'বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখন বসে
বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি কুরান-হাদিস চষে ৷'
পবিত্র কাবা শরিফের ইমামের এই বক্তব্যে ফতোয়ার অসারতা এবং অবৈধতাই প্রমাণিত হয়েছে ৷ অথচ উল্লেখিত খবরটি প্রকাশের পর এদেশের ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি ৷ যারা পান থেকে চুন খসলে জেহাদি জোশে লঙ্কাকাণ্ড বাধায়, তারা চুপ হয়ে যায় ৷ প্রতিবাদ করার সাহস নেই বলে খবরটি দেখেও না-দেখার ভান করেছে ৷
আমাদের বিশ্বাস, ফতোয়াতন্ত্রের মৃত্যুকবচ পবিত্র কাবা শরিফের ইমামের বক্তব্যে নিহিত আছে ৷ কুশিক্ষা-অর্ধশিক্ষাধারী সামন্ততন্ত্রের প্রতিভূ এই নেতৃত্বের সর্বাংশ যে পশ্চাত্পদ মাদ্রাসা শিক্ষাধারী এমন নয় ৷ স্কুল-কলেজে পাঠ-চুকানো কিন্তু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং উদার মানবতাবাদী দর্শনের স্পর্শহীন তথাকথিত শিক্ষিতরাও এদের মধ্যে আছে-অনেকে ফতোয়াবাজের অনুচর-সহচর হিসেবে বিরাজ করছে ৷
পূর্বাপর এদেশে যত ফতোয়াবাজির ঘটনা ঘটেছে তার সবই গ্রামসমাজ কেন্দ্রিক ৷ বলা যায়, ফতোয়াবাজের আবাস এবং ক্ষেত্র, এর উদ্ভব ও বিকাশ ধর্মের প্রলেপায়িত হলেও নিতান্তই গ্রামনির্ভর ৷ নগরজীবনে ফতোয়াবাজি কেবল রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ ছাড়া কেবল দুর্লক্ষ্য নয়; অলক্ষ্য বললেও বোধ করি ভুল হবে না ৷ সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে বাংলাদেশের সমাজবিকাশের গতি অসংলগ্ন ও বন্ধুর ৷ সমাজের অসম বিকাশের কারণে নগর ও গ্রামীণ সভ্যতার উপরিকাঠামো এবং অন্তর্কাঠামোতে অভিন্নতা লক্ষ্য করা যায় না ৷ এই অসম বিকাশগত ভিন্নতা তথা নাগরিক সমাজের মূল্যবোধগত অগ্রসরতা এবং গ্রামীণ সমাজের পশ্চাত্পদতার কারণে ফতোয়ার প্রভাব সেখানেই ব্যাপক ও গভীর ৷
তারপরও বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, গ্রামীণ জীবনে সেই শ্রেণীটিই ফতোয়াবাজির প্রধান শিকার যারা বিত্তবৈভবে দুর্বল, হীন এবং অন্ত্যজশ্রেণীর ৷ যাদের না আছে শিক্ষা, না আছে অর্থ, না আছে গোষ্ঠীবল৷ গ্রাম সমাজের সেই অধিকাংশ অসংগঠিত নিরীহ মানুষই ফতোয়াবাজিতে নিগৃহীত, নিষ্পেষিত, নির্যাতিত ৷ গ্রামের শিক্ষাবঞ্চিত শোষিত সাধারণ মানুষ, যারা সর্বাধিক ধর্মপ্রাণ কিন্তু যাদের ধর্মজ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায়, সেই সরলবিশ্বাসী মানুষদেরই ফতোয়াবাজরা কাবু করতে পারে সহজে ৷ তাছাড়া এখনো এদেশে গ্রামসমাজের স্থানীয় নেতৃত্বের কর্ণধাররা অবক্ষয়ী এবং অবশিষ্ট সামন্ততন্ত্রেরই প্রতিনিধি ৷ ভূমির উত্স থেকে উত্পন্ন বিত্ত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন অল্পবিদ্যা এদের শক্তির কেন্দ্রবিন্দু ৷
প্রসঙ্গত ফতোয়াবিরোধী রায় প্রদানকারী বিজ্ঞ বিচারকদ্বয়ের সিদ্ধান্তের শেষ অংশটি প্রণিধানযোগ্য ৷ সমাজ থেকে ফতোয়াবাজির মূলোত্পাটনের লক্ষ্যে তাঁরা বলেছেন :
"এ বিষয়ে শেষ কথা বলার আগে আমরা একটি প্রশ্নের উত্তর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি৷ প্রশ্নটি হলো কেন একটি বিশেষ মহল মাদ্রাসা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠী গঠন করে ভুল দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে ধর্মান্ধ হয়ে উঠছে? তবে সংক্ষিপ্ত পদক্ষেপ হিসেবে আমরা প্রস্তাব করছি যে, সব স্কুল ও মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তকে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ পাঠ অবশ্যই অন্তরভুক্ত করতে হবে এবং জুমার নামাজের খুত্বায় মুসলি্লদের সামনে এই অধ্যাদেশ তুলে ধরতে মসজিদের খতিবদের নির্দেশ দিতে হবে ৷
