somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প : যাই (কিস্তি ২)

১৮ ই জুন, ২০০৭ সন্ধ্যা ৭:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১.২

পেছনে তাকিয়ে নিজের বসত বাড়িটিকে আরেকবার দেখলেন। দেখতে পেলেন না, জোহরা বেগম তখনো দাঁড়িয়ে আছেন গেটের কাছে, ঝাপসা দুই চোখ তাঁরই দিকে।

বাড়ির দিকে চোখ ফিরিয়ে এবারক হোসেনের মনে হলো, এই বাড়িটিকে কি তাঁর জাগতিক অর্জনের প্রতীক মনে করা যেতে পারে? হয়তো পারে। ছেলেমেয়েদের মানুষ করার সঙ্গে সঙ্গে একই রকম যত্নেœ-ভালোবাসায় অনেক বছর ধরে বানানো। দেড় হাজার টাকায় সাড়ে চার শতক জায়গা যখন কিনেছিলেন বাড়ি করার জন্যে, এদিকে বসতি তেমন ছিলো না। শহরের শেষ মাথায় বাঁশঝাড় ঘেরা জায়গাটিতে বাড়ি তুলে শখ করে নাম দিয়েছিলেন - বনান্ত। হিসেব করে দেখলে পঁয়ত্রিশ বছরের বাস এই বাড়িতে। এতোটা সময় চলে গেছে, বোঝা তো যায়নি!

শীতের রাতের জনহীন অন্ধকার রাস্তায় রিকশা এগিয়ে যায়। সরু পীচঢালা রাস্তা, দুটো রিকশা কোনোমতে মুখোমুখি পাশ কাটাতে পারে। এবারক হোসেন যখন এখানে বাড়ি তুলতে শুরু করেন, সেই সময় ছিলো কাঁচা মাটির রাস্তা। একদিন ইট বসলো, পীচ ঢালা হলো তারও অনেক পরে। দু’পাশে খানিক দূরে দূরে ল্যাম্পপোস্ট। নামেই ল্যাম্পপোস্ট, আলো জ্বলে না বেশিরভাগ সময়। সেই বাঁশঝাড়ের অনেকটাই এখন নেই। মানুষের নতুন নতুন বসতির বিস্তার ঠেকায়, এমন সাধ্য কার!

বাড়ি তৈরি শুরু হওয়ার সময় কাছের প্রতিবেশী বলতে ছিলো রাস্তার উল্টোদিকে আলতাফ কন্ট্রাকটর আর তার পরের বাড়ির তোতারা। তোতার ছোটো বোন আঙুরকে বিয়ে করেছে এক পুরনো ছাত্র, মোহাম্মদ আলী। পরে ওদেরও বাড়ি উঠেছে তাঁর বাড়ির ঠিক পুবদিকের সীমানা ঘেঁষে।

রাস্তায় মানুষজন একেবারে নেই, দু’পাশের বাড়িগুলোও ঘোর অন্ধকারে ডুবে আছে এখন। এতোদিনের প্রতিবেশীরা কেউ জানে না, মনে মনে এবারক হোসেন বিদায় নিতে নিতে একেকটা বাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছেন।

মোহাম্মদ আলী ছেলেটা বেশ খোঁজখবর করে, বাজারে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করে যায়, কিছু আনতে হবে কি না। আর আছে তাঁদের দু’ঘর ভাড়াটে। ওপরতলায় অসীমকুমার কুণ্ডু। বউ রীতা আর ছোটো তিনটি মেয়ে নিয়ে সংসার সরকারি চাকুরে অসীমের। এই অসীম-রীতারা আছে আজ প্রায় ন’বছর। নিচেরতলার চারটি ঘরের দুটো কোনো কাজে লাগে না বলে ভাড়া দেওয়া হয়েছে বছরখানেক আগে। দু’বছরের একটি ছেলে নিয়ে মজিবর আর ইতির ছোট্টো সংসার সেখানে। কুড়িয়ে পাওয়া দাদু-দিদার দেখা না পেলে ওপরের আর নিচেরতলার বাচ্চাগুলোর একটি বেলাও চলে না।

নিজেদের ছেলেমেয়েগুলো একে একে বাড়িছাড়া হয়েছে। ছোটো এই শহরের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠে এক এক করে নিজেদের জীবন-জীবিকায় চলে গেছে আরো বড়ো বড়ো সব শহরে। এবারক হোসেন নিজে যেমন একসময় দোগাছি গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছিলেন। এক হিসেবে ধরতে গেলে ছড়িয়ে গেছে ওরা পৃথিবীময়। মেজো ছেলেটি একবার বলেছিলো, খেলতে যদি হয় বড়ো মাঠে খেলাই তো উচিত। কথাটা ভালো লেগেছিলো তাঁর। অসীম-মজিবরদের বাদ দিলে এখন বাড়িতে বাসিন্দা তাঁরা দু’জনই। অবশ্য ভাড়াটেরা কোনোদিনই শুধু ভাড়াটে হয়ে থাকেনি তাঁদের, এক রকমের আত্মীয় হয়ে উঠেছে।

আজ সন্ধ্যায় জোহরা বেগম একবার ওপরে অসীমকে খবর দিতে চেয়েছিলেন। মনে পড়েছিলো, অসীম আজ বাড়িতে নেই। চাকরির কারণে মাঝে মাঝে তাