somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাকা পেপে

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৭ সকাল ১১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পাকা রাস্তা বহিয়া যাইতেছে। দোকান পাট, ঘর-বাড়ী, দালান-কোঠা একে অপরের উপর যেন আছড়াইয়া পড়িতেছে। ছোট বড় গাছ গাছালীতো যেন উড়িয়া পিছনে পালাইয়া যাইতেছে। দূরের কালো কালো পাহাড়গুলি যাই যাই করিয়া অবশেষে বিদায় জানাইলো। খাল-বিল গুলি ছোট বড় সাপের মত আকিয়া বাকিয়া সবুজ মাঠ, পথ-ঘাট ফাড়িয়া নদিতে আছড়াইয়া পড়িলো। তন্দ্রাচ্ছন্ন আছিলাম, সম্বিত ফিরিয়া পাইলাম। প্রবল বাতাস তুলিয়া আমাদের বাস খানি ছুটিয়া চলিলো গন্তব্যে। মোহিত হইয়া বাহিরের দৃশ্য গিলিতে লাগিলাম।

সময় আর স্রোত নাকি কাহারো লাগি থামিয়া থাকে না। কথা সইত্য, বাস আমাকে নামাইয়া দিয়া আপন পথে ছুটিয়া চলিল। বাসের দোলাদুলিতে এইরূপ অবস্থা হইলো যে পথ হাটিতেও সব দুলিয়া উঠিলো। আমি রোমাণ্চিত অনুভব করিলাম। ক্ষানিক পরই সামনে বিশাল জনসমগম আবিষ্কার করিলাম। আজ বোধ হয় এই গ্রামে হাট বসিয়াছে। এই জনসমূদ্র ভেদ করিয়া গন্তব্যে যাইব কি করিয়া ভাবিতেই দোলাদুলি উধাও হইয়া গেলো। কানে বাধিলো খদ্দের আর দোকানীর দর কষা-কষি।

প্রথমেই মাছের বাজার, তারপর কাচা বাজার আর এরপর যা দেখিলাম, তাহাতে আমি খাড়াইয়া দাড়াইলাম। ছোট্ট একখান কালবর্টের পাশে এক বৃদ্ব বসিয়া আছে। দেখিলাম, তাহার সম্মুখে দুইখানা পাকনা পেপে। পাকিয়া সেইগুলি কেমন লালাভ আকার ধারন করিয়াছে। বড়ই লোভ হইতেছিলো। আমার আবার পাকা পেপের বড়ই সখ। তদুপরি, আমার বাবাজান, দাদাজান এর প্রিয় ফল এই পেপে। ভাবিলাম একখানা আমার আরেক খানা তাহাদের লাগি লইবো। না না, দেড়খানা আমার আর আর্ধেকখানা তাহাদের। না না... দুইখানাই আমার। ধুর... কি ভাবিতেছি! সাতপাচ ভাবিতে ভাবিতে বৃদ্বের নিকট আগাইয়া গেলাম।

কইলাম, "চাচাজান, পেপে কি দর??" এই প্রথম বৃদ্ব আমার পানে চাহিলো। কুচকাইয়া যাওয়া গালের চামড়া, সেই মাঝে চিকন চিকন দুইখানা ঠোট, হালকা সাদা দাড়ি প্রসারিত তাহার বক্ষ অবধি। চোখা সরু নাসিকা, কপালে শতাধিক ভাজ, তাহারি ঠিক নিচে একজোড়া চক্ষু বৃদ্বের যৌবন ধরিয়া রাখিয়াছে। সেই চক্ষুতে জ্যোতি ঠিকরাইয়া পড়িতেছে। চোখাচোখি হইতেই সেই জ্যোতিতে আমার বিজ্ঞ পোকা শিহরিত হইলো।

বৃদ্ব কহিলো, "বাবা, কিনিলে দুইখানা একত্রে কিনিতে হইবে, দুইখানার দাম দুইশত টাকা।"

শান্ত আদুরে কন্ঠে আমার বিজ্ঞ পোকা আমারে কহিলো, "এই লোকেরে তো চারশত টাকা দেয়া যায়।" আমি পোকারে কইলাম, "আমার পকেটে যে মোটে আশি টাকা রহিয়াছে!" বৃদ্বের কথায় আমি হতাশ হইলাম। কিন্তু জায়গায় খাড়াইয়া রইলাম। মুখে কইলাম, "ও আইচ্ছা...।"

"চাচাজান, একখানা বেচিলে কি হইবে?", গলা নামাইয়া আরজির স্বরে কইলাম।
"এক খানা বেচিলে আরেক খানা লইয়া বিপদে পড়িব, বেলা পড়িয়া যাইতেছে, লোকে এক খানা পেপে লইতেও চাহে না। লইলে দুইটাই লইয়া থাকে। বাবা তুমি কি শ্বশুরালয়ে যাইতেছ?"

