somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিজভূমে পরবাসী

১০ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ বিকাল ৫:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। এবার এই দিন সোমবারে পড়েছে বলে এখানে মিছিল-মিটিং-ধিক্কারের সংখ্যা কম। তাও শুনলাম কাশ্মীরে আর কোলকাতায় কোনো কোনো জায়গায় কিছু বিচ্ছিন্ন সভা আয়োজন হচ্ছে। লোকে এখন আজকাল এতোটাই কেরিয়ার-সচেতন যে অফিস কামাই করে দুটো মিটিং-এ যোগ দেবার সদিচ্ছা কারো নেই - তাও যদি ইস্যুটা হয় "অন্যের মানবাধিকার"। সবাই নিজের নিজের ইস্যুতে সিদ্ধহস্ত, নিজের অধিকার সচেতন, কিন্তু অন্যের অধিকারের বিষয়ে গা নেই। স্বভাবতই এখানে মানবাধিকার দিবস অলিখিত হিসাবে সরে চলে এসেছে রবিবারে। তাই কাল ভাবলাম এদিকে ওদিকে একটু ঢুঁ মেরে দেখেই আসি কোথায় কি চলছে।

আমাদের সাথে কাজ করে রাহুল রাজদান বলে এক কাশ্মীরী (নামে কাশ্মীরী - নিজেকে ইউরোপিয়ান বলে দাবি জানিয়ে পার পেয়ে যেতে পারে যেকোনো জায়গায়)। যাহোক তিনি আমাদের আগেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাদের মৌন মিছিলে যোগদান করার জন্য। অনেক খুঁজে পেতে গিয়ে হাজির হলাম তাদের সংস্থা (রূটস ইন কাশ্মীরের) মিটিং-এ। একটা বড় রাস্তার পাশে ১০-১২ জন ছেলে-মেয়ে কিছু প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কপালে লাল ফেট্টি বাঁধা - লেখা "RIK"। রাহুল সহ আর কয়েকজন পাশে ল্যাপটপে পাওয়ার-পয়েন্ট প্রেসেন্টেশন দিয়ে চলেছে - কাশ্মীরে পণ্ডিতদের ওপর কিরকম কি অত্যাচার হয়েছে। একের পর এক স্তুপীকৃত লাশের বা ভাঙা দালানের ছবি আর পাশে স্থান-কাল। আমরা যেতে খুব খুশী হল আর অনেকবার ধরে ধন্যবাদ জানালো। সাথে দিল কয়েকটা প্যামফ্লেট - যাতে অসংখ্য রেফারেন্স দিয়ে বোঝানো আছে কি সমস্যা তাদের কিভাবে সরকার আর জঙ্গীদের মাঝে "স্যান্ডুইচ" হয়ে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে দিনে দিনে। প্রতিবছর এই কয়েকজন পণ্ডিত মিলে হায়দ্রাবাদে রোড শো করে আর মোমবাতি জ্বালিয়ে সবাইকে জানান দিয় যান - যে তারা হায়দ্রাবাদে থাকলেও তারা আসলে কাশ্মীরী।

কাশ্মীরী পণ্ডিতেরা হল আদি কাশ্মীরী - কয়েক হাজার বছর ধরে কাশ্মীর উপত্যকার স্থায়ী বাসিন্দা। আগে বেশ কয়েক দফায় এই সম্প্রদায়ের লোকজন কাশ্মীর থেকে পাতাতাড়ি গুটিয়ে ভারতে বিভিন্ন জায়গায় বাসা বেঁধেছে। এখন এরা তাই সংখ্যায় খুবই কম - মাত্র পাঁচ কি ছয় লাখ হবে। ভোটের দেশে চিরকালের মত এখানেও সংখ্যালঘুদের পাত্তা এমনিতেও কম - তার ওপর যদি জায়গাটা হয় কাশ্মীরের মত "Disputed"। ১৯৮৯ সালে যখন প্রথম কাশ্মীরে সংঘর্ষ শুরু হল, তখন প্রথম আক্রান্ত হয় এই পণ্ডিতেরাই। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে এদের প্রক্সি দাঁড় করিয়ে শুরু হয় জঙ্গীদের অত্যাচার। মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা শুরু হয় পণ্ডিতদের ঘরছাড়া করার আদেশ। শুরু হয় যাকে বলা হয় এথনিক ক্লিনসিং - বছরের পর বছর সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার যে খেলা চলে এসেছে তারই আরো এক দফা। একের পর এক পণ্ডিতকে দলে দলে মারা শুরু হয় - কোথাও গলায় দড়ি দিয়ে, কোথাও গুলি করে, কখনো হাত-পা কেটে আর কখনও বা জ্যান্ত পুড়িয়ে। এসব লোমহর্ষক কাহিনী এখন আমাদের কাছে পুরোনো হয়ে গেছে। স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে শুধু উদ্বাস্তু পণ্ডিতেরা - যারা কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচে আছে জম্মু আর দিল্লীর কিছু রিফিউজি ক্যাম্পে। সংখ্যার খাতিরে বলে রাখা ভাল - ১৯৮৯ সালের পরে কাশ্মীরে হামলায় মৃত ৭০ হাজার মানুষের মধ্যে প্রায় ১২ হাজার হলেন সম্প্রদায়ভুক্ত (অত্যাচার করে মারার ঘটনা প্রায় ১,১০০র মত) আর রিফিউজি-র সংখ্যা তিন থেকে পাঁচ লাখের মধ্যে (সরকারি ভাবে যদিও সংখ্যাটা এক-দেড় লাখের বেশী নয়)। আক্রান্ত প্রায় একশো মন্দিরের মধ্যে অনেকগুলোই এখন পরিত্যক্ত। জংগীদের ঠেলায় কাশ্মীর উপত্যকার শতকরা নব্বই থেকে পচানব্বই ভাগই এখন থাকেন জম্মু আর দিল্লীর ক্যাম্পে - ত্রিপলের তাঁবুতে।

আরো মজার কথা, যারা ছিলেন এই গণহত্যার দায়িত্বে, তাদের মধ্যে অনেকেই ব্যক্তিগত সাক্ষাতকারে স্বীকার করেছেন গণহত্যার কথা। যেমন ধরা যাক ইয়াসিন মালিক বা "বিট্টা কারাটে"র (ফারুক আহমেদ দার) কথা। এরা গণহত্যার পরে এখন "হিরো" হয়ে বেঁচে আছেন। কাল "বিট্টা কারাটে"র ইন্টারভিউ দেখলাম ইউটিউবে। শান্ত গলায় সে দাবী জানাল সে বিশ জনকে মেরেছে - আর তার জন্য সে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ফাঁসির সাজা আশা করছে (২০০৬ সালে ছাড়া পেয়েছে ফারুক, এখনো কাশ্মীরে আছে)। বিবিসির সাথে ইন্টারভিউতে একইভাবে গণহত্যার কথা স্বীকার করেছেন ইয়াসিন মালিকও। কিন্তু এদের বিচারের ব্যবস্থা নেই - যেমন নেই গুজরাটে দাঙ্গাকারীদেরও।

কালরাতে বাড়ি ফিরে আরো একটু ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। কাশ্মীরী পণ্ডিতেরা ভারতের "নিজভূমে পরবাসী"দের (Internally Displaced People) মাত্র অর্ধেক। বাকি অর্ধেকের মধ্যে আছে আসামের সাঁওতালরা - যাদের এককালে আসামে এনেছিল ব্রিটিশেরা - চা বাগানে কাজ করানোর জন্য। আছে গুজরাটি দাঙ্গাপীড়িতরা, মিজোরামের উপজাতিরা - যারা আশ্রয় নিয়েছে ত্রিপুরাতে আর মাওবাদী হামলায় ঘরছাড়া গ্রামবাসীরা। এর সাথে শুরু হচ্ছে কর্পোরেট ডিসপ্লেসমেন্ট - মানে শিল্পের জন্য জমি নিতে গিয়ে উচ্ছেদ। কম করেও ছয় লাখ লোক আছেন এই "নিজভূমে পরবাসী"দের দলে। দিন যাচ্ছে, কারোর দেশে ফেরার কোনও আশা দেখা যাচ্ছে না - সরকার পুনর্বাসনের জন্য "কথাবার্তা" চালাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আদিম মানুষেরা নিজের জায়গায় থাকার অধিকারটা অন্তত নিশ্চিত করেছিল। আমরা অনেক এগিয়ে গিয়ে কি সেই পুরোনো অধিকারটাই হারিয়ে ফেলছি? তবে ওই - "অন্যের মানবাধিকার" নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কি লাভ? তাই আজ আমিও আবার পুরোপুরি কাজে ডুবে গেছি। স্বার্থপরতা জিন্দাবাদ!!

পুনশ্চ - অশোক পণ্ডিতের একটি তথ্যচিত্র ইউটিউবে দেখতে পারেন কাশ্মীরী পণ্ডিতদের নিয়ে - প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় খণ্ড।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ বিকাল ৫:১৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×