শরীফ সাহেব পুরোদস্তুর একজন নিজের হাতে নিজেকে গড়া ব্যাক্তি। তাঁর শৈশব কেটেছে বাবার সাথে সাথে, এজেলায় ওজেলায় ঘুরে ঘুরে। বাবা ছোটখাট ব্যাবসা করে কোনভাবে সংসার চালাতেন, তবে কোন জায়গায়ই বেশীদিন টিকতে পারতেননা। একটা না একটা ঝামেলা বেঁধে যেতই। হাজার ঝামেলার পরও দুই ছেলেকে ভালোভাবে পড়াশোনা করানোর জন্য তিনি নিজের সাথেই তাদেরকে রাখতেন। আর মেয়েরা থাকত মায়ের সাথে গ্রামের বাড়ীতে। ছোটবেলা থেকেই শরীফ সাহেবের এই মা ছাড়া থাকাটা তাঁকে আলাদা একটা টিকে থাকার যোগ্যতা দিয়েছে। যেকোন বিষয়ে তিনি খুব সহজেই রিস্ক নিতে পারতেন। সেই মানসিকতাই তাঁকে আজ এত ভাল অর্থনৈতিক অবস্থানে এনেছে, তাঁর অন্যান্য বন্ধুদের সাথে একটা ব্যবধান তৈরী তে সহায়তা করেছে। অর্থের আগমনের সাথে সাথে শরীফ সাহেবের শ্রেনী পরিবর্তনও হয়েছে খুব দ্রুত; শ্রেনী পরিবর্তনের বেশ কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়েছে বলে পরিবর্তনের সাথে সাথে খাপ খাওয়াটা তিনি বেশ ভালোভাবেই শিখে গেছেন।
এতকিছুর পরেও কিছু সমস্যা থেকেই যায়; যতই খাপ খাওয়াক, মানুষের মনের গভীরে কিছু চিন্তা বা কিছু মানসিকতা এমনভাবে প্রোথিত হয়ে যায় যে সেটা কোনকিছুতেই পরিবর্তিত হয়না। শরীফ সাহেবের এমন একটা সমস্যা আছে, যেটা শুনলে হয়ত তাঁর আশপাশের সবাই তাঁকে প্রাচীনপন্থী ভাববে; এমনকি এই সোসাইটিতে চলার অযোগ্যও ভাবতে পারে। সেটা হলো সংসার নিয়ে তাঁর স্বপ্ন। শরীফ সাহেব সেই ছোটবেলা থেকেই যে সংসারের স্বপ্ন দেখতেন, তাতে তিনি দেখতে পেতেন আর দশজন সাধারন বাঙালীর মতোই এক সংসারের, যেখানে তিনি বিকেলে কাজ থেকে ফেরার পর স্ত্রী তাঁর যত্ন নিচ্ছেন, যেমন টেবিলে খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন, তাঁর পছন্দের খাবারগুলো মহাআগ্রহের সাথে বানাচ্ছেন, গোসলের পানি দিচ্ছেন, জামাকাপড়গুলো গুছিয়ে রাখছেন, আবার সকালে একদম মাড় দেয়া আর ইস্ত্রি করা কাপড় নিয়ে এগিয়ে আসছেন, বাচ্চাদের যত্ন নিচ্ছেন -- বলে শেষ করা যাবেনা। শরীফ সাহেবেরও এটা কল্পনাই, কাজেই, কল্পনার জগতে নিজের এক স্ত্রীকে তিনি কয়জন মানুষের কাজ করতে দেখছেন সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন তাঁর হয়নি। শুধু স্বপ্নটা দেখেই ভাল লেগেছে।
অথচ বিয়ের পর যখন তাঁর ও তাঁর স্ত্রী আসমার বন্ধুবান্ধবীদের একটা বলয় গড়ে উঠল, তিনি দেখলেন তাঁরা হলেন সেই আশির দশকের প্রথম ভাগের প্রগতিশীল বাঙালী সমাজ। এখানে স্ত্রীকে চাকরি করতে বাঁধা দেয়াটা অভব্যতা, সেটা নিয়ে কথা বলাটাও নিজের ছোটত্বকে প্রকাশ করারই একটা উপায়। সেখানে পুরোনো উপায়ে, অর্থাৎ স্বামী বাহিরে, স্ত্রী ঘরে -- এরকম উপায় মেনে সংসার করার চিন্তাও করা যেতনা। তাই মনের ভেতর যাই থাকুক, শরীফ সাহেবকে সমাজের সাথে তাল মেলাতে হলো। এই তাল মেলাতে গিয়ে একসময় তিনি যেটা দেখতে পেলেন তা হলো, যে স্বপ্নটা নিয়ে তিনি বড় হয়েছিলেন সেটা হয়ত কোনদিনই ফলবেনা। এক ধরনের অতৃপ্তি নিয়ে তাঁর দিন কাটতে লাগল। তখনই তাঁর জন্য খানিকটা শাপেবরের মতোই ছোট্ট তুষারের শারিরীক জটিলতা দেখ দিল, আসমা চাকুরী থেকে ছুটি নিলেন, সময়ের সাথে সাথে চাকুরীও ছেড়ে দিলেন। এরপরের বারো-চৌদ্দ বছর শরীফ সাহেব ভীষন সুখে ছিলেন। অথচ গত চার বছর ধরে তাঁর সেই সুখের আস্তানায় হামলা, আসমা নিজেই হামলাকারী। সত্যি বলতে কি এই বয়েসে এসে, সবকিছু গড়ে দিয়ে দেবার পর আসমার কাছ থেকে এমন ব্যবহার তাঁর মাঝে আসমার প্রতি বাড়তি কোন আকর্ষণ তো তৈরী করেইনি, বরং কিছু অবশিষ্ট থাকলে সেটাকেও সরিয়ে দিতে সাহায্য করেছে। তাঁর মনে হয়েছে, আসমা চলে যেতে চাইছে, সেখানে সবদোষ আসমার নিজেরই। তিনি যেতেও বলেননি, চাকুরীতেও বাঁধা দেননি। শুধু আসমা যখন বলেছে একটা ক্লিনিক তৈরী করে দিতে তখন তিনি সরাসরি না করেছেন। এতে তিনি দোষের কিছু দেখেননা, কারণ একটা ক্লিনিক চালাতে গেলে আসমা কি পরিমাণ ব্যস্ত হয়ে যাবে সেটা তিনি জানেন। সেজন্যই ক্লিনিকের ব্যাপারে সরাসরি 'না' বলায় তাঁর মাঝে কোন অপরাধবোধ নেই; যতটুকু অপরাধবোধ তার সবটাই আসমাকে ডিভোর্স থেকে থামানোর জন্য নিজ থেকে কোন প্রচেষ্টা না নেয়ার ব্যাপারে।
সকালে নাশতা খেতে খেতে নিজের ফেলে আসা জীবনের কথাই এভাবে ভাবছিলেন শরীফ সাহেব। কাল সারারাত তাঁর ঘুম হয়নি। আসমা কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন কিভাবে তাঁদের তিন ছেলেমেয়েই বিপথে চলে যাচ্ছে। ভয়ানক সব খবর শুনে প্রচন্ড দুশ্চিন্তার মাঝেও শরীফ সাহেবের ভাল লাগছিল আসমাকে কাঁদতে দেখে, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল পর্বতে ভাঙন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু তাঁর সব আনন্দই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল যখন আসমা নিজের কথা আর কান্নার সুর ধরেই বললেন, "শোন, আমি ঠিক করেছি ওদের তিনজনকেই আমি নিয়ে যাব অস্ট্রেলিয়ায়। ওখানে গেলে এসব ড্রাগ-ট্রাগ হাতের কাছে পাবেনা, নিজ থেকেই ভাল হয়ে যাবে।"
শরীফ সাহেব কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বলেছিলেন, "প্রলাপ বোকনা। তিনটার শেষ সর্বনাশ না করে কি ছাড়বেনা তুমি?"
আসমাও জবাব দেন, "এখানে নীতুকে কে দেখে রাখবে? তুমি? রাত এগারোটায় এসে মেয়ের রূমে উঁকি দিয়ে চেক করবে ও ড্রাগ নিচ্ছে কিনা? আর ইতুকেই বা কিভাবে ফেরাবে? এরচেয়ে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে নতুন পরিবেশে নতুনভাবে সব শুরু করবে। তুনি বুঝতে চাচ্ছনা কেন?"
শরীফ সাহেব তেমন শক্ত কোন যুক্তি খুঁজে পেলেননা। অমুসলিম দেশে গিয়ে আরো উগ্র হয়ে যাবে এমন উদাহরন দিতে চাইলেন, কিন্তু আসমা তার ছোটবোনের উদাহরন টানলেন; তারা আমেরিকায় থাকে, তাদের ছেলে-মেয়ে দুটোই ভীষন ধার্মিক। সারারাত শরীফ সাহেব ভেবেই গেলেন, যাদের জন্য সব গড়লেন, যে ছোট্ট ইতু, নীতু আর তুষারের মুখ দেখে তিনি দিনে পনের ঘন্টার কাজ আর টেনশনের কষ্ট ভুলে যেতেন নিমিষেই, ওরা সবাই একটানে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যাবে! সবকিছুর যোগবিয়োগ শেষে তিনি কিছুই পাবেননা? তাঁর হতাশার সবচেয়ে বড় কারণ, এই মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারছেন যে মা ছাড়া থাকলে এই তিন ছেলেমেয়ের কোনটাকেই তিনি সামলাতে পারবেননা, এমনকি আসমা থাকলেও পারেন কিনা সেটাতেও সন্দেহ আছে। কাজেই তাঁর হাতে এখন চয়েস দুটো, হয় ছেলেমেয়েদের ছাড়া বাকী জীবন কাটিয়ে দাও অথবা ডিভোর্সটাকে বন্ধ করো।
শরীফ সাহেবের দ্বিতীয় অপশনটাকে বেছে নেয়া ছাড়া আর উপায় থাকলনা। সারাজীবনের প্রাপ্তিকে তিনি শূন্য করে দিতে পারেননি। সকালের নাস্তা শেষে ডাইনিং থেকেই তিনি চুপিচুপি ফোন করলেন তাঁর পারসোনাল সেক্রেটারী বিলাসকে। বললেন খোঁজ নিতে, পঞ্চাশ সিটের একটা শিশু হাসপাতাল তৈরীর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় খবরাখবর জোগাড় করে যেন এক সপ্তাহর মধ্যে তাঁকে পুরো রিপোর্ট দেয়া হয়। এখন আর একটাই কাজ বাকী, আসমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ডিগ্রী নেয়ার ভুত তার মাথা থেকে তাড়ানো, এই বয়েসে পড়াশোনার কথা মানুষ ভাবে!
অফিস থেকে দুপুরে সরাসরি আসমার মোবাইলে ফোন করলেন শরিফ সাহেব। আসমা তখন ডাইনিংয়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। শরীফ সাহেবের কন্ঠে আজ খানিকটা রোমান্টিক ভাব, আসমা অবাক। টুকটাক ঘরের খোঁজখবর নেয়ার ছলে শরীফ সাহেব তাঁর গদগদ রোমান্টিক ভাবটা পুরোপুরিই ঢেলে দিলেন ফোনে, এবং কথা বলতে বলতেই তাঁর মনে পড়ল ইতুর কথা। উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
"ইতুমনির কি খবর?"
"আজ সকালে বেরিয়েছে ঘর থেকে। এখন তো এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন কিছুই হয়নি।"
"শোন, তুমি কথার ফাঁকে ওকে বলে দিও যে আমি কিছু জানিনা, নাইলে বাপের সামনে আসতে লজ্জা পেতে পারে।"
"আচ্ছা বলে দেব। আর কিছু বলবে?" বলে আসমা ফোন রেখে দিতে চাইতেই শরীফ সাহেব তোড়জোড় করে বলা শুরু করলেন,
"শোন শোন, তুমি বলেছিলে না শিশু হাসপাতালের কথা?"
"হ্যাঁ, সেটা তো চার বছর আগের কথা! এখন আসছে কেন সেই কথা?"
"না, মানে আমার মনে হলো যে হাসপাতালটা করা যায়। আমি অলরেডী বিলাসকে বলে দিয়েছি ইনভেস্টিগেট করে রাখতে। "
"শোন! এখন এসব বলে লাভ নেই", আসমার শীতল কন্ঠ শরীফ সাহেবের বুকে শেল বেঁধায়।
"কেন আসমা? আমি তখন বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝি হাসপাতালটা তুমি কতবেশী চাও। আমি তখন ভেবেছি তুমি ঝোঁকের বশে ..."
মাঝে মাঝে শব্দচয়নের মতো মহাপাপ আর হয়না। "ঝোঁকের বশে" শব্দটা শরীফ সাহেবের যাবতীয় সম্ভাবনাকে এক নিমিষেই গুঁড়িয়ে দিল। আসমা কোনভাবেই মানতে পারলেননা, চার বছর আগে তিনি ঝোঁকের বশে ক্লিনিক করতে চেয়েছেন। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়েসী একজন মহিলা বিশ বছরের বেশী সংসার করে স্বামীর কাছে ঝোঁকের বশে চাওয়া কিছুর জন্য সংসার ত্যাগ করবে এমন ভাবনা শুধু শরীফ সাহেবই ভাবতে পারেন বলে তাঁকে আচ্ছামতো দোষারোপ করা হলো। আর আসমা এর সাথেও যা যোগ করলেন তা হলো, তাঁর ভর্তির অনেকটা এগিয়ে গেছে, যেকোন সময় অস্ট্রেলিয়া থেকে চিঠি আসবে; কাজেই এতদূর এগিয়ে এখন আবার পিছিয়ে যাবার কোন যুক্তি তিনি পাচ্ছেননা। একইসাথে আসমা শরীফ সাহেবকে এই বলেও দোষারোপ করলেন যে শুধু ছেলেমেয়েদের নিজের কাছে রাখার আত্মবিশ্বাস হারিয়েছেন বলেই আজ তিনি এই প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, যেটাকে সরাসরি শঠতা বলা যায়। আসমার সবচেয়ে ধারালো প্রশ্নটা ছিল, "কেন চার বছর আগে রাজী হওনি?"
দুপুরের খাবার টেবিলে আসমা গম্ভীর কন্ঠে তিন ছেলেমেয়েকেই অস্ট্রেলিয়া যাবার ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি নেয়ার কথা বললেন। তিন ভাইবোন একটা টুঁ শব্দও করলনা। আসমা যখন খুব জোরের সাথে বললেন, "তোরা এমন করছিস কেন? হ্যাঁ বা না, কিছু একটা বল্!!" তখন তিন ভাইবোন মোটামুটি একই সময়ে গ্লাস হাতে নিয়ে পানি খেল। এটা কি তাদের প্রতিবাদ, না সম্মতি -- আসমার বোঝার উপায় ছিলনা।
৯.
