somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তীরন্দাজের দৃষ্টিপাত: দ্বিখন্ডিত সত্বার যাতাকলে প্রবাসী ও তাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম?

২১ শে অক্টোবর, ২০০৭ বিকাল ৩:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিজেও প্রবাসী, আর তাই প্রবাস সংক্রান্ত একটি প্রশ্ন অনেক সময়েই নড়াচাড়া করে ভেতরে। প্রবাসে পরবর্তী প্রজন্মের জাতীয়তা কি? কাগজে কলমে অনেকেই বৃটিশ, কেউ কেউ আমেরিকান, কেউবা জার্মান। আবার কেউ কেউ বাংলাদেশীই রয়ে গিয়েছেন। কাগজে কলমে কার কি জাতীয়তা আলোচনার মূল বিষয়বস্তু নয়। আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে, এরা মনে, শিক্ষায়, মননে কোন জাতীয়তাবোধ নিয়ে নিজেদের স্থান করে নিচ্ছেন পৃথিবীতে।

রাষ্ট্রের, সমাজের, মানুষের বিবর্তন পৃথিবী পরিবর্তনশীলতার সাথে তাল মিলিয়ে আপন গতিতেই ঘটে যাচ্ছে। আমরা কেউ কেউ গা এলিয়ে দিই তাতে - কখনো নির্ভাবনায়, কখনো চারিদিকে তীর্যক নজর রেখেই , কেউ কেউ আপ্রাণ চেষ্টা করি সেই বিবর্তনকে ঠেকিয়ে রাখতে। কেউ কেউ নিরাপদ দুর থেকে দেখে মুচকি হাসেন অবহেলায়। বিবর্তিত হচ্ছে সমাজ, বিবর্তিত হচ্ছে ভাষা, নতুন আচারে সাজানো হচ্ছে রূচিবোধের পেয়ালা। গতকাল যা অসহনীয়, অসুন্দর ছিল, আজ তা বাদ দিলেই চলে না। এখনকার ভাষায় এই মুহুর্তে যা গ্রহনযোগ্য, তা হচ্ছে 'ইন', আর তার উল্টোটা হচ্ছে 'আউট'। এই ইন আর আউটের জোরেই চলছে সব, কাল যা ভাল ছিল, আধুনিক ছিল, এই ইনআউটের কল্যানেই আজ পঁচা নর্দমাকে আরো বেশী দুর্গন্ধে ভরাচ্ছে।

আপনারা হয়তো ভাবছেন, এমন একটি ভারিক্কি প্রসঙ্গের অবতারনার পর তীরন্দাজ আবার ইনআউটে মাতলো কেন? এই ইনআউটের জোরে ভেসে যাচ্ছে সমাজ, সংসার সব, তীরন্দাজ তো কোন ছাড়! এ সত্যটাকেই তুলে ধরলাম এভাবে। তারপর দেখা যাক না, কোথাকার জল কদ্দুর গড়ায়।

আমাদের অনেকেই নিজ দেশে যতো না, প্রবাসে আরো বেশী আমাদের দেশীয় ও জাতীয় ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চাই। এই ধরে রাখার প্রকাশ একেকজনের বেলায় একেক রকম। দেশে থাকতে যে সব লোকগীতি একেবারেই শুনতে চাইতাম না, এখন ঘর অন্ধকার করে সে সব লোকগীতিতে ডুবে গিয়ে নিজের আত্মা ও মানসকে তৃপ্ত করি। দেশে শুটকী পছন্দ করতাম না, এখন কারো কাছে পেলে কনুই ডুবিয়ে খাই। এমনি ভবেই বিভিন্ন প্রবাসী বিভিন্ন পথে দেশের সাথে তাদের সংযোগ। কেউ আকড়ে ধরেন ধর্ম, কেউ সংস্কৃতি, কেউ খাবার দাবার, কেউ কেউ ভাষা।

আমাদের কথা বললাম, ইনআউটের কথা বললাম, প্রবাসী প্রসঙ্গও আনা হলো, এবার এই পটভুমিকাতেই টেনে আনতে চাইছি আমাদের উত্তরসুরীদের কথা। এদের উপর অনেকগুলো প্রভাব। আমরা যতগুলো প্রভাবের আওতায় পড়ি, তারচেয়ে অনেক অনেক বেশী ও তা ক্রমশ: বেড়েই চলেছে।

ক) যেহেতু এদের জন্ম দেশের বাইরে, বাংলাদেশ তাদের পিতৃ-মাতৃভুমি হলেও জন্মভুমি নয়। এরা এই প্রশ্নে এদের অনুভুতিকে দু’টি ভাগে ভাগ করতে বাধ্য হন।

খ) অনেক বাবা মায়েরা দেশী ঐতিহ্য ধরে রাখার আপ্রান চেষ্টা করে থাকেন। এর মাঝে ছেলেমেয়ে ও বাবা মায়ের মাঝে আদান প্রদান যতোনা বেশী, তার চেয়ে বেশী চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা। তাতে দুই জেনারেশনের মাঝে এক ফাঁক সৃষ্টি হয়।

গ) এরা তাদের বয়েসের কারণেই ‘ইনআউটের’ প্রভাবে অনেক বেশী প্রভাবিত হতে পারেন। আর্থিক সচ্ছলতা এই প্রভাবকে আরো বেশী শক্তিশালী করে।

ঘ) এদের ঘরে বাইরে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি। এই দুইএর ভেতর যতো কম আদান প্রদান, ততো বেশী দ্বৈত সত্বার প্রভাব পড়ে এদের উপর।

