তারপর বুঝে না বুঝে গিটারে টুং টাং করতে করতে ক্লাস ইলেভেন।
মুনতাসীর সিরাজ ভাইয়ের কাছে ছুটিতে গীটার শিখতো। আর আমি ছুটির পর কলেজে এসে অর কাছ থেকে ওইগুলা দেখতাম। আমার ভাগ্যটা ভালো বলতে হয় প্রথম music teacher হিসেবে stereotype কাউকে পাইনি। মুনতাসীর আর আমি দুজনেই মিউজিকের ভেতরের মেরুদন্ডটা খুঁজে বেড়াতাম... কিভাবে গান হয়...কিভাবে সেই গানে chord বসে...সব ঘেঁটে বেড়াতাম। ভাগ্য ভালো (কিংবা খারাপ) ছিলো বলতে হয়, আমাদের ছিল ক্যাডেট কলেজের সমৃদ্ধ লাইব্রেরী, অনেক অন্নেক বই ছিলো, প্রায় সব বিষয়ের উপরই! ওখান থেকে music grammer সম্পর্কে যতটুকু পারতাম জেনে নিতাম। অসীম আগ্রহ ছিলো আমাদের। বসে বসে গান বানানোর সাহস পর্যন্ত করে বসলাম। আর কলেজ থেকে যেকোন কম্পিটিশনের আগে ২/৩ মাসের জন্যে বাইরে থেকে সংগীত শিক্ষক আনা হতো প্রতিযোগীদের তৈরী করার জন্যে । ওই সুবাদে কিছু শিক্ষক যাদের নাম মনে রাখতে পারিনি তাদের কাছ থেকে শাস্ত্রীয় সংগীতের খুবই সামান্য পরিমান নির্যাস পেয়েছিলাম।
ওনাদের কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
এটা নিয়ে একটা মজার কাহিনী না বললেই নয়। এই শিক্ষকদের মধ্যে একজনকে নেয়া হয়েছিলো শিশু একাডেমী থেকে। ওনাকে শুধুমাত্র গানের তালিম দেয়ার জন্য কন্ট্রাক্ট করে বছরে দুয়েকবার নেয়া হত কলেজে। ওনাকে আনা এবং ফিরিয়ে দিয়ে আসার জন্যে কলেজ থেকে গাড়ী পাঠানো হত। একদিন দেখা গেলো ওনাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসার পর গাড়িতে বড়সড় Dent পড়েছে। ড্রাইভারকে চাপ দিতে বেরিয়ে এলো, সেই স্যার গাড়ী করে ফেরার পথে ড্রাইভারকে ম্যানেজ করে তার পরিবার শালীদের নিয়ে একটু ঘুরতে গিয়েছিলেন। তখনি এক্সিডেন্টটা হয়। মজার কথা হচ্ছে মানুষের সাথে কথা কাটাকাটির সময় উনি নাকি খুব জোর গলায় নিজেকে ক্যাডেট কলেজের "সঙ্গীত বিভাগের প্রভাসক/শিক্ষক" হিসেবে পরিচয় দিচ্ছিলেন। এই ঘটনার পর উনাকে আর কখনো কলেজে আনা হয়নি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই শিক্ষকটি আমাকে অনেক মজার টেকনিক শিখিয়েছিলেন। তাই সবসময় উনার প্রতি একটা শ্রদ্ধাবোধ ছিল। উনার নামটা কখনোই আমার মনে থাকেনা।
অনেক বছর পর ২০১০-এর দিকে ওনার সাথে আমার দেখা হয়। তখন ওনাকে বলেছিলাম, "স্যার! আপনার কাছে গান শিখতে চাই।"
উনি বলেছিলেন, "ভালো কথা বলেছো। বাংলাদেশ টিভি থেকে একটা অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। বিভিন্ন বিভাগ থেকে শিল্পী বাছাই করা হচ্ছে। এদের দিয়ে প্রায়ই গান করানো হবে। ওখানে শিল্পী বাছাইয়ের জন্যে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তুমি আমাকে রেজিস্ট্রেশন ফী টা দিয়ে চলে এসো। ফী ২০০০/=...... আর আরেকটা ব্যাক্তিগত অনুরোধ। আমার গুরুজী অসুস্থ, ওনাকে ইন্ডিয়া নিতে হচ্ছে। আমার কিছু টাকা দরকার। যদি পারো কিছু দিয়ো।"
শেষ কথা হচ্ছে প্রচন্ড অর্থকষ্টের সংসারেও আমি ৫০০ কি ১০০০ টাকা জোগার করে ঊনাকে দিয়েছিলাম এই বলে যে স্যার এখন আমারটা আপনি দিয়ে দিন। আমি কষ্ট করে হলেও কিস্তিতে ধীরে ধীরে পুরোটা আপনাকে দিয়ে দিবো। কিন্তু পরে আর কখনো উনার থেকে কোন ডাক পাইনি।
-----------------------♣------------------------
অনেকে বলেছিলো action নিতে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, এই মানুষটাকে কখনো গুরুদক্ষিনা দেয়া হয়নি আমার। যত সামান্যই শিখিনা কেন, ২০১০ পর্যন্ত যা কিছু করেছি তা তো ওইটুকু সম্বল করেই! এই ক'টা টাকা নাহয় দিয়েই দিলাম ওনার চরনে। এর পর দুয়েকবার উনার সাথে আমার পথে দেখা হয়েছিল। উনি বলেছিলেন, "তুমি তো আর এলেনা।"
আমি বলি, "সময় পাইনি স্যার।" হাসিমুখে দুজন দু'দিকে চলে গেছি। আমার জীবনে কারো কাছি শিখতে পারিনি বলেই হয়তো যাদের কাছে বিন্দু পরিমাণ হলেও শিখেছি তাদের সবার প্রতি আমার এই অদ্ভুত শ্রদ্ধাবোধ।