somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প এক অংকের ব্যবধান

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৮:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রায় ৬ বছর পরে দেখা জমির সাহেবের সাথে। পাশাপাশি ভাড়াটিয়া ছিলাম আমরা। ভদ্রলোকের সাথে অদ্ভুত কিছু মিল ছিল আমার, যা রীতিমত ভাবিয়ে তোলার মত। সবকিছুতেই উনি আমার থেকে এক অংকে এগিয়ে ছিলেন। যেমন আমি আমার বাবার দুই নাম্বার সন্তান, উনি তিন নাম্বার। আমার একবছর আগে এইচ এসসি পাশ করেছেন বিয়েও করেছেন আমার একবছর আগে। অবাক হওয়ার মত আরো অনেক সামঞ্জস্য ছিল আমাদের সবকিছুই আবার এক অংকের ব্যবধানে। তার মাঝে একটিত রীতিমত ভীতিকর। এক বছর আগে পরে বেড়াতে গিয়ে প্রচন্ড দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল আমাদের। একটুর জন্য দুজনেই প্রানে বেচে গিয়েছিলাম।
আরে জমির ভাই যে, প্রথমে আমি শুধাই।
রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকা জমির সাহেব চমকে উঠার মত ফিরে তাকান।
কিছুক্ষন কথাবার্তাতেই চিনতে পারেন আমাকে।
আচরনে এবং কথাবার্তায় কিছুটা অন্যরকম মনে হল ভদ্রলোককে। বাসায় আমন্ত্রন জানালাম, রাজী হলেন না। কারো জন্য এখানটায় অপেক্ষা করার কথা, জ্যামে লোকের আসতে দেরি হচ্ছে।
পাশের একটা খাবার দোকানে বসতে রাজী হলে, দুজনে গিয়ে বসলাম সেখানটায়।
কিছু মানুষ এমনিতে খুব কম কথা বললেও, খাবারের সময় বেশ কথা বলতে ভালবাসেন। জমির সাহেব হালকা নাস্তা সারার ফাকে ফাকে অনবরত কথা বলে গেলেন, আমি শুনে গেলাম ধৈর্যের সাথে। ক্রমাগত নিজের গত ৬ বছরের সাফল্যের বয়ান দিয়ে গেলেন। কথা শুনতে শুনতে একসময় টের পেলাম অস্বস্থিকর কিছু একটা মনটাকে ক্রমেই বিক্ষিপ্ত করে তুলছে। তবুও সচেষ্ট থাকলাম তার কথায় মনোনিবেশে। একসময় কথায় কথায় এদিকটায় আসার কারন জিগ্গেস করলাম। বড় করে স্বাস ছাড়লেন। তারপর মুখ অন্ধকার করে বললেন, গতবছরের এই দিনটাতেই এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তার স্ত্রী আর বড় সন্তান মারা গেছেন। এখানকার বড় একটি কবরস্থানে গোর দেয়া হয়েছে তাদেরকে, তাই কবর জিয়ারত করতে আসা। আমি জানতাম জহির সাহেবের ৩ ছেলে, এক্ষেত্রেও আমার থেকে এক অংকে এগিয়ে ভদ্রলোক, অর্থাত আমার দুই ছেলে।
দু:খজনক এই সংবাদে মন খারাপ হয়ে গেল আমার। কিছুক্ষন চুপ থেকে সমবেদনা জানালাম।
একসময় ভারাক্রান্ত মনে জহির সাহেবকে বিদায় জানিয়ে বাসার পথে হাটা ধরলাম। সারাপথ হাটছিলাম আর জহির সাহেবের কথাগুলোর জাবর কাটছিলাম। ভদ্রলোক বলেছিলেন চার বছর আগে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন, তিনবছর আগে ঢাকার অদুরে তিনকাঠা জায়গা কিনেছেন, আর দুবছর আগে নিজের ব্যবহারের একটা গাড়ি কিনেছেন। এবার বুঝতে পারলাম কথাগুলো শুনতে কেন অস্বস্থিবোধ করছিলাম। তিনবছর আগে চাকুরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু আমিও করেছি, দুবছর আগে ঢাকার অদুরে দুইকাঠা জায়গা (জহির সাহেবের চাইতে এক কাঠা কম) আমিও কিনেছি, আর গাড়ি কিনেছি গত বছর। আবার সবকিছুতেই জহির সাহেবের চাইতে এক অংকে পিছিয়ে।
হঠাত করেই আমি টের পেলাম মন আমার প্রচন্ড অস্বস্থিকর কিছু একটা থেকে পরিত্রানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, চেষ্টা করলাম অন্য একটা কিছুতে মনকে আকৃষ্ট করার। কিন্তু চেষ্টা বিফলে গেল, শেষ পর্যন্ত ভীতিকর বিষয়টাতে আমরা চিন্তা আটকে গেল, আমি রীতিমত নিজের ভেতর কাপুনি টের পেলাম, আমার কপালে ঘাম জমতে শুরু করল। ঢাকার পার্শবর্তী একজেলায় আমার স্ত্রী আমার ছোট ছেলেটিকে নিয়ে তার বাপের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে। গতবছর কেনা গাড়িতে করে আজ সন্ধায় ফেরার কথা। ঠিক একবছর আগে আজকের দিনটিতেই জহির সাহেব তার স্ত্রী আর সন্তানকে হারিয়েছেন।
