somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশ্বাসীদের মা—শুরুর কথা

৩০ শে নভেম্বর, ২০০৭ সকাল ১১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তখন আমি ক্লাস থ্রিতে কি ফোরে পড়ি। বাচ্চা একটা মেয়ে, নিজের জগতে থাকি। একদিন স্কুল থেকে এসে দেখি আমার ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া এক খালাতো ভাই ইউনি শেষে চলে এসেছে, দুপুরে খাবে। মা আমাদের দু’জনের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে গেল। নতুন ইউনিতে উঠলে যা হয়, ভাইয়া তখন নানা ধরণের প্রচুর বই পড়ছে, অনেক ধরণের মানুষের সাথে মিশছে। চিন্তা ভাবনাতে পরিবর্তন হয় হয় করছে। আমি বাচ্চা মেয়ে, আমি যে ওর জ্ঞানী কথা বুঝব না সেদিকে ওর খেয়াল নেই। সে একমনে জ্ঞান বর্ষণ করে যাচ্ছে। আমাকে গম্ভীর মুখে জানালো, আমরা যাদের মানুষ ভাবি, তারা আসলে মানুষ না। বড় বড় নখওয়ালা শ্বাপদ। নখগুলো লুকানো থাকে, তাই আমরা দেখতে পাই না। বিড়ালের যেমন শিকার দেখলেই নখ বের হয়ে যায়, মানুষরূপী শ্বাপদগুলোরও তাই। শ্বাপদ অর্থও বুঝিয়ে দিল বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে আছি তাই।

এতসব মনে আছে কারণ সেই দিনই এমন কিছু বলেছিল যাতে বড় সড় ধরণের ধাক্কা খেয়েছিলাম। মন্তব্যটা ছিল মুহাম্মদ (সা) এর স্ত্রীদের নিয়ে। ভয়াবহ বাজে একটা ইঙ্গিত ছিল তাঁর স্ত্রী সংখ্যার আধিক্যের দিকে, খুবই জীবন্ত এক উপমার ব্যবহার সহ। উপমাটা এত জীবন্ত ছিল যে সেটা সারা জীবনের জন্য আমার মনে দাগ রেখে গেল। আমি ছোট্ট একটা মেয়ে, পুরা মন্তব্য বুঝিও নি, কিন্তু এতটুকু বুঝেছি—যেই মুহাম্মদ (সা) কে নিয়ে কখনও ভালো বই খারাপ শুনি নি, তাঁকে নিয়ে করা মন্তব্যটা ভীষণ খারাপ লাগছে, আর এই মন্তব্যের কোন জবাব আমার কাছে নেই। উপরন্তু, বিশ্রী উপমাটা দশ বছরের আমাকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। আমি কেঁদে টেঁদে অস্থির। ওই বয়সে যা হয়, মাকে গিয়ে বিচার দিলাম। ‘মা, ভাইয়া বলে কি...’।
মা গম্ভীর মুখে ভাইয়াকে ডেকে বলে দিল, এত ছোট মেয়েকে এসব বলা কেন?

ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে এতটুকুই, কিন্তু আমার মনে বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন তৈরির সূচনা বোধ হয় সে দিনই। বড় হওয়ার সময়টুকুতে একটা লম্বা সময় পর্যন্ত প্রশ্নবোধক চিহ্ন কেবলই বড় হয়েছে। প্রশ্ন করেছি, কখনও চাপা বিদ্বেষ নিয়ে, কখনও উদ্ধত হয়ে। তারপরে, এসেছিল উত্তর খোঁজার পালা।

এখানে বলে রাখি, এর কয়েক বছর পরে ভাইয়ার ভীষণ পরিবর্তন। প্রচন্ড অনুতপ্ত আর লজ্জিত হয়েছিল আগের মন্তব্যের জন্য। আল্লাহ তাঁকে কবুল করুক। এই কথাটা বলে নিলাম যাতে কখনও ভাইয়ার হাতে এই লেখাটা গেলে তিনি নতুন করে লজ্জিত না হন।

