somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার বাজারমুখিনতা (শেষ পর্ব)

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০০৭ রাত ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘেরাটোপে পড়া সম্ভাবনাময় বিতর্ক

মা ন স চৌ ধু রী

আকালের বুদ্ধিচর্চায় বিতর্কের সূত্রপাত

কোন সন্দেহ নেই গতবছর নভেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে অনুষ্ঠিত সেমিনারটার জের ধরে সাংবাদিকতা নিয়ে যে বিতর্ক সূচিত হয় সেটা বাংলাদেশের বিদ্যাজগতে ও বুদ্ধিবৃত্তিক পেশাজগতে বিরল। বিতর্কটার কী কী আছর উত্তরকালের সাংবাদিকতায় পড়তে পারে, কিংবা সঠিকভাবে বললে পড়তে পারতো, সেটা স্বতন্ত্র জিজ্ঞাসা, এবং এই আলোচনায় বাহ্যত উদ্ঘাটিত নয়। তবে এ কথাটা গোড়াতেই, এই আলোচনায় অন্তত, উল্লেখ করা জরুরি হবে যে বিতর্কটি অনেক বড়ো হয়ে ওঠেনি --Ñনা আয়তনে, না প্রসঙ্গ প্রস্তাবনায় এর মধ্যে আয়তনের প্রসঙ্গটি বাহ্যত লক্ষণীয়। তিন-চারটা লেখার কিস্তিতেই তা স্তব্ধ হয়েছে। এবং পত্রিকাপক্ষ সেটার বিস্তৃতি ঘটাতে খুব আগ্রহী ছিলেন বলে ঠাহর করা মুস্কিল। অধিকন্তু, লেখাগুলো মূলত দৈনিক পত্রিকার বাইরে প্রাপ্য, এবং উল্লেখ জরুরী, আস্ত একখান লেখা প্রকাশের সুবিধাজনক জায়গায় কেবল পত্রিকাপক্ষই ছিল, তারা সেটা ব্যবহার করেছে পরম পরিতোষে। অথচ দুইপক্ষের লেখাতেই পাঠক হিসেবে আমি একাগ্রতার ছাপ সুনিশ্চিত লক্ষ্য করেছি। স্তব্ধ হয়ে যাওয়া এই বিতর্কের সম্ভাব্য কারক আরো কারা কারা হতে পারতেন, কিভাবে পারতেনÑ-- সেগুলো সহজেই অনুমেয়। আমার বর্তমান আলোচ্য বিষয় অন্যত্র, সেই বিতর্কটির প্রসঙ্গ প্রস্তাবনা নিয়ে। বাদী এবং বিবাদী তরফে কিভাবে একটা বিতর্কের সম্ভাবনাগুলোকে নস্যাৎ করা হয়েছে তার একটা পর্যালোচনা করবার প্রচেষ্টা এই লেখাটি। পয়লাতেই আমি আত্মপ সমর্থন করে রাখি যে, এটি একটি অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা নয়, প্রাথমিক পর্যালোচনা। কিন্তু প্রসঙ্গটি অনুপুঙ্খ হবার দাবিদার বলে আমি মনে করি।

এ্যাডভোকেসি সাংবাদিকতা বনাম 'নিরপেক্ষ' সাংবাদিকতা

লক্ষণীয় যে উভয়পক্ষ, নানান স্ববিরোধিতা সত্ত্বেও, যে বিপ্রতীপতা আশ্রয় করে আলোচনা করেছেন তা গড়পড়তায় হচ্ছে'‘এ্যাডভোকেসি সাংবাদিকতা বনাম নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা'। এক্ষেত্রে পত্রিকার বর্তমান ভূমিকা সমালোচনাকারী(গণ) প্রথমোক্ত ধারার সাংবাদিকতা বিকাশের পক্ষে এবং পত্রিকাপীয়(গণ) দ্বিতীয় ধারার পক্ষে। পরিহাস হচ্ছে, পত্রিকা বরং ইতোমধ্যে, সেই সমালোচনাকারীদের পর্যবেক্ষণেই, পক্ষপাতিত্বমূলক। কিভাবে, তাহলে, পত্রিকাপক্ষ ঘুরেফিরে সেই জায়গাটা নিতে পেরেছে? আমি এখানে একটা প্রস্তাবনা বিবেচনায় রেখে এগোবার পক্ষে। তা হচ্ছে: পত্রিকা-সমালোচক পক্ষ তাত্ত্বিকভাবে, তার্কিকভাবে সেই ফোঁকরাটা রেখে অগ্রসর হয়েছেন।

তবে এরও আগে এটা বলে নেয়া জরুরি বোধ করছি যে, মশিউল আলম, হতাশাজনকভাবে, কিন্তু প্রত্যাশিতভাবেও বটে, সাংবাদিকবর্গীয় এবং পত্রিকার পরিচালকবর্গীয় (এখানে ফাহমিদুল হক সম্ভবত মালিক বলতে চাইবেন) পেশাজীবিতার সীমানা লোপাট করে দিয়েছেন। আর এই কাজটি এত অনায়াসে সাধন করে সমকালীন সাংবাদিকতায় সংগ্রামীদের থেকে তিনি নিজকে বহুদূরে নিতে সমর্থ হয়েছেন এবং পরিচালকমণ্ডলীর (সংবাদ-জনক/শাসক) কাজকে অনায়াস করে তুলেছেন। কিন্তু ফাহমিদুল হক এ্যাডভোকেসি সাংবাদিকতার পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে আগাগোড়াই নিরপেক্ষতার প্রসঙ্গকে মোকাবিলা করেন নাই। সম্ভবত এটাই আলোচ্য ওই তর্কের সবচেয়ে বড় মোড়।

বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে, বিদ্যাবৃত্তিকভাবে ফাহমিদুল হকের অবস্থান, আরো চূড়ান্ত বিবেচনায়, জন-সাংবাদিকতার পক্ষে। এই অর্থে যে তিনি বর্তমান সংবাদজগতে এর একটা ভিত্তির অভাব বোধ করেছেন। এর ভিত্তি অনুসন্ধান করা, গড়ে তোলার তাগিদ প্রকাশ পেয়েছে তাঁর আলোচনায়। মুস্কিল হচ্ছে, জন-সাংবাদিকতার তথা গণভিত্তিক সংবাদপত্রের হালফিল প্রতিবন্ধকতাসমূহ কী সেটা অনুচ্চারিত থেকেছে তাঁর লেখায়। অধিকন্তু, আলোচনার সূত্রপাতকারী হিসেবে ফাহমিদুল হক সেই তাগিদ প্রকাশ করেছেন 'নিরপেক্ষতা'সংক্রান্ত তাঁর আক্ষেপের পাটাতনে। তাঁর যুক্তিতর্ক নিরপেক্ষতার ধারণাকে নস্যাৎ করে অগ্রসর হয় নাই; একবার সেটাকে মিথ হিসেবে উল্লেখ করলেও এক্ষেত্রে তাঁর আরোহী তৎপরতা ছিল পত্রিকাসমূহের দ্বৈতনীতি কিংবা স্ববিরোধিতা উন্মোচনে। সে প্রসঙ্গে আরেকটু বিশদ কথা বলার ইচ্ছা আমি রাখি, পরে। এখানে আমি মোটেই এই ভাবনা থেকে অগ্রসর হই না যে জন-সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতাসমূহ পর্যালোচনায় একটা সুপারিশমূলক বটিকা ফাহমিদ বানাতে পারতেন। কিন্তু এটা স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা দরকার বোধ করছি যে জন-সাংবাদিকতার ভিত্তি সংবাদ মাধ্যমসমূহের নিরপেতার মতাদর্শকেই ভেঙে দেয়ার অনুশীলনসাপে।

তথ্য, জ্ঞান, নিরপেক্ষতা এবং বাজার

তথ্য ও জ্ঞান সংক্রান্ত ফাহমিদুলের ভাবনা ও অন্বেষণ বিশুদ্ধতাবাদী, অন্তত তাঁর রচনায় সেরূপ প্রতিভাত। ধারাবাহিকতায়, সংবাদমাধ্যমকে তিনি এতদসংক্রান্ত উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন। ফলে জ্ঞান-প্রাসঙ্গিক সমালোচকীয় মীমাংসাদি থেকে তিনি যোজন দূরে অবস্থান করেছেন। তবে জ্ঞান ও তথ্যাদিকে তিনি সমরূপ হিসেবে অনুধাবন করে নিয়ে এগিয়েছেন। এ দুয়ের ভেদ এখানে আলোচ্য নয়। কিন্তু এর উল্লেখ করা জরুরী ছিল কেননা তাঁর লেখাটি হাসান আজিজুল হকের এমন এক উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু হয়েছে যেখানে জ্ঞান প্রত্যয়টি গূঢ়ার্থে প্রয়োগকৃত -- অনুবর্তীভাবে ফাহমিদের সমগ্র লেখায় এই পাটাতনটি অনুমিত বলে ধরে নিতে হয়। বিদ্যমান সংবাদপত্র নিয়ে হতাশা ও প্রত্যাশা তিনি প্রকাশ ঘটিয়েছেন এভাবে লিখে: 'আমরা জানতাম গণমাধ্যম আমাদের তথ্য জানায়। কিন্তু এখন দেখছি গণমাধ্যম আমাদের দিয়ে পণ্য কেনায়। ... তথ্যকে আমরা একটা নিরীহ, নিরপে পদার্থ বলে জানতাম Ñ এখনও আমরা অনেকেই সেরকমই ভাবি। ... যখন আমরা কোনো বিষয় সম্পর্কে তথ্য পাই, তখন সে-বিষয় সম্পর্কে আমাদের জিজ্ঞাসা, প্রশ্ন, অনিশ্চয়তা দূর হয়।' কোন সন্দেহ নেই যে এখানে ফাহমিদের কল্যাণার্থক দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থান তাঁর প্রতিপরে জন্য একটা গরাদবিহীন খোলাজানালা বিশেষ হয়েছে। কিন্তু, বলা দরকার, আমার জন্য, এবং নিশ্চয়ই আরো অনেকের জন্য, তর্কটা নেহায়েৎ দুইজন ব্যক্তির নিবিড় মল্লযুদ্ধ নয়। এই তর্কের মধ্যে আমাদের বসবাসের প্রয়োজন রয়েছে। এ প্রসঙ্গেই উল্লেখ্য, ফাহমিদুল হক তাঁর লেখায় এক জায়গায় মন্তব্য করেছেন যে পত্রিকা তর্ককে জিইয়ে রাখতে চায়। আমি এই মন্তব্য একেবারেই সমর্থন করি না। আমার বিবেচনানুযায়ী জোর দিয়ে বলা দরকার, সমকালীন সংবাদপত্রে বিতর্ক হাওয়া করে দেয়াই মুখ্য তৎপরতা। পত্রিকায় দুইটি মত পাশাপাশি, প্রতিবর্তী প্রকাশ করা আর বিতর্ক গড়ে তোলা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। সংবাদপত্র শিল্পকে মতামত-তৈরির-কারখানা হিসেবে যেসব চিন্তক যুক্তি দিচ্ছেন তাঁদের সঙ্গেও ফাহমিদের এই অবস্থান বিপ্রতীপ। উপলব্ধিযোগ্য যে, সংবাদ-তৎপরতায় যে মত 'দুইটি' প্রকাশিত হয় প্রায়শই সেগুলো অত্যন্ত আয়াসসাধ্য বুদ্ধিপরিকল্পনায় রচিত যথাসম্ভব পরিসীমিত অবশিষ্ট দুইটি মত মাত্র -- যা গ্রহণ করা ছাড়া 'জনসাধারণের' আর কোন রাস্তা খোলা থাকে না। কিংবা এমন বেয়াড়া রকমের অবাস্তব একটি মেরুকে প্রতিপ গড়ে তোলা হয় যা গ্রহণ করা আনুকল্পিকভাবে সম্ভব, কার্যকরীভাবে নয়। অবশ্যই মার্ক্সবাদী যুক্তিতে বাজার প্রসঙ্গের সঙ্গে এই প্রবণতার সংশ্লিষ্টতা দেখানো সম্ভব, জরুরিও; কিন্তু সেটা স্বতন্ত্র কাজ, এখানে অপ্রাসঙ্গিক, এবং আমার অসাধ্যপ্রায় Ñ তথাপি এটুকু উল্লেখ করেছি ফাহমিদের লেখায় বাজার (ও বিশ্বায়ন) ধারণাটির বহুল প্রয়োগের কথা মাথায় রেখে।

মশিউল আলম ফাহমিদের কল্যাণার্থক ভাবনাচিন্তার খোলাজানালা দিয়ে বের হয়েছেন ব্যবসায় প্রশাসনিক বিচণতায়। ফলে তিনি লিখেছেন: '... শুধু জনসেবার উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসার মতো বিনিয়োগকারী এদেশে নেই; সম্ভবত পৃথিবীর কোনো দেশেই নেই। তাই সংবাদপত্র একটা ব্যবসায়িক ভেঞ্চার হতে বাধ্য ...' (মশিউল আলম, ২০০২)। এখানে আমার বক্তব্য খুব স্পষ্ট। 'পত্রিকার কাছ থেকে আমরা কী আশা করি', 'আগে তো তবু ভাল ছিল' ধরনের প্রস্তাবনা নিয়ে জন-সাংবাদিকতার গুরুত্ব দাঁড় করানো, কিংবা সমকালীন সংবাদপত্র শিল্পের একটা তীক্ষ্ণèসমালোচকীয় পাঠ অসম্ভব বলে আমার যুক্তি। আমার এই বক্তব্যের আশু মানে মশিউল আলমের বক্তব্যের সমর্থন করা নয়, সেটা নিশ্চয়ই স্পষ্ট। সত্যিকার অর্থে মশিউল আলমের বক্তব্য খুব সামান্যই ছিল এবং নেহায়েৎ কিছু পরিসংখ্যান নিয়ে ওজর-আপত্তি করা ছাড়া তাঁর সতর্ক বয়ানের সূত্র ধরে বলা যায় এমন কথা খুব সামান্যই। সেটা কাবেরী গায়েন করেছেন, খুব ভালভাবেই (কাবেরী গায়েন, ২০০২)। এ্যাডভোকেসি বনাম নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার শেষোক্তটা নিয়ে মশিউল অগ্রসর হয়েছেন, আর তাঁর কর্মেক্ষেত্রের প্রকাশনার ইতিহাসের কারণেই কিছু স্ববিরোধিতা দেখা দিয়েছে। তিনি যদি গোড়াতে গৃহীত ব্যবসায় প্রশাসনিক কণ্ঠস্বরে অবিচল থাকতে পারতেন, এবং লেখাটা গোটা দুয়েক অনুচ্ছেদ আগে শেষ করতেন তাহলে এটুকু বিপত্তিও তাঁর থাকত না।

মশিউল আলমের বক্তব্য নিয়ে অনেক আলাপবিস্তার করা যায় না, কারণ, আগেই উল্লেখ করেছি, তিনি সংবাদ প্রকাশ-গৃহ ও সাংবাদিকতার পেশাজীবিতার সীমানা রাখেননি। অধিকন্তু তিনি প্রায় প্রথম থেকেই 'পত্রিকা চালানো যে কী কঠিন!' ধরনের জায়গা নিয়ে অগ্রসর হতে পেরেছেন। তিনি তা চেয়েও থাকতে পারেন, কিন্তু চান বা না চান, ফাহমিদের বানানো রাস্তা তাঁকে মসৃণ নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। অধিকন্তু তিনি পত্রিকার উৎপাদন-খর্চা বিষয়ক একটা গাণিতিক হিসাব প্রদান করেন। এবং এর সূত্রে কিছু আগে জানান যে অনেকগুলো পত্রিকা বন্ধ হবার পথে। তাঁর গাণিতিক হিসাবটা সন্দেহাতীতভাবে দূরগ্রাহ্য তবে তাতে তাঁর বক্তব্যের মুখ্য অংশ (একাধিক পত্রিকা প্রকাশের অনিশ্চয়তা) লঘু হয় না। কিন্তু সেখানে তিনি যে পত্রিকা বিপণনের একপেশে ও উদ্দেশ্যমূলক বিবরণী কারণ হিসেবে সামনে আনতে পেরেছেন সেটার কারণ ফাহমিদুল হকের তরফে 'বাজারমুখী' সাংবাদিকতার, বাংলাদেশে, গুরুভার এবং প্রায় ঘ্যানঘ্যানে একটা প্রেক্ষাপট উপস্থাপন। বাজার ও বিশ্বায়ন নিয়ে, প্রসঙ্গত অধুনা বিশ্বায়নকে বাংলাদেশের বর্তমান বাজারব্যবস্থার কারণ ধরে নিয়ে, ফাহমিদ বেশকতক অনুচ্ছেদ লিখেছিলেন। সেখানে তাত্ত্বিক ও চিন্তকদের ভাবনা ও বাক্য উদ্ধৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা তিনি মেলেও ধরেছিলেন। কিন্তু সেই অংশাবলীর বিশেষ দুর্বলতা হচ্ছে বাজার সেখানে আলোচনা-তর্কের জায়গা না হয়ে তাঁর মনভারের কারণ হয়েছে। ফলত মশিউল আলম তাঁর প্রতিক্রিয়ায় 'স্বপ্ন' শব্দটা ব্যবহার করবার সুযোগ পেলেন। এক্ষণে, পরবর্তী পাল্টা-প্রতিক্রিয়ায়, ফাহমিদের খেদ আর্তনাদে রূপান্তরিত হল -- 'তাই বলে কেউ স্বপ্নও দেখবে না?'। এই জায়গাগুলোতে ফাহমিদ মনভার বা খেদের ব্যাপারেই কেবল একনিষ্ঠ। নইলে ধারাবাহিক স্ববিরোধিতায় ভরা তাঁর প্রেক্ষাপট-রচনা, তথা প্রস্তাবনা। দুয়েকটা খোলা ও বিশিষ্ট উদাহরণ ধরে এগোনো যায়। বিশিষ্ট উদাহরণ হতে পারে এই বাক্য দুটি: 'যৌনতা মানুষের মৌল প্রবৃত্তি। তাই এটি সংবাদ-উপাদান।' প্রথমত এই প্রস্তাবনাকে তর্কাতীতভাবে মানা মুস্কিল। কিন্তু সেটা যদি আলোচ্য নাও বানাই, প্রশ্ন আসেÑক্ষুধা কি একই যুক্তিতে সংবাদ-উপাদান? এই বাক্যযুগলের আগের ও পরের অংশের সঙ্গেই এর কোনো সম্বন্ধ পাওয়া কঠিন। তাছাড়া উল্লেখ্য, যৌনতা, পর্নোগ্রাফি আর ধর্ষণ এই ধারণাগুলোর যথেচ্ছ একাকার ঘটিয়েছেন ফাহমিদ। এ প্রসঙ্গে আপাতত আলোচনা না করবার পপাতী আমি। তবে 'যৌনতা' বোঝাতে তৎপর অংশে ফাহমিদ পত্রিকাসমূহের পলিসির সঙ্গে হতাশাজনকভাবে সমভাবাপন্ন হয়েছেন --Ñযখন তিনি পত্রিকার পাঠককে পুরুষ কল্পনা করেছেন এবং নারী প্রসঙ্গে বিপজ্জনক, খুবই বিপজ্জনক, ভাবনা ও দৃশ্যকল্পের পুনরুৎপাদন ঘটিয়েছেন। আমি নিশ্চিত, তাঁর প্রবন্ধের মূল বক্তব্য এসব বিবরণীর সাপেক্ষে ছিল না।

খোলা উদাহরণের মুখ্য জায়গাটাই হল ফাহমিদুল হকের খেদজনিত। তিনি একাধিক তাত্ত্বিকের যুক্তি থেকে হাজির করেছেন কীভাবে অধুনা সংবাদ-শিল্প একটি পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান, কীভাবে তা ভোক্তারুচি নির্মাণে কাজ করে, কীভাবে তা পণ্যশিল্পের পরিপূরক ভূমিকা নিয়েছে ইত্যাদি। কিন্তু এই উপলব্ধি তাঁকে সংবাদপত্র থেকে আশা-করতে-থাকা, বর্তমান প্রতিষ্ঠানাদির অন্য ভূমিকা পালনের ইঙ্গিত প্রদান থেকে বিরত করতে পারেনি। ফলে তিনি বলেন 'কিন্তু বর্তমানে প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশে গণমাধ্যম তার দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।' কিন্তু প্রবন্ধের গোড়াতেই তিনি বলেছিলেন '... এখানকার সংবাদপত্রের মূল কাজ হলো বাজারের সেবা প্রদান করা' ইত্যাদি ইত্যদি। এরকম স্ববিরোধিতার উদাহরণ দেয়া যাবে আরো। তবে সেটা মূল বিষয়ে পৌঁছাতে বাড়তি সাহায্য করবে না। আমার বিবেচনায়, একাধিক চিন্তকের সাহায্য নিলেও, তথ্যের বিপণনযোগ্যতা তাঁকে অশান্তিতে ফেলেছে। সেটা বাক্য ধরে ধরে প্রমাণ করা যায়। তদুপরি এটা তাঁর চলমান ভাষ্যের মধ্যে অনুধাবনযোগ্য। অশান্তির বদলে, জন-সাংবাদিকতা দাঁড়াতে পারে তথ্যের বিপণনযোগ্যতাকে নষ্ট করে দিয়ে, নস্যাৎ করে দিতে দিতে, তথ্যবাছাই ও তথ্যানুসন্ধানের বিদ্যমান পাটাতন আঘাত করে, এমনকি বিরুদ্ধ আলাপ ও ভাবনামণ্ডলীর নির্মাণ ঘটাতে ঘটাতে। এটা একটা বিরুদ্ধ-তৎপরতা এবং যাঁরা করছেন এভাবেই কাজ করছেন। প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র-শিল্প সম্পর্কে দোনোমনা এক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হবে বলে আমার মনে হয় না।

নিরপেক্ষতা একটি উদারতাবাদী ধারণা

বাদী ও বিবাদী উভয়েই নিরপেক্ষতা ও পক্ষাবলম্বনের একটা দ্বিমুখী ঘোরপ্যাঁচে পড়েছেন। তবে মশিউল আলমকে বিশেষ পড়তে হয়নি। প্রথমত তাঁর লব্ধভূমিকা বেছে নেবার মাধ্যমে। মুখ্যত ফাহমিদুল হক বাদী হিসেবে নিজেই নানাকিছু করে বসার কারণে। তিনি (ফাহমিদ) নিরপেক্ষতা ও এ্যাডভোকেসির মধ্যে দ্বিতীয়টি সুপারিশ করেছিলেন, আবার পত্রিকায় নিরপেক্ষতা নেই বলে মন খারাপ করেছিলেন, পত্রিকার নিরপেক্ষতা ঘোষণা যে একটা হঠকারিতা তা আবিষ্কার করে 'আসল' নিরপেক্ষতার একটা ক্ষুধা রচনা করছিলেন, আবার বাজারনির্ধারিত বস্তুপিণ্ড হিসেবে সংবাদপত্রের কর্তৃত্বকে গুরুত্বহীন করে ফেলছিলেন, অধিকন্তু কিছু ব্যাপারে পত্রিকা এ্যাডভোকেসি করে বলে পত্রিকার নিন্দা করছিলেন -- তাঁর মনোযোগী পাঠককুল সমেত ইত্যাকার গোলকধাঁধা উৎরিয়ে তিনি অবশেষে এ্যাডভোকেসি গ্রহণে পত্রিকাসমূহের 'অনিরপেক্ষতা'য় অভিযোগ বা খেদ স্থাপন করতে সমর্থ হন। এখানে পদ ও ভাবনা যে গুরুতর গোলযোগাক্রান্ত সেটা আমার মনে করিয়ে দেবার দরকার হবে না। কিন্তু কেন ফাহমিদুল হকের পক্ষঅবলম্বনকে মন্দ ভাবতে হবে? আমি পাঠ করি, 'পক্ষাবলম্বন মন্দ এবং নিরপেক্ষতা ভাল' এই মতাদর্শিক অবস্থান তাঁকে গোড়া থেকে নাজুক করে রেখেছিল।

জ্ঞান, তথ্য, শিক্ষা এসবের সঙ্গে নিরপেতার ধারণা
ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আলাপ-প্রসঙ্গ হিসেবেও এটা নতুন নয়। গত কয় দশকে বিদ্যাজগতে এ নিয়ে বিস্তর আলাপ হচ্ছে। সাংবাদিকতা, কিংবা অন্য যেকোন শাস্ত্র নিরপে নয় এই ফয়সালাটা শক্তভাবে করে নিলে পরবর্তী ধাপগুলোতে বোঝাপাড়া বা এনগেজমেন্ট সম্ভব হতো। সেটা এড়িয়ে যেতে পেরেছেন মশিউল আলম। অথচ খুব জরুরি জায়গা এটা Ñ বোঝাপাড়া করা দরকার। স্বপ্নালু কিংবা দয়ালু হয়ে কিংবা অংক কষে লোকসান বুঝিয়ে দেয়ার চাইতে সংবাদমাধ্যম নিয়ে আরো সুগভীর বিতর্ক-আলোচনা করা, সম্ভবত, জরুরি।

প্রথম প্রকাশ: 'যোগাযোগ', সংখ্যা ৬, ডিসেম্বর ২০০৩, ফাহমিদুল হক সম্পাদিত, ঢাকা।
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×