পাগলের মত দৌড়িয়ে বাসায় ফিরলাম। মোবাইলে অনবরত চেষ্টা করে গেলাম স্ত্রীর সাথে যোগাযোগের। আবার ভয়কে বাড়িয়ে দিয়ে প্রতিবার যন্ত্রটিকে উত্তর এল এই মুহুর্তে সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না। স্বশুর বাড়িতে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম ২ঘন্টা খানেক আগে রওয়ানা দিয়ে বেরিয়েছে।
নিজেকে খুব অসহায় মনে হল, প্রচন্ড উত্কন্ঠা নিয়ে বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার রইল না।
আমার আত্মাকে কাপিয়ে দিয়ে এমন সময় আমার ল্যান্ডফোনটি বেজে উঠল। অসংলগ্নভাবে পা ফেলে কাপা হাতে রিসিভার কানের কাছে ধরলাম।
কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম যাতে খারাপ কিছু না ঘটে।
"কিরে ভাবী এখনো ফেরেননি।"
বন্ধু শফিকের গলা শুনে হাফ ছেড়ে বাচলাম, শুকনো সুরে উত্তর দিলাম "না"।
"তোকে দেখলাম জহির সাহেবের সাথে বসে থাকতে, ভদ্রলোকের সাথে কি কথা হল"।
আমরা সবাই একসময় মর্নিওয়াকের সাথী ছিলাম, তাই শফিক জহির সাহেবকে ভালমতই চেনে।
"তোর সাথেও কি কথা হয়েছে"।
"আজ নয় তবে অন্য একদিন,প্রায় মাস ছয়েক আগে ভাবী অর্থাত জহির সাহেবের স্ত্রী ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ভদ্রলোকের জন্য খুব দু:খ হয়।"
"কিন্তু জহির সাহেব বললেন উনার স্ত্রী আর বড় ছেলে মারা গেছেন বছরখানেক আগে।"
"দু:খটাত ওখানটাতেই। বছর ৪ আগে চাকরী ছেড়ে ব্যবসা ধরেছিলেন আর সেটাই তার কাল হয়েছিল,সর্বশ্রান্ত হয়ে বছরখানেক আগে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এখন সবার কাছে ব্যবসার সাফল্য আর স্ত্রী, সন্তানের মৃত্যুর কথা বলে বেড়ান। ব্যবসার অপুরনীয় ক্ষতিটা তার মন কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি।"হঠাত করেই যেন নিজেকে খুব হালকা মনে হল। ইচ্ছে হল গলা ছেড়ে হেসে উঠি।নিজের উপর কিছুটা বিরক্তবোধ হল নিজের অযৌক্তিক চিন্তাভাবনার জন্য।
অনবরত যে কলিংবেল বাজ্ছিল এতক্ষন তা টের পাইনি, শফিকের কথা শুনতে শুনতে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম।
শফিকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে,রিসিভার নামিয়েই দৌড়ালাম দরজার দিকে।
"কি হল দরজা খুলতে এত দেরি করলে কেন"
দরজা খুলতেই স্ত্রীর জেরার সম্মুখীন হলাম। আমার স্ত্রী আমার ছোট ছেলেসহ ঘরে ঢুকল।
"পথে তোমাদের কোন অসুবিধা হয়নিত, সব ঠিকঠাক ছিল ত, আমি ত তোমাদের নিয়ে ভয়ংকর দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম"
"অসুবিধা হবে কেন? আর দুশ্চিন্তা করারই বা কি আছে, পাগলের মত কি সব আবোল তাবোল বকছ।" আমার স্ত্রী ধমকে উঠল।
"না আজকাল যে হারে দুর্ঘটনা ঘটছে" আত্মপক্ষ সমর্থনে বললাম আমি।
"বাবা আমাদের ত দেরি হয়নি।" আমার ছোট ছেলে মার পক্ষ নিল।
আর কথা না বাড়িয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। গত কয় ঘন্টা মনের উপর দিয়ে প্রচন্ড ধকল গেছে। অসংলগ্ন আচরন আর চিন্তা ভাবনায় নিজের উপর বিরক্তবোধ করলাম। নিজেকে বোঝালাম কাকতালীয়ভাবে অনেককিছুই ঘটে থাকে, এর বিশেষ অর্থ করাটা শ্রেফ বোকামি।
কিন্তু এক অংকের ব্যবধানে জহির সাহেবের সাথে তার অদৃষ্টের অস্বাভাবিক মিলটির চিন্তাটি কোনভাবেই মাথা থেকে তাড়াতে পারলাম না।
স্ত্রীর মুখে শুনা পাগল শব্দটি আমার মস্তিষ্কে ক্রমাগত অনুরনিত হতে থাকল আর শব্দটিকে ঘিরে আমার চিন্তাগুলো ঘুরপাক খেতে লাগল অনবরত। এসব ভাবতে ভাবতে প্রচন্ড যন্ত্রনায় আমি দু হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলাম। জহির সাহেবের মত মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার আশংকাটি ক্রমেই আমায় বুকে চেপে বসতে থাকল।
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×