somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আহাজারি থেমে যাওয়া, কান্না শুকিয়ে যাওয়া সহস্র অসহায় চোখ আর ক্ষুদ্র এই আমি...

২৭ শে নভেম্বর, ২০০৭ সকাল ১১:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




হেঁটে যাচ্ছি; শরণখোলার সাউথখালির ৪নং সেক্টরের ইট বিছানো সদ্য বিধ্বস্ত এবড়ো-খেবড়ো পথ ধরে। এ যেন প্রলয় পরবর্তি এক অন্য জগত। চারিদিকে প্রায় নিশ্চিহ্ন ঘরদোর, গাছ-গাছালি আর নষ্ট হওয়া সোনার ফসল!

পথের দুধারে শত শত ছোট ছোট ঘর। না বাঁশ, কাঠ, খড় কিছুই না, কুড়িয়ে পাওয়া ছেঁড়া কাপড়, বিধস্ত নারকেল-সুপারী গাছের পাতা আর বুভুক্ষু সাহসী শরীর নিয়েই ওরা গড়ে তুলেছে এই ঘর(!)গুলো। তারই ভেতরে গুটি-শুটি হয়ে শুয়ে আছে অসংখ্য মানুষ! আহত, ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত। বাইরে খোলা আকাশের নীচে অনাহারী হাজারো মানুষ। সন্তান, পরিবার আর প্রিয়জনদের একসাথে হারিয়ে ওরা নির্বাক প্রায়। ওদের প্রায় কেউই আর কাঁদছে না। কেবল জানতে চাইছে ঘর-দোর নয়, কাপড় নয় অন্তত একটু খাবার আর পানি ঐ শিশুগুলোর জন্য আমরা দিতে পারি কিনা। খাবার খুঁজে, পানি চেয়ে ক্লান্ত হয়ে অবুঝ শিশুদের অনেকেই মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। ক'জন হতভাগা বৃদ্ধের কাতর চাহনি আমার চলা থামিয়ে দেয়। কাছে এগিয়ে যাই। একটু খাবার আর একটুখানি পানিতেই ওদের মুখে আশার আলো ফুটে ওঠে। আমি ওদের মুখে কেবল খুঁজে পেতে থাকি আমার মা, বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-সন্তানের মুখ। নিজেকে শেখাই ওদের মত সাহসী হতে, শক্ত হতে। ক্ষুদ্র এই আমার ভেজা চোখ আর আলিঙ্গন ওদের কাছে মূল্যহীন।

বুকভরে নিশ্বাস নিয়ে, পা-দুটো শক্ত করে এগিয়ে যাচ্ছি। এ আমি কোথায়? একি বাস্তব না দু:স্বপ্ন! মানুষ কেমন করে এভাবে বাঁচে? এখানে অসংখ্য শিশু আছে যাদের জন্য আর মায়ের কোলের আশ্রয়টুকুও নেই। মা নেই ওদের, আর কোনদিন ফিরবে না। কি হবে ওদের ?

একজন যুবক উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে আমাদের দিকে। আমাদের পত্রিকা টেলিভিশনের লোক ভেবে গড়গড় করে বলে যেতে লাগলো তার সর্বনাশের কাহিনি। ২৬/২৭ বছর বয়স্ক এই যুবক আসলাম আলী মাত্র ঘন্টা খানেক আগেই তার একমাত্র সন্তানের লাশের সন্ধান পেয়েছে। ৪ বছর বয়সি শিশুটি ঐ রাতে ঘুমিয়ে ছিল তার মায়ের বুকে। ভয়াবহ ঢেউয়ের তোড়ে মাসহ শিশুটি কোথায় হারিয়ে যায় কেউ জানে না। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খোঁজ মেলেনি এই ৫ম দিনেও। স্ত্রী-পুত্র, মা-বাবা, ঘর-সংসার হারিয়ে এই যুবক পাথর হয়ে আছে। হাঁটু অবদি কাদা মাটি। জানালো, নিজে হাতেই কোন মতে মৃত সন্তানের সৎকার করে এলো ...! আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হতে থাকে। একটু খাবার আর বিশুদ্ধ পানি ওর হাতে তুলে দিতে হাত কেঁপে যায়।