নীতুর ঘরে লিমুর আসা যাওয়া বেড়েই চলল। গত তিনদিন ধরে আসমা লক্ষ্য করছেন, লিমু প্রতিদিন দশটার দিকে আসছে, আসমার সামনে পড়লেই বলছে পরীক্ষার পড়াশোনা করছে দুজন একসাথে, মাঝে মাঝে আদিখ্যেতা করে এমনও বলছে যে সে নিজে কিছু পারেনা, আর নীতু ভীষন ব্রিলিয়ান্ট, তাই তার খুব উপকার হচ্ছে, এসব হাবিজাবি। আসমা খেয়াল করেছে, দুই বান্ধবী খাওয়ার সময় ছাড়া বাকীটা সময় নীতুর ঘরেই কাটায়, কি পড়াশোনা করে আসমা জানেননা, কয়েকবার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেছেন দুটোতে গল্প করছে আর কিছুক্ষণ পরপর খিলখিল করে হেসে উঠেছে। সলেমার মা'র কথামতোই, আসমারও মনে হলো নীতু আর লিমু -- দুজনেই খানিকটা টলছে। কাল অনেকরাত পর্যন্ত নীতুর রূমে টিভির শব্দ পেয়েছেন, তাঁর ধারনা নীতু ইদানিং প্রায় ঘুমায়ইনা।
নীতুকে ড্রাগ এডিক্ট ধরে নিয়েই আসমা পরিকল্পনা করতে লাগলেন, কোনদিকগুলো চেক করতে হবে। প্রথমে তাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ড. রশীদের কাছে নিয়ে গিয়ে বুঝতে হবে নীতুর কোন লেভেলের আসক্তি হয়েছে; তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে মেয়েকে কি এখানে কোন রিহ্যাবিলিতে রাখবেন, নাকি সাথে করে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যাবেন। সলেমার মা গতকাল যা বলল সেই ইয়াবাতেই যদি সীমিত থাকে, তাহলে হয়ত তেমন বড় রিহ্যাবিলি ট্রিটমেন্ট লাগবেনা, কিন্তু গত কয়েকদিনের ঝক্কি-ঝামেলাতে আসমা এতই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন যে, নিতু যদি ভয়াবহ মাত্রার এ্যাডিক্টও হয় তাতেও তিনি আশ্চর্য হবেননা। এদিকে দুদিন আগে শরীফ সাহেব আসমাকে যখন হাসপাতাল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কোন সাড়া পাননি, তারপর থেকে তিনি পুরোপুরি চুপ। অনেকরাতে বাসায় ফিরছেন, সকালে কেউ জাগার আগেই বের হয়ে পড়ছেন। আসমার এমন অবস্থা যে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে কারো সাথে কথা বলবেন যে এমন কোন মানুষ আশেপাশে নেই। অগত্যা তিনি ইতুকেই বেছে নেন। মেয়েকে নিজের ঘরে ডেকে এনে বললেন,
"আয়, তোর মাথায় বেনী করে দিই।"
ইতু চুপচাপ বাধ্যমেয়ের মতো বসে। একবার ভাবে জিজ্ঞেস করে যে মা-বাবা কি আসলেই ডিভোর্স করতে যাচ্ছে নাকি। পরমুহূর্তেই তার মনে হয় যে সে এসম্পর্কে একটা টুঁ শব্দও করবেনা। নীরবতা ভেঙে আসমাই আবার বলেন, "ইতু তোর থিসিস কবে শেষ হবেরে?"
"আর মাসখানেক লাগতে পারে। কেন?" কাটাকাটা কথায় জবাব দেয় ইতু।
"না, ভাবছিলাম তোর জন্য অস্ট্রেলিয়ায় কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া শুরু করব কিনা? তুই নিজে এখনও ভেবেছিস কি করবি?"
"হ্যাঁ, ভেবেছি। পাশ করেই একটা মোবাইল ফোন কোম্পানীতে ঢুকব, ব্যস। আমার আর পড়াশোনা করার কোন ইচ্ছে নেই।"
"কি পাগলের মতো কথা বলছিস! তোর রেজাল্ট কত ভালো, তোর তো অবশ্যই মাস্টার্স করা উচিত, পারলে পি.এইচ.ডিও।"
"আহা! বললামনা !! আমি আর পড়াশোনা করবনা। দু'তিন বছর চাকরী করে তারপর বিয়ে করে ফেলব। তারপর গৃহিনী।" ইতু খেয়াল করে মা খোঁচা খায় কিনা। অথচ আসমা খোঁচা তো খেলেনই না, বরং বিয়ের কথা শুনে একটু হাসিহাসি মুখেই বলে ফেললেন,
"কিরে বিয়ে করবি? ছেলে দেখব তোর জন্য?"
"আম্মু! তুমি কি পাগল!! তোমার এত শ্বাশুড়ী হবার শখ থাকলে নীতুকে বিয়ে দিয়ে দাও। আমি আগামী তিন বৎসরে না।"
নীতুর প্রসঙ্গ আসার জন্যই যেন আসমা অপেক্ষা করছিলেন। ইতুর মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়েই বললেন, "আচ্ছা শোন, নীতুকে নিয়ে আমার খানিকটা চিন্তা হচ্ছে।"
ইতু নড়েচড়ে বসে, মাথা ঘুরিয়ে মা'র দিকে তাকিয়ে কৌতুহলী চেহারা করে বলে, "কি আম্মু?"
"ও কি ড্রাগ ট্রাগ নেয়? তুই জানিস কিছু?"
ইতু থমকে যায়, গলার স্বর যতদূর সম্ভব নামিয়ে বলে, "আমিও শুনেছি। ঐ যে লিমু মেয়েটা না? সুবিধারনা।"
"কি করা যায় বলতো?"
"আম্মু শোন, রশীদ আঙ্কেলের ক্লিনিকে কাল নিয়ে যাবে নাকি?"
আসমা সুযোগমতো আসল কথা বলে ফেলেন, "শোন, বুঝিসই তো এখন ও আমার কথা শুনবেনা। তুই বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে যেতে পারবি না? আফটার অল, তোর ছোটবোন।"
ইতুর ইচ্ছে করে মাকে শুনিয়ে দেয় যে, "আর আফটার অল তুমি আমাদের কে?"। কিন্তু ইতুর গলা আটকে যায়, কোথায় যেন সে এখনও এবিষয়ে কথা বলতে ভীষন বাঁধা পায়। সেটা হতে পারে বাবা-মা'র প্রতি তার অভিমান, গত চারবছর ধরে যেটা ধীরে ধীরে জমেছে। সেটা হতে পারে শোক থেকে, চারবছর ধরে যে আশংকাটা সে করছিল, সময়ের সাথে সাথে সেই আশংকাটা একটু একটু করে তার কেটেও যেতে থাকে। বিশেষ করে তার ধারনা ছিল তুষারের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পরই মা ঘোষনা দেবে ডিভোর্সের, কিন্তু এরপরপর যখন কোন ঘোষনা এলোনা, ইতু ধীরে ধীরে খানিকটা আশান্বিতও হতে শুরু করেছিল। অথচ সেদিনের ঘোষনাটা একটু একটু করে জেগে ওঠা আশাটাকে একদম গুঁড়িয়ে দিল, সেই শোক থেকেও হতে পারে যে ইতু এবিষয়ে কিছু বলতে পারেনা। তাই সত্যি সে যেকথাটা বলতে চেয়েছিল সেটাকে মনের মাঝেই চেপে রেখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলল, "ওকে, আম্মু, তুমি কিছুই ভেবোনা।"
পরদিন দুপুর একটায় ডা. রশীদের বড়ছেলে ডা. আহবাব ফোন করেন ইতুদের বাসায়; আসমা বুঝতে পারেন যে নীতুর এ্যাডিকশন বেশ গুরুতর পর্যায়ের, তাকে বেশ লম্বা সময় রিহ্যাবিলিয়েশন সেন্টারে থাকতে হবে। ডা. আহবাব অবশ্য এই বলে আশ্বাস দেন যে তার একঘনিষ্ট বন্ধু এনিয়ে কাজ করছে, ওদের সেন্টারে ভর্তি করার ব্যাপারে তিনি আসমাকে সবরকম সহযোগিতা করবেন। ডা. আহবাবের আন্তরিকতায় আসমা প্রীত বোধ করেন, বুঝতে পারেন যে আহবাব ডাক্তার হিসেবে তার বাবার মতোই ভাল হবে। তবে অন্য যে সত্যটি তিনি ধারনা করতে পারেননি, সেটা পারলে হয়ত তিনি ভীষন খুশীই হতেন। কারণ, তাতে তাঁর একটি ভয়ানক দুশ্চিন্তা পুরোপুরি দূর হয়ে যেত।
(চলবে ...)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০০৮ বিকাল ৫:২৪