ঙ) ঘরে বাইরে আলাদা আলাদা ধর্ম হলে, তার প্রভাবাহ্নিত হন এর। অনেক সময় ধর্মের বিশ্বাসী প্রভাবের চেয়ে সামাজিক প্রভাব অনেক বেশী শক্তিশালী।

আরো অনেক প্রভাব থাকতে পারে। বাবা মায়ের নিজেদের শিক্ষা, প্রবাসী সমাজে তাদের নিজস্ব অবস্থান, সে সমাজের সাথে তাদের আদানপ্রদান, এ সবগুলো বিষয় তাদের ছেলেমেয়েরকেও প্রভাবাহ্নিত করে ।

লন্ডনে এ ও শুনেছি যে, ধার্মিক পরিবারের ছেলে মেয়েরা সকাল বেলা বাড়ী থেকে বের হবার সময় দেশীয় ও ইসলামী পোষাক পড়ে নেন যাতে বাবা মায়ের সাথে কোন দন্ধ তৈরী না হয়। পথে কোথাও কোন বন্ধুর বাড়ীতে তা পাল্টে ইউরোপীয় পোষাক পড়ে নেন, যাতে স্কুলে বা কলেজে স্থানীয় সহপাঠিদের কোন কটাক্ষ না শুনতে হয়। বাবা মায়ের চাওয়া ও সহপাঠিদের কটাক্ষ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবেই মেনে নিয়ে নিজের সত্বাকে দ্বিখন্ডিত করতে হয় তাদের। এই দ্বিখন্ডিত সত্বাকে সারাজীবন বয়ে বেড়ানো খুব সহজ কথা নয়। পরিনামে হতাশা আসে, নিজেদেরকেই নিজেদর কাছে অচেনা মনে হয়।

জার্মানীতে দেখেছি, স্বামী সারাদিন রেষ্টুরেন্টে কাজ করেন, আর ধার্মিক স্ত্রী সারাদিন হিজাব পড়ে বাড়ীতে। বাড়ীতে সারাদিন টিভি-ভিডিও চলছে, চলছে বলিউড ছবির রগরগে নাচ। ছোট শিশুরা এরই মাঝে বড় হচ্ছে। কোন আবদার করলেই বসিয়ে দেয়া হচ্ছে টিভির সামনে। এই শিশুগুলোর ভবিষ্যত কি? বড় হয়ে এরা কোথায় নিজেদের স্থান খুজে নেবে? বাংলাদেশে? কতটুকো সম্ভব? দেশের বাইরে বড় হয়ে ক’জনইবা বাংলাদেশে ফিরে যেতে চায়? যেখানে বড় হচ্ছে, সেখানে? তাদের ছোটবেলার অশিক্ষার কারনে ওদের চেয়ে মননে, চিন্তায় এ আত্মিক অনেক এগিয়ে তাদের সমবয়েসীরা। বাস্তবিক কারণেই তাই দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হয়েই চালিয়ে যেতে হবে তাদের জীবন। আমরা এভাবে অনেক অনেক দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক তৈরী করে যাচ্ছি পৃথিবীর বুকে। এদেরকে আত্মিক নিভর্রতার পথ দেখানো ছাড়া এর কোন বিকল্প নেই।

কোন এক ভাষা ও বিবর্তন গবেষক বলেছিলেন দু’শো বছর পর বৃটিশ আর আমেরিকান ইংরেজী বিবর্তিত হতে হতে দু’টো আলাদা ভাষাই হয়ে যাবে। আজকাল দেশ বা বিদেশ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাংগালীদের মুখে যা বাংলা শুনি, তা ভাবলে এই বিবর্তন আরো স্পষ্ট হয় । প্রথমত প্রচুর বিদেশী শব্দের মিশ্রণ, তারপর উচ্চারণের এমনি এক অদ্ভুত ভঙ্গী, মনে হয় ঠোট আর ধনির বৈরীতা চলছে সারাক্ষণ। আমার কাছে হাস্যকর বো পীড়াদায়ক মনে হলেও মেনে নিতে হবে একদিন। একদিন দু’দিন হয়তো প্রতিবাদ করবেন আরো কেউ কেউ, তারপর এটাই বাংলা ভাষা হয়ে দাঁড়াবে। “বাংলা বললে শুধু বাংলাই বলুন”, এখনকার পৃথিবীতে এ বক্তব্য আপাতত: ‘আউট’!

বিবর্তনকে ঠেকিয়ে রাখার সাধ্য আমাদের কারোরই নেই। চোঙ্গা প্যান্টের ফ্যশান পাল্টে যখন ঢোলা প্যন্ট পড়ার ফ্যাসান প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন সে ফ্যসানের প্রতি বৈরীতা প্রকাশের জন্যে যারা সাধারণভাবেই ঢোলা প্যন্ট পড়তেন, তারা চোঙ্গা পড়া শুরু কললেন। যারা ফ্যসান বিরোধী তারা তাদের বিরোধীতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে হলেও পরোক্ষ ভাবে ফ্যসান প্রতিযোগীতায় যোগ দিতে বাধ্য হলেন। বিবর্তন তাই বহমান নদীর মতো। কিন্তু এই বহমান নদীকে থামানো নয়, সঠিক পথে প্রবাহিত করা সামাজিক চিন্তার একটি দরকারী দিক। আমরা যেনো সবাই এ পথটি খুজে পাই, যাতে আমাদের উত্তরসুরীদের অপরিচিতির অন্ধকারের মুখোমুখি না হতে হয়।
২৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×