বৃদ্বের একটানা কথা শেষে অপ্রস্তুত হইয়া কইলাম, "শ্বশুরালয়!!?? জ্বি না। আমি আমার দাদুর বাড়ী যাইতেছি। দাদু পেপে পছন্দ করেন তাই পেপে দেখিয়া কিনিবার লাগি খাড়াইলাম।" মনে মনে ভাবিলাম, শ্বশুরালয়ে জোড়া পাকা পেপে!! মন্দ হইবেনা। কিন্তু আশি টাকা পকেটে, তক্ষনা বিবাহ করিতেও মন চাহিলোনা...।

"কোন গ্রামে যাইবা?"
"জ্বী, রমায়েরখীল গ্রাম, মিয়াজী বাড়ি যাইবো।"
"মঈনউদ্দিন মিয়াজী বাড়ি? তোমার দাদু কি করেন?"
সম্মতি সূচক মাথা নাড়াইয়া কইলাম, "জ্বী! দাদু এই বাজার মসজিদের মুয়াজ্বিন আছিলেন, আপনি চিনেন?
"চিনি বইকি!! আপনার দাদু আর আমি পরম বন্ধু ছিলাম!!", বলিতে বলিতে উনি খাড়াইয়া দাঁড়ইলেন। আবারও বৃদ্বের সহিত চোখাচোখি হইলো, বিজ্ঞ পোকা আবারও শিহরিত হইলো।
আমি কইলাম আজকে বিক্রি রাখেন, "আমার সহিত বাড়ি চলেন।" এক কথায় বৃদ্ব রাজি হইয়া গেলো। তক্ষনা গামছা গলায় জড়াইয়া তিনি আমার সহিত রওয়ানা হইলেন। এতকাল উনি কোথায় আছিলেন, কি করিয়াছিলেন, কাহার উষ্ঠা খাইয়া এতকাল পরে আবার এইখানে পথে বসিয়াছেন, সেই কাহিনি পাড়িলেন। আবার ইহাও কইলেন যে তাহার একমাত্র ইয়াতিম নাতনির স্কুলের ভর্তির পয়সা যোগাড় করিবার লাগিয়াই ঐ পেপে বিক্রয়! তিন কিলো কাচা রাস্তায় রিকশা চালক আর আমি বৃদ্বের সেই কাহিনী শুনিলাম, অবশেষে বাড়ি আসিলাম।

দুই বন্ধুর পুনর্মিলন হইলো। কথা যেন তাহাদের আর পুরায়না। রাতে আয়েশি ভোজন পর্ব শেষে খোলা উঠানে মাদুর পাতিয়া গল্পের আসর বসিলো। হালকা ভোজন পরবর্তী খাদ্যাদি, নারিকেল পিঠা, আরো কি কি জানি আনা হইলো। চন্দ্রের আলো-অন্ধকারে সেইগুলি খাইতে খাইতে ইতোপূর্বে খাওয়া ভাত হজম করিতেছিলাম। এক খানা পেপে মুখে লইলাম, আহা কি স্বাদ। ধণ্য ধণ্য..। চন্দ্রের আলোয় ভাবিতে লাগিলাম, আমি যেন শ্বশুরালয়ে আছি। অনেক রাত অবধি আসর চলিয়াছিলো বোধ করি, নিজেকে আবিষ্কার করিলাম কোনো এক চৌকিতে। আমি নাকি উঠোন হইতে টলিতে টলিতে গিয়া সেই চৌকিতে ধপাস করিয়া পড়িয়াছিলাম।

ঐ অবস্থায় দন্ত মাজিতে পুকুর ঘাটে গিয়া দেখি দুই দাদুর গোপন আলাপন চলিতেছে। কচিত পরে বিদায় পর্বে আমি খেয়াল করিলাম মেহমান দাদুর দুইখানা পেপে তাহার হস্তে নাই। আমার পিলে চমকাইয়া উঠিলো, তাহা হইলে গতকল্য রাইতে আমি ঐ পেপে গুলাই খাইলাম, যেইগুলি এই দাদু তাহার নাতনির স্কুলে ভর্তির খরচা যোগাড়ের লাগি আনিয়াছিলো!! আমার চোখে মুখে হতবাক ভাব উদয় হইলো। মেহমান দাদুর দিকে তাকাইতেই দেখি তিনি আমার দিকেই তাকাইয়া আছেন। উনি মনে হ্য় আমার অবস্থা ধরিতে পারিয়াছিলেন। মুখে কিছুই কইলেন না, অদ্ভূত হাসি খেলা করিতেছে তাহার মুখে। শুধু তাহার সেই জোড়া চক্ষু আরেকবার ঝিলিক দিয়া জ্যোতি ছড়াইলো। আমার বিজ্ঞ পোকা আবারও শিহরিত হইলো। আমি তাকাইয়া রইলাম তাহার চলিয়া যাওয়ার পথে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০০৭ দুপুর ১২:২৯
১২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পথ হারিয়ে-খুঁজে ফিরি

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৩


মনটা ভালো নেই। কার সাথে কথা বলবো বুঝে পাচ্ছি না। বন্ধু সার্কেল কেও বিদেশে আবার কেও বা চাকুরির সুবাদে অনেক দুরে। ছাত্র থাকা কালে মন খারাপ বা সমস্যায় পড়লে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×