যা বলছিলাম, একটু বড় হয়ে যখন কিশোরী বয়সের খুব ভালো লাগা আর মুগ্ধতা নিয়ে তসলিমা নাসরীন পড়তাম, কিংবা আরেকটু বড় হয়ে সালমান রুশদী ধরলাম কৌতুহলী হয়ে, কিংবা হুমায়ূন আজাদ হাতে আসল, এবং আরও পরে বাংলা ব্লগিঙের বদৌলতে দেশে বিদেশের স্বঘোষিত বাঙালী/অবাঙালী নাস্তিকদের লেখা পড়া শুরু হলো, তখন বুঝলাম ছোটবেলায় শোনা ওই প্রথম মন্তব্যটা আসলে কিছুই না। মুহাম্মদ (সা) এর স্ত্রীদের নিয়ে আজে বাজে কথা বলে যত বই আর আর্টিকেল লেখা হয়েছে, সেগুলো দিয়ে ছোট খাট একটা লাইব্রেরি হয়ে যেতে পারে। এ এক বিশাল আর্ট ফর্ম। নানা কৌশলে, নানা উপায়ে, নানা কিছু বলা হয়েছে, কুৎসিততম ভাষায়। যাদের ভালো পড়াশোনা নেই, তারা বিভ্রান্ত হয়ে যাবেনই। যারা কখনও শুনেন নি এতসব, শুধু ভালো ভালো কথা শুনে এসেছেন রাসুল (সা) আর তাঁর স্ত্রীদের নিয়ে, তাঁদের সংখ্যাটা এই যুগে বোধ হয় খুব কম। ইসলামের এই একটা দিকে এসব শুনে বিশ্বাস না হারালেও এক 'হীনমন্যতায়' মন আচ্ছ্বাদিত হয়ে যায়। আমি খুব কম বিশ্বাসীকেই দেখেছি এই একটা ব্যাপারে অস্বস্তি বোধ করা ছাড়া কথা বলতে পারে। অনেকেরই আমার কিশোরী বয়সে যা হয়েছিল তা-ই হয়। ‘আসলেও ঘটনা এমন? মুহাম্মদ (সা)... ও মাই গড, সত্যি?’... এই তীব্র অবিশ্বাস আর খারাপ লাগা নিয়ে উত্তর খোঁজার পালা শুরু হয়।

ভাগ্যবতী ছিলাম আমি। নানা সময়ে নানা বই হাতে এসেছিল যেগুলো সব উত্তর যুগিয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্নগুলো কেবল মুছেই দেয় নি, বিষ্মিত আর ক্ষুদ্ধ করেছে আমাকে।

বিষ্মিত হয়েছি এতগুলো মহিয়সী নারীর মহত্ত্ব সম্পর্কে জেনে। শ্রদ্ধায় বিমুগ্ধ হয়েছি। বার বার পড়েও তৃপ্তি আসে নি। ক্ষুদ্ধ হয়েছি নানা কারণে। পৃথিবীর ইতিহাসের এত মহিয়সী কিছু নারীদের সম্পর্কে আগে কখনও জানতাম না কেন? এখন কৌশোরের শেষ দিকে আর তারুণ্যে পৌঁছে এত সব জানছি। কৌশোরে, যখন মেয়েরা আঁতি পাঁতি করে খুঁজে একজন মহিয়সী নারীকে আদর্শ হিসেবে, যাঁর ‘মত’ হওয়ার চেষ্টা করা যায়, সেই সময়টায় আমার হাতে রাসুল (সা) এর স্ত্রীদের নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ার যেসব বই হাতে এসেছিল, তার মধ্যে তসলিমা নাসরীনের নাম আসবে। সে তো প্রশ্ন বোধক চিহ্নটা খুঁচিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এছাড়া, রাসুলের (সা) স্ত্রীদের নিয়ে সত্যিকারের সুন্দর ইতিহাসটা সেই বয়সে পড়ার মত ভাষায় লেখা কোন বাংলা বই তখন হাতে আসে নি। অথচ সময়টা খুব খারাপ ছিল তখন, এখন। আমার বয়সী মেয়েরা মুগ্ধ হওয়ার মত নারীদের খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত, ব্যর্থ হয়ে যায়। প্রায়ে সময়েই সেই শূণ্যস্থানে হলিউড বলিউডের ঐশ্বরিয়া, মাধুরী বা ব্রিটনীরা এসে জায়গা করে নেয়। ঘরের দেয়াল থেকে মনের দেয়ালে বিরাজমান ওই সুন্দরীদের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে আমরা, এ যুগের মেয়েরা, শরীরকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পরি, মনের ঘরটা অবহেলায় পড়ে থাকে। শরিরী শরীরে ম্যানিকিওয়ার-প্যাডিকিওয়ার-উপটান-রূপটান কনসিলিং মেইক-আপের ছাপ পড়ে, মনের শরীর শুঁকিয়ে হাড় জির জিরে হয়। কথাটা খুব ক্লিশেইড, কিন্তু একটা সুস্থ জাতিকে সৃষ্টি করতে হলে সুস্থ মনের মায়েদের ভীষণ প্রয়োজন। বাবাদেরও প্রয়োজন। এখনকার বাবাদের দু’চোখে যদি ঐশ্বরিয়াদের ঘোর লেগে থাকে, তাহলে নিজের ছেলে মেয়েরাও মনের শরীরকে খাওয়ানোর কোন প্রয়োজন দেখবে না। তরতাজা সুন্দর শরীরে হেঁটে বেড়াবে আমাদের পরবর্তী (কিংবা বর্তমান) প্রজন্ম, মৃত, ধুঁকতে থাকা অন্ত:করীন নিয়ে।

ক্ষুদ্ধ হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হলো, কুরআনে যেহেতু রাসুলের (সা) স্ত্রীদের বলা হয়েছে ‘উম্মাহাতুল মু’মিনুন’, ‘বিশ্বাসীদের মা’, তাই রাসুল (সা) এর প্রতিটা স্ত্রী এক একজন বিশ্বাসীর বিশ্বাসের সূত্রে ‘মা’। আপনার মা, আমার মা। অথচ এই আমাদের মায়েদের নিয়ে আমরা এত কম জানি! এত বিভ্রান্ত! আমাদের মা, আমাদের শিক্ষক, আমাদের আদর্শ নিয়ে এত বিভ্রান্ত আর হীনমন্য থাকলে কি হয়?

আমি জ্ঞান, বয়স, প্রাজ্ঞ সব দিক দিয়েই আমার পাঠক মহলের চেয়ে ছোট। তবু, অন্য কেউ এগিয়ে আসছে না বলে, সাহস করে নিজেই কীবোর্ড নিয়ে বসে গেলাম আমার প্রিয় মায়েদের নিয়ে লেখার জন্য। লেখায় প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ অনুপ্রেরনা থাকবে নিচের দু’টো সূত্রের:
১. আসহাবে রাসুলের জীবন কথা (৫ম খন্ড)
২. সোহাইব ওয়েবের বক্তৃতা—‘মাদারস অফ দ্যা বিলিভারস’।

লেখায় আমার ব্যক্তিগত অনুভূতির ছড়াছড়ি থাকবে। ব্যক্তিগত আবেগ আর ক্ষুদ্র দৃষ্টি ক্ষমতার কারণে যা কিছু ভুল থাকবে, তার জন্য আমি আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থী, আল্লাহর কাছে, আপনাদের কাছে। শুধরে দিলে কৃতার্থ থাকব।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০০৭ সকাল ১১:৪২
১১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×