somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নদীরে ও নদীরে তুই একটু দয়া কর, ভাঙ্গিস না আর বাপের ভিটা, বসত বাড়ি-ঘর।(চতুরভূজ)

২৭ শে নভেম্বর, ২০০৭ বিকাল ৫:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভাঙ্গন - এই শব্দটিতেই যেন কেমন এক ভয়াবহতা লুকিয়ে। এই ছোট্ট একটি শব্দ দিয়েই যেন হাজার মনের আক্ষেপ প্রকাশ করা যায়! এতই শক্তি এই ক্ষুদ্র বাক্যটির! আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কতবার আমরা উচ্চারণ করি ভাঙ্গন নামক এই শব্দের। হৃদয় ভাঙ্গার যন্ত্রনা ভুলতে গিয়ে প্রসব করি অগণিত কাব্যের। কষ্টের প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে চোখের বাঁধ ভেঙ্গে উপচে পড়ে নোনা পানির ধারা। তারপর আবার জোড়া লাগাতে বসি ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নের টুকরো গুলো।

এইযে এতসব ভাঙ্গা গড়া যায় তবুও স্থবীর হয়না জীবন, চলতেই থাকে চলতেই থাকে নদীর মতন। হ্যাঁ, এই নদীরই একটি রুপ ভাঙ্গন! প্রকৃতির এই ধ্বংসলীলার কবলে যে পড়েছে কেবল সেই বুঝতে পারবে কতটা ভয়াবহ হতে পারে এই নদী ভাঙ্গন। গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যাচ্ছে ভাঙ্গনের কবলে পড়ে। দরীদ্র গ্রামবাসী ধরে রাখতে পারছেনা নিজের বাপ দাদার ভিটা বাড়ি টুকু। নিজেরই চোখের সামনে রাক্ষুসী নদী কেড়ে নিচ্ছে তার এতদিনের প্রানপ্রিয় ভিটা। যেই উঠোনে সে জমির সোনালী ধান শুকোতো। যেই পুকুরে সাঁতার কেটে বালিকা বধূ পরিনত হয়েছে কুঁজো বুড়িতে! যেই পথে হেঁটে গুটি গুটি পায়ে বাবার সাথে মাছ ধরবার জন্য এগিয়ে চলত গ্রামের কিশোর ছেলে!

একদিন যে মাঝি পদ্মার বুকে মনের সুখে গান গাইতো আজ সেই মাঝির চোখে ঝরে পড়ে পদ্মার জন্য ঘৃনা! তার গলায় আজ আর নেই গান, বৈঠার ছলাত ছলাত শব্দে আর পদ্মার বুকে ঢেউ জাগেনা যেন। আমি দেখেছি বৃদ্ধার ঘোলা চোখের লোনা জল, শুনেছি তার স্বামীর কবর ভেঙ্গে যাবার সময় তোবড়ানো বুকের ভেতরটা ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবার শব্দ! সেই শব্দ কি আমরা একটুও টের পাই যারা বাস করি সুরম্য প্রাসাদে, নিরাপদে? আমি স্বান্তনা দেবার ভাষাও খুঁজে পাইনি। আমি জানিনা তাকে কি বলে স্বান্তনা দেব যার ভিটা বাড়ি তার নিজের চোখের সামনে ভেঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে, কি বলে স্বান্তনা দেব আমি তাকে! নদীর সামনে বড় অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওরা বিষন্ন বদনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে নিজের চীর আপন মাটির তলিয়ে যাওয়া। যে মাটিতে তার বাপ- দাদারা বিচরণ করেছেন, যে মাটির পরে তার বুকের ধনেরা খেলা করে বেড়িয়েছে!

আমি তাকাতে পারছিলাম না ওদের চোখের দিকে, আমি বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, পা দুটো যেন কয়েকশত গুণ ভারী লাগছিলো আমার নিজেরই। তাহলে নদী ভাঙ্গা ঐ শীর্নকায় মানুষদের কেমন লাগছিল!! ছেলে মেয়ে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে নিকষ কালো অন্ধকার দেখে তারা নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিল, জড় বস্তুর মত! বহু দূরের সেই নদী ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে আজ কত কাছে চলে এসেছে, কিন্তু আপন হয়ে নয়, রাক্ষুসী হয়ে! গ্রামের পর গ্রাম উজার করে দিয়েও তার তৃপ্তি মেলেনি, সে আরও চায়, আরও চায়! কেউ ঠেকাতে পারছেনা তাকে। এমন ভাঙ্গন রোধ যেন আমার এই দরীদ্র দেশের সাধ্যের বাইরে!

কিছুই করার নেই আমাদের। এই দেশ অসংখ্য সমস্যার অতলে তলিয়ে। নদীপাড়ের মানুষদের দুর্দশা দেখার সময় নেই কারও। কেউ হয়ত ভাবতেও চায়না কতটা দৈন্য দশার ভেতর বাস করছে ঐসব মানুষ গুলো। নদী ভাঙ্গা কিশোর সবুজ। জিবীকার প্রয়োজনে ঢাকা শহরে রিক্সা চালাতে এসে ট্রাকের চাপায় পিষ্ট হয়ে জীবন হারায়! হায়রে সাধের জীবন, আমারও জীবন তোমারও জীবন আর সবুজেরও জীবন, একই জীবন! জীবনের দাম ধুলোয় লুটোয়। সবুজের মা পাগল হয় সন্তানের শোকে, তোমার আমার কারও কিছু এসে যায়না, আমাদের জীবনের গতি ময়তায় ছন্দ পতন ঘটাবো নাকি ওসব ফালতু কথা চিন্তা করে? আমাকে তো অনেক দূর যেতে হবে, Miles to go before I sleep.

গ্রামের মাতব্বর মসজিদে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছেন, ভাঙ্গন থেকে মুক্তির জন্য, আল্লাহ যদি একটু মুখ তুলে তাকান! হিন্দুরা প্রতিদিন একমুঠো করে চাল দিয়ে যাচ্ছেন নদী মাতা কে - ভোগ পেয়ে যদি মাতা থামেন! কিন্তু প্রকৃতি প্রার্থনার বশ নয়। সে যদি প্রার্থনার বশ হত তবে পৃথিবীর চেহারাই পাল্টে যেত। তবুও মানুষ প্রার্থনার জন্য তাঁর দরবারে হাত তোলে। "বিধিরে তোমার খেয়ালের শেষ নাই,তবু জনম দুখী আমি তোমায় আপন জানি...ও আমার চক্ষু নাই।" ঈশ্বর থাকেন ভদ্র পল্লীতে, আমাদের এই জেলে পাড়ায় ঈশ্বরের দেখা পাওয়া দুষ্কর! - ঐ আক্ষেপ কালের বিবর্তনে আজও তেমনি সতেজ রয়েছে।

একবছর আগে আমার গাঁয়ের যে স্থানটি নদীর অনেক কাছের ছিল তা আজ আরও কাছাকাছি এসেছে , নদীর বুঝি সময় হয়েছে তার আদরের দুলাল কে বুকে টেনে নেয়ার! আমার কিছুই করার নেই, কিছু করার নেই কেবল নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া। পদ্মা পাড়ের মানুষদের কন্ঠে আজ কেবল একটিই সুর-

নদীরে ও নদীরে তুই একটু দয়া কর,
ভাঙ্গিস না আর বাপের ভিটা , বসত-বাড়ি-ঘর।

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০০৭ বিকাল ৫:৪৮
১৪০টি মন্তব্য ০টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×