"শুধু ইন্জিনিয়ারিং এ অ্যাপ্লাই করবা কেন ? সবাই ইন্জিনিয়ারিং এর সাথে আর্কিটেকচার পরীক্ষাটাও দিয়েই দেয় "........প্রিয় একবন্ধুর দেয়া "সুচ" হয়ে ঢুকা সাজেশনটাই শেষ পর্যন্ত "ফাল" হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো । স্কুলের হালখাতা আমার ক্লাশ ফাইভে , তার আগে বাসায় বসেই চলেছে আমার শিক্ষাকার্যক্রম ।স্কুলে বা কিন্ডারগার্টেনে ক্লাশ ওয়ান/টু/থ্রি তে যখন মুরগি/ফুল/আম/বাঘ দিয়ে সোনামনিরা ড্রইং খাতা ভরিয়ে ফেলে সে সময়টায় বাসায় পড়ে থাকা আমার রংগিন পেনসিল গুলো অযত্নে অবহেলায় উইপোকার খাদ্য চাহিদা মিটিয়েছে । আঁকাআঁকি বলতে কেবল এস এস সির বায়োলজি । ইন্টারমিডিয়েটে উঠে "ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি বলে তওবা পড়ে বায়োলজি ধর্ম ত্যাগ করেছি" । জাতি করজোরে যদি মিনতি করে বসে "তোমার মত এমন পটুয়া আঁকিয়ে আর্কিটেক্ট আমরা চাই না"..........তাহলে খুব কি অন্যায় হবে ?
ইন্জিনিয়ারিং পরীক্ষা দেয়ার জন্য যোগ্যদের লিস্ট যেদিন করা হলো , সেদিন "engineering+architecture" লিস্টে আমার নামের আশেপাশে চেনাজানা কোন বন্ধুকে খুজে পেলাম না , সবাইকে পাওয়া গেল "only engineering" লিস্টে (এমনকি আমার সুপরামর্শদাতা বন্ধুও) ।
আজ থেকে ৫ বছর আগে ফিরে যাই ................
ডেটলাইন ৯ই জানুয়ারী , থার্মোমিটার রিডিং শো করছে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস । ঢাকাবাসীর জন্য রীতিমত মেরুদেশিয় আবহ ।কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার/মেডিকেল কলেজ প্রান্তের গেট গলিয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে ঢুকে পেছন ফিরে একবার তাকালাম ..........শত অভিভাবকের নির্বাক চোখের একই ভাষা .........এ যেন হাশরের দিন , আমলনামার জন্য অধীর উতকন্ঠা ।
ওল্ড একাডেমিক বিল্ডিংয়ে হু হু উত্তরীয় বাতাসে জমে যাওয়া হাতটার সাথে লড়ে ফিজিক্স , ম্যাথ , কেমিস্ট্রি এক্সাম যখন শেষ হলো , হিসেবে ধরা পড়লো ৬০ টির মাঝে ৬ টি প্রশ্ন সময়ের অভাবে পড়তে পারিনি । মনে হচ্ছিল সাধের ডিপার্টমেন্টটা পেয়েই যাবো । একঘন্টা বিরতির
পর শুরু হবে আর্কিটেকচারের জন্য অতিরিক্ত ১৮০ নম্বরের লড়াই ।
ড্রয়িং পরীক্ষা শুরুর পূর্বমুহুর্তে ডানে বামে ঘাড় ঘুরিয়ে সবার দৃপ্ত চোয়াল আর বৈচিত্রময় পেনসিলের সূচালো ফলাসমেত যুদ্ধসাজ দেখে বুঝলাম আমার মত কেউ "মদন" হয়ে আর্কি পরীক্ষা দিতে আসেননি । এরা রীতিমত আঁকিয়ে , আর আমার গুলো ওদের পাশে বড়জোড় "আঁকিবুকি " ।
৪ টা প্রশ্ন ।
প্রথমটা একটি ঘরের সামনে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে ।
শুরু করলাম আয়তক্ষেত্র দিয়ে(ঘরের দেয়াল) , তার মাথায় একটা ট্রাপিজিয়াম(ঘরের চালা) । তাতে মনে হলো ঘরটা পৃষ্ঠার সাথে লেপ্টে গেছে । মানুষ আঁকতে গেলে হয় মনে হবে মানুষটির পায়ের নিচে চ্যাপ্টা ঘরটি হয়ে গেছে(সেক্ষেত্রে সুমো কুস্তিগীর খানিকটা মানানসই) , অথবা নরহত্যার দায় নিয়ে মানুষটিকে ঘরের দেয়ালে লেপ্টে দিতে হবে । নাহ এমন করে হবে না , ঘর হতে হবে থ্রি ডাইমেনশনাল । নৌকার পালের আদলে দু'পাশে দু'টো সংযুক্ত চাল আঁকলাম , তার নিচে একটা কিউব । সামনের মানুষটা নিয়ে পড়লাম বিপদে । মাথাটাই আঁকতে পারি না , হাত দুটো শরীর থেকে দূরে সরে গিয়ে কাকতাড়ুয়া সাজতে চায়, পা দুটোর মাঝে মাইলখানেক ফাঁকা জায়গা , ঠিক যেন রণপা। কিছু বুদ্ধি বের হল... মাথায় চেক চেক করে দিলাম , ভাবখানা এমন যেন গামছা পেচিয়ে আছে । মুখের শেপ সাইজের বিপর্য্য় এড়াতে দাড়ি দিয়ে ঢাকলাম । কাধের কাছে আকলাম প্যারাবলা । স্যান্ডো গেন্জির ভাব । ফাঁকা হয়ে থাকা পা দুটো ঢেকে দিলাম একটা চেক করা আয়তক্ষেত্র দিয়ে , যদিও মনে মনে আমি প্রাণপণে বলে যাচ্ছি ..."এটা লুংগি , দেশি চেক লুংগি"কিন্তু লোকটার পা আমাকে ক্ষমা করলো না । লুংগির নিচ দিয়ে পা জোড়া যেন মাটিতে গেঁথে আছে , কিছুতেই মাটির সমান্তরালে নিতে পারছি না । পা দু'টো লুংগি দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করলাম , তাতে গ্রামের কিষাণ মাটি থেকে খানিকটা উপরে ভেসে উঠে , পূর্নাংগ ভূতের রুপ নিয়ে নিল । অনেক ধস্তাধস্তির পর পা মাটিতে নামলো , কিন্তু মানুষের পায়ের বদলে হাঁসের চ্যাপ্টা পা হয়ে ।
নেক্সট ........
একটা পোস্টারের নিমিত্ত আবেদন । বিষয় শিশু পার্ক।
কি করে শুরু করি । পৃষ্ঠার মাঝ বরাবর গোল করে বৃত্ত একে দিলাম । গোল দু'টো চোখ , নাকটাও গোল , গালে ছোপ ছোপ , মাথায় বসালাম একটা চোঙ । চোঙের দুপাশ দিয়ে মেঘের মত কোঁকড়া চুল বের করে দিলাম । "জোকার" সৃষ্টির চেষ্টা ।মুখের কাছে উল্টা ঈদের চাঁদ , হাসছে আমার জোকার । আমার ছবি দেখে স্যারও আমাকে জোকার ভেবে বসতে পারে , আমার অতসব চিন্তার সময় নেই । ভাবছি আমি , শিশুরা আর কি পছন্দ করে ? ...."রোলার কোস্টার ?" । খানিকটা সময় মারামারি করলাম , নাহ রোলার কোস্টার পেচিয়ে বড়জোড় নুডলস হয়ে যায় , শিশুপার্কে খাবার দোকানে নুডলস পাওয়া যায় ,শিশুপার্কে খাবার দোকানে নুডলস পাওয়া যায় , কিন্তু তাই বলে পোস্টারে নুডলসের ছবি দেয়াটা কেমন দেখায় ?তিনপাশে তিনটা বেলুন একে দিলাম , মাঝে বিদঘুটে ফন্টে লিখে দিলাম Amusement park । পোস্টার দেখেই বুঝতে পারছি শিশুরা ভুলেও এমন পার্ক মাড়াবে না । আমার সময় নেই ....
নেক্সট :
তিনটি সিলিন্ডার দিয়ে একটি মডেল তৈরি করতে হবে ।
মাত্র তিনটা সিলিন্ডার ?সিলিন্ডার হিসেবে ভাবলাম তেলের ড্রাম ।ভাবছি আমি........ এমনভাবে সাজাতে হবে যেন মডেলটির সামনে প্রেমালাপে মশগুল কোন বাদাম চিবুনো কোন প্রেমিকের উপর ড্রাম তিনটি ধ্বসে পড়ে মহাকেলেংকারি না হয়ে যায় । কিছুই মাথায় ঢুকলো না , মিতশুবিশির লোগোটা চেনা আছে ? হুবুহু লোগোটা নকল করার চেষ্টা করে গেলাম , তিনটা সামান্তরিকের বদলে বসালাম তিনটি তেলের ড্রাম । মনে মনে মডেলটির নাম দিলাম "বলদ" ।
নেক্সট : এবার এভারেস্ট পেড়িয়ে যাবার হাত্ছানি .......
পথের উপর দু'টো ছোট ছেলেমেয়ে বসে মার্বেল খেলছে ।
শুরুতে আঁকাবাকা পথে আঁকলাম , পথের বদলে নদী হিসেবে মানিয়ে গেল । মুছে ফেলে নতুন করে আঁকলাম । বেশ একটা ভাব আসলো ....পথটা দেখে গাইতে ইচ্ছা করছে ......"এই পথ যদি না শেষ হয়" । কিন্তু ছেলেমেয়েকে দাঁড় করাতেই পারে না যে , সে বসাবে কি করে ?
মোটা, সোজা করে নতুন পথ আঁকলাম , আশে পাশে কিচ্ছু নেই , বাংলায় বানান করে "পথ" লিখে না দিলে পথ বুঝবারও জো নেই ।এমন পথে ছড়িয়ে দিলাম কিছু মার্বেল (নিজেকেও প্রবোধ দিলাম , বলো এগুলো মার্বেল , গোল গোল কিছু না) । দু'পাশে ছেলে মেয়ে বসানোর পালা , হাঁটু বরাবর একটা পা ভেংগে দিলাম । মুগ্ধ হলাম ........(এসএসসি তে ব্যাঙের ঠ্যাং আঁকতে কত কষ্ট হত , এক আঁচরেই ব্যাঙের ঠ্যঙটা দারুণ হয়েছে) । তার উপর পাশ থেকে দেখা শরীর , মাথা । মেয়ের জন্য সেই মাথায় আবার কিছু লম্বা লম্বা দাগ(চুল সৃষ্টির ব্যর্থ প্রয়াস) , বাকানো শরীরের ফ্রক পড়ানোর চেষ্টাটাও মাঠে মারা গেল , পেছন দিকটা উঁচু হয়ে পালকের রুপ নিল , বেশ একটা মুরগী মুরগী ভাব এসে গেল । পা যথারীতি হাঁসের পা । শেষমেষ যা দাঁড়ালো .......একটা আয়তক্ষেত্রের সাথে লেপ্টে থাকা কিছু গোল গোল কি যেন(মার্বেল) , তার দু'পাশে হাস/মুরগী/ব্যাং/মানুষ সহযোগে কোন অন্য সৌরজগতীয় প্রাণী ।
প্রহর ফুরোলো।১৮০ তে পাশ নম্বর ৭২ । ইন্জিনিয়ারিং পরীক্ষা ভালো হয়েছে , বুঝতে পারছি তে কেবল পাশ মার্কসটা পেলেই দু'টো মিলিয়ে আর্কিতে ১ থেকে ১০ এর মধ্যে একটা জায়গা পেয়েই যাবো । এবার অপেক্ষার পালা ..................
ভর্তি পরীক্ষা স্মৃতি: আর্কিটেকচারে চান্স পাবার ঘোড়ারোগ এবং আমার আঁকাআঁকি বিপর্যয়
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৬৬টি মন্তব্য ৫৫টি উত্তর
পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন
আলোচিত ব্লগ
=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=
©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ফিরে দেখা - ১৩ মে
১৩ মে ২০০৬
দমননীতির অদ্ভুত কৌশল
সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের ওপর দমন নীতির আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রুত বিচার আইন ও পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে দমন... ...বাকিটুকু পড়ুন
কাঁচা আম পাড়ার অভিযান
গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমরা কেন এমন হলাম না!
জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি
২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন