ঔপন্যাসিক হিসেবে তার উত্থানকে মুরাকামি নিজে তাতপর্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা হিসেবে ভাবেন। ১৯৭৭ সালে টোকিওর জিংগু স্টেডিয়ামে বসে প্রিয় বাস্কেটবল টিম ইয়াকুট সোয়ালোর খেলা দেখছিলেন। ডেভ হিল্টনের একটি ডাবল হিট দেখে মজে যান মুরাকামি। ২৮ বছরের মুরাকামি তার প্রথম উপন্যাস লেখায় উদ্বুদ্ধ হন। তার প্রথম উপন্যাসের নাম হেয়ার দি ওয়াইন্ড সিং। এটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের অভিজ্ঞতাÑ বলেন হারুকি মুরাকামি। তার এই সুখীসত্তার পূর্ণতা পায় এক দশক পর নরওয়েজিয়ান উড-এর প্রকাশনার মাধ্যমে। এর আগে তার আরো কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু তিনি তেমন আলোচিত হননি।
নরওয়েজিয়ান উড বইটির প্রকাশ ছিল বিস্ময়কর। আগামীর প্রজন্মকে নিয়ে লেখা উপন্যাসটি আলো ফেলেছিল একটি কলেজ ডরমিটরিতে। আগে লেখা তার যে কোনো কাজ থেকে এটি অধিক সুপাঠ্য ছিল। এর ফলেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় উপন্যাসটি। শুধু বইটির জাপানিজ ভার্সন প্রায় চার মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। তার জীবনের পরবর্তী ১০ বছর তিনি নিজেকে আরো অভিজ্ঞ করার লক্ষ্যে গ্রীস, ইটালি এবং আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এ সময়ে তিনি লিখেছেন, পড়েছেন এবং শিক্ষকতা করেছেন। কোবেতে ভূমিকম্পের পর ১৯৯৫ সালে তিনি জাপানে ফিরে আসেন। সেই ভূমিকম্পে মুরাকামির বাবার বাড়িটি ধ্বংস হয়। সে সম্বন্ধে তিনি বলেন, আমি জানি না, এটি ভালো না খারাপ হয়েছিল। কিন্তু শুধু জানি, সবকিছুই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এটি আমার জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল। আমি বুঝতে পেরেছি, সমাজের জন্য আমার আত্মত্যাগ করার আছে।
লেখকরা মাঝেমধ্যে নিজের দেশেই তেমন সম্মান পান না। মুরাকামির ক্ষেত্রে তেমনটিই ঘটেছে। বাণিজ্যিকভাবে তিনি খুবই সফল। কিন্তু জাপানে সিরিয়াস সাহিত্য ও আপামর জনসাধারণের জন্য ফিকশনের মধ্যে বেশ পার্থক্য করা হয়। টোকিও ইউনিভার্সিটির লিটারেচারের প্রফেসর মিতসুইয়োমি নুমানো বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, যদি একজন লেখক হাই কোয়ালিটির লিটারেচার তৈরি করতে চান তাহলে তার বই তেমন বিক্রি হয় না। মুরাকামি মূলত সমাজের সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে লিখেছেন। তার উপন্যাস কাফকা অন দি শোর তাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ২০০৩ সালে তিনি উপন্যাসটি লেখা শুরু করেন। খুব রুটিন মেপে উপন্যাস লেখেন তিনি। প্রতিদিন ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠতেন। তার পরের পাচ ঘণ্টা কি-বোর্ডে চেপে লিখতেন কাফকা অন দি শোর-এর পান্ডুলিপি। গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাসটি। রিলিজের দিন থেকেই এটি জাপানের বেস্টসেলার লিস্টের শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে।
এর কারণ হিসেবে মুরাকামি তার লেখার সহজ পদ্ধতি ও বোধগম্য স্টাইলটিকেই গণ্য করেন। তার কাজগুলো সাধারণ পাঠকের এন্টারটেইনমেন্টের বিষয়টি লক্ষ্য করেছে। মুরাকামি বলেন, অনেক পাঠকই আমার বই তিনবার এমনকি চারবারও পড়েন। কারণ আমার উপন্যাসগুলো সহজপাঠ্য। কিন্তু গল্পগুলো বোঝা খুব একটা সহজ নয়। এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ এবং দি ওয়াইল্ড আপ বার্ড ক্রনিকল উপন্যাস দুটিতে মুরাকামি কমপ্লেক্স হিমু নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। এতে রয়েছে বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধেক সময়ে জাপানের উপনিবেশবাদের বিষয়টি। তিনি ব্যতিক্রমী কিছু চরিত্র একেছেন। যেগুলো আশা এবং নিরাশা নিয়ে তাদের জীবনকে পুনর্গঠন করতে সংগ্রাম করে যায়। সাহিত্য কি খুবই উচ্চমানের নাকি আপামর জনগণের জন্যÑ এ বিষয়ে মুরাকামি বলেন, কিছু লোক ভাবে লিটারেচার হচ্ছে উচ্চমার্গীয় কালচার এবং এর কেবল ক্ষুদ্র রিডারশিপ থাকা উচিত। আমি কখনোই এমনটা মনে করি না।
বর্তমানে মুরাকামি টোকিওর কাছাকাছি মোটেসান্ডোর একটি অ্যাপার্টমেন্টে থেকে পুরোদমে তার লেখালেখির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এখনো তিনি জিন্স এবং ক্যাজুয়াল শার্ট পরতে পছন্দ করেন। এছাড়া খুবই ধরাবাধা জীবনযাপন করেন তিনি। প্রতিদিন ১০ কিলোমিটার হাটেন, নিয়ম মেনে খাবার-দাবার গ্রহণ করেন, আগে আগে ঘুমাতে যান এবং সূর্যোদয়ের আগেই লেখালেখির কাজ শুরু করেন। মিজুমারু আইজাই নামে একজন লেখক এবং ইলাস্ট্রেটর মুরাকামিকে তিন দশক ধরে চেনেন। তিনি বলেন, মুরাকামি তার জীবনের শুরু থেকেই একই নিয়মনীতি মেনে চলছেন।