধ হবার বীজ । ষ্রার আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দিলেন পরিবেশ আন্দোলনের তখনকার সাধারণ সম্পাদক আবু নাসের খানের সাথে । শুরু হলো পরিবেশ আন্দোলনের সাথে দীর্ঘ পথযাত্রা ।

আমাদের যেহেতু একটা প্রধান চিন্তা ছিলো বস্তিতে নিয়মিত মেডিকেল টীম নিয়ে যাওয়া এবং প্রেসক্রিপশনের সাথে সাথে বিনামুল্যে ওষুধ দেওয়া । আমাদের সাথে যারা ফার্মেসীর ছিলাম সবাই ঠিক করলাম তখন আমাদের অনেকেরই প্রিয় শিক্ষক (কারণ স্যার ক্লাসে খুব ভালো পড়াতেন) চৌধুরী মাহমুদ হাসান স্যারের সাথে কথা বলবো। স্যার কিছুদিন আগেও ড্রাগ এ্যাডমিনিষ্ট্রেশনের পরিচালক ছিলেন এবং স্যারের সাথে ওষুধ কোম্পানীগুলির ভালো জানাশোনা । তাই স্যারের মাধ্যমে আমরা বিনামুল্যে বা স্বল্পমুল্যে ওষুধ নিতে পারবো । স্যার আমাদের সব কথা শুনলেন এবং কোম্পানী গুলি থেকে ওষুধ দেবার ব্যাপারে যথাসাধ্য সহায়তার আশ্বাস দিলেন । সেই সাথে আমাদের জানালেন ভেজাল আর নিম্নমানের ওষুধের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির কথা ।


আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম । নিজে বিতর্কের মানুষ ছিলাম আর স্যার ডিইউডিএস এর মডারেটর, তাই স্যার প্রিয় মানুষদের একজন । স্যারের দেখা পাওয়াটা কঠিন একটা ব্যাপার । স্যার সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট সময় অফিস খোলেন। সেই সময়ে স্যারের অফিস রুমের সামনে অপেক্ষায় থাকি । তারপর স্যারের সাথে কথা হলো পরপর কয়েকদিন । আমরা দুজন মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনি স্যারের বিভিন্ন চিন্তা, স্যারের সেই সময়ের কিছু কাজ । তৃতীয় বারের দেখার পর স্যারও বললেন আমাদের সাথে থাকার কথা ।

আমাদের সাথে থাকা প্রাণীবিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীরা মাহমুদুল আমীন স্যারকে (স্যার তখন বেচে ছিলেন) রাজী করালো আমাদের সাথে থাকবার ব্যাপারে । তখন ঢাকায় ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদূর্ভাব, স্যার ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে কাজ করছেন । তিনি আমাদের উদ্বুদ্ধ করলেন ডেঙ্গু নিয়ে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির ব্যাপারে ।

সবার কাছ থেকে এতটা সাড়া পাবো আমরা নিজেরাও আশা করিনি । কাজ করার জন্য আমাদের ধারণা পরিস্কার হলো, কি কি কাজ করা দরকার কিভাবে করা দরকার সেই দিকেও পরিস্কার ধারণা হলো। কিন্তু একটা সমস্যা থেকে গেলো । আর সেটা হলো সবচেয়ে বড় সমস্যা কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাবো কোথায়? যে কোনো কাজ করতে গেলেই টাকার দরকার । এই সময়ে সামনে এগিয়ে আসলেন আমাদেরই এক সদস্যের মা বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী ফরিদা পারভীন । মায়ের মতই তিনি বললেন "বেটা তোরা এত কাজ করবি বলে ঠিক করেছিস আর টাকার জন্য করতে পারবিনা? আমি তোদের জন্য গান গাইব । তোরা ফান্ড সংগ্রহের জন্য গানের প্রোগ্রাম কর, কোন টাকা দিতে হবেনা ।" তার এই একটি উক্তি আমাদের বুক থেকে একটা বড় পাথর সরিয়ে দিলো । এরপর এগিয়ে আসলো আমাদের দুই চিত্রকর সদস্য একজন চারুকলার আর একজন সয়েল সাইন্সের । ওরা বললো "মিরাজ ভাই, আমরা নিয়মিত ছবি আকবো আর সেই ছবি বিক্রি করেওতো কিছু টাকা পাওয়া যাবে" । আমি তখন দুইটি টিউশনি করি, বেশ ভালো টাকা পাই । ঠিক করলাম আরেকটি টিউশনি নেবো, এই টিউশনিটি হবে মানুষের জন্য ।

আমাদের টাকা নিয়ে চিন্তা দুর হলো । সবাই মিলে বসে ঠিক করলাম কি কি কাজ করবো, কিভাবে করবো, কিভাবে আরো বেশী ছাত্র-ছাত্রীকে আমাদের সাথে সম্পৃক্ত করবো । আমাদের চোখে তখন অনেকে স্বপ্ন, অনেক কিছু করে ফেলব আমরা । আমরা প্রাথমিকভাবে কাজের যে ক্ষেত্রগুলি ঠিক করলাম সেগুলি হলো -


- প্রতি সপ্তাহে (যেটি পরবর্তীতে মাসে হয়েছিল) বস্তিতে মেডিকেল টীম নিয়ে যাওয়া সাথে বিনামুল্যে ওষুধ দেওয়া
- প্রতি বছর শীতকালে কমপক্ষে দুইবার শীতবস্ত্র বিতরণ
- সবাইকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সব ছাত্র-ছাত্রীকে রক্তের গ্রুপিং জানানো
- তখন প্রথম আলো এসিড নিক্ষেপরে বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলো । আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এর অংশ হতে এবং এসিড নিক্ষেপের বিরুদ্ধে জনমত তৈরীতে কাজ করা ।
- পরিবেশ দূষনের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করা
- ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের ব্যপারে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা ।
- দেশের যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের পাশে দাড়ানো
- ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যকর ব্যবস্থা নেবার ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি
- যে কোন মানবতাবাদী প্রয়োজনে সমাজের মানুষের পাশে দাড়ানো ।

শুরু হলো একদল তরুণের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবার কাজ ।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ১১:৫০
৩৩টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×