এগিয়ে যাচ্ছি সামনের দিকে। একটি সংগঠন এদের শুকনো খাবার আর পুরানো কাপড় দিয়ে সাহায্য করছে। হাজারো অসহায় মানুষের ভিড়ে ২০/২১ বছর বয়সী একটি মেয়ে একটু খাবার আর কাপড় পাওয়ার প্রানপণ চেষ্টা করে বিফল হয়ে ফিরে এলো আমাদের কাছে। "একটু খাবার দেন- সকালে ২কেজি চাল সাহায্য পেয়েছি। কিভাবে রান্না করি ঘর নেই, হাঁড়ি নেই, আগুন নেই পানি নেই। চারিদিকে কেবল পচা বিষাক্ত পানি।'' আমার হাতদুটো খুব শক্ত করে ধরে খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলো যেন আমি ওর অবলম্বন, ওর বোন। আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার শক্তি ওর নেই। অন্যদের কাছে জানতে পারি ওর একমাত্র সন্তান, স্বামী, আর বৃদ্ধা মাকে হারিয়ে ও এখন কিছুটা মানষিক ভারসাম্যহীন। চতুর্থ দিনে ৩ বছর বয়সী একমাত্র মেয়ের লাশ খুঁজে পেয়েছে। বাকীরা এখনও আঁধারেই। ও জানে কেউই আর ফিরবে না। তবুও সারাক্ষণ খুঁজেই চলছে।

এমন হাজারো মানুষের বেদনা-দুর্দশা! আমি কার কথা বলবো? ওরা তো অসংখ্য! আর ওদের ক'জনের কথাই বা আমি জানতে পেরেছি?

ত্রাণ নিয়ে ওখানে পৌঁছে গেছেন অনেকেই। খাবার পানি, পুরনো কাপড়, কিছু ওষুধ, পানি বিশুদ্ধ করণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন, লবণ, দেশলাই, মোমবাতি অনেক কিছুই নিয়ে। কিন্তু তার অপর্যাপ্ততা আর সুষ্ঠু বিতরণ ব্যবস্থার অভাবে ওদের অনেকেরই প্রকৃত সাহায্য হচ্ছে কোথায়? আরও দু:খজনক এবং লজ্জার বিষয় হচ্ছে প্রায় সকলেই তাদের সংস্হার ব্যানার প্রদর্শন আর বিভিন্ন মিডিয়ার নজর কাড়ায় ব্যতিব্যস্ত। এমনকি একটি পুরনো ময়লা কাপড় দান করে টিপসই নেয়ার এবং তার ছবি তুলে রাখার আত্মতৃপ্তিও দেখা গেল অনেকের মধ্যে! হায়.....

৭ বছর বয়সী তোফায়েল বাড়ীর ভাগ্যবান শিশু হোসেন বোঝেনা তাদের সর্বনাশের ভয়াবহতা। ও অন্তত মা-বাবা হারায় নি। ও জানে ওদের ঘরদোর নেই, খাবার নেই। কেবল ক্ষুধাই ওকে কষ্ট দেয়। একটা পুরনো লাল রঙের ফুলহাতা সোয়েটার পরে বেশ খুশি। মিষ্টি চেহারাটা ক্ষুধায় ক্লান্ত। একটা পানির বোতল আর সামান্য খাবার পেয়েই মুখে একটুখানি হাসি ফুটে ওঠে। ওর বৃদ্ধাঙ্গুলিতে অনপনেয় কালীর দাগ দেখে আমার প্রশ্নের জবাবে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বললো, " ওরা আমারে এই লাল জামফারটা দিছে। তাই আমার হাতে......." । আমার চোখ ভিজে আসে। বড্ড অসহায় আর অপরাধী মনে হয় নিজেকে। আমার দু'টো পয়সা, একটু পানি আর একটু খাবার এই অসহায় মানুষ আর অবুঝ শিশুদের ক'জনের ক'ফোঁটা সাহায্য?

আমার ঠান্ডা হাত দু'টো আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হোসেনকে। আমার সন্তানের মুখ দেখতে পাই ওর মুখে। বুকের ভেতর এক ধরনের যু্দ্ধ অনুভব করি। মজবুত জুতোর ভেতর অনুভব করি ক্রমশ হীম হয়ে আসা নিজের পা দুটো। ওদের জন্য আমি কি পারি-কতটা পারি? কি হবে ওদের?

ভেতরে ভেতরে আমি কেবল ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে থাকি...!

সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১০ রাত ১২:১০
৫১টি মন্তব্য ০টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২৪


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×