আর দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হিসেবে আমরা একই ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি চালু এবং সংবিধানের ৪১ (১) অনুচ্ছেদের আওতায় আইন, জনশৃঙ্খলা এবং নৈতিকতা সাপেক্ষে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণকারী আইনের প্রস্তাব করছি ৷
" এই সমাজে ফতোয়াবাজদের রয়েছে মানুষ-খেকো অবস্থান ৷ তাই কেবল আইন করে ফতোয়াবাজি বন্ধ করা যাবে না, দমন করা যাবে না ফতোয়াবাজদের ৷ এর জন্যে চাই সর্বস্তরের অবহেলিত-দরিদ্র ও শিক্ষা-বঞ্চিত মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসারণ ৷ সেই শিক্ষার মধ্যে থাকতে হবে মুক্তবুদ্ধি, যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান-মনস্কতা এবং মানবিক দর্শন ৷ তবেই আমাদের মাতৃভূমির জন্মান্ধ মানুষ চক্ষুষ্মান হবে, আলোকিত মানুষ হয়ে উঠবে৷ চক্ষুষ্মান-আলোকিত মানুষ কখনো মৌলবাদী হয় না, ফতোয়াবাজ হয় না, অনুগত হয় না এসবের ৷
বিশ্বাসবোধের মানবিক দর্শনে আস্থাশীল, সকল প্রকার অন্ধত্ব থেকে মুক্তি পিয়াসী কবি নজরুল ইসলাম-যিনি স্বয়ং ফতোয়াবাজদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন বহুবার; এবং আমাদের 'দুর্ভাগা দেশের' সমাজসত্য যাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে অবিসংবাদিতভাবে, তাঁর অমর কাব্যবাণী দিয়েই এ-লেখা শেষ করা গেল :
'বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখন বসে
বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি কুরান-হাদিস চষে ৷'
'বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখন বসে / বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি কুরান-হাদিস চষে'--ফতোয়ার নানা রূপ- শেষ পর্ব
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৬টি মন্তব্য ১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
EU বাংলাদেশ, আফ্রিকা ও আরবদের সাহায্য করার চেষ্টা করে।
EU বাংলাদেশকে বিবিধভাবে সাহায্য করে আসছে স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু থেকে; বিশেষ করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গুলোকে সচল করার জন্য সহযোগীতা করতে চায়। আমাদের দেশে ও আফ্রিকায় ভালো যা ঘটছে... ...বাকিটুকু পড়ুন
অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে কোকের আতারোট শিল্প অঞ্চলের কারখানা: ফিলিস্তিনি স্টেইটহুড, স্বনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে অসমম্মান করে।
কোকা-কোলার পূর্ব জেরুজালেমের আতারোট শিল্প অঞ্চলের কারখানাটিকে ঘিরে শুরু থেকেই তীব্র বিতর্ক আছে। এই এলাকাটি আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের অধিকৃত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন
পরিপক্ক প্রেম: মানসিক শান্তি
জীবনের নির্দিষ্ট একটি সময়ে পৌঁছানোর পর, মানুষ যখন পরিপক্ক হয়ে ওঠে, তখন প্রেমের মাপকাঠি বদলে যায়। তখন আর কেউ প্রেমে পড়ার জন্য শুধু সৌন্দর্য, উচ্ছ্বলতা, কিংবা সুগঠিত দেহ খোঁজে না।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রবীন্দ্রনাথের শেষ কটা দিন কেমন কেটেছিল?
১৯৪১ সালে জীবনের শেষ দিনগুলোয় অসুখে ভুগছিলেন কবি। সারা জীবন চিকিৎসকের কাঁচি থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছেন, এবার বুঝি আর তা সম্ভব নয়। হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি চলছেই। কিন্তু কিছুতেই কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন
অশুদ্ধ বেনজীরের ‘শুদ্ধাচার’ পুরস্কারের কী হবে?
যুক্তরাষ্ট্র যখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেনজীর আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, এর সাড়ে ছয় মাস পর সরকার তাঁকে মহিমান্বিত করেছে ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ দিয়ে। সেই হিসেবে বেনজীর... ...বাকিটুকু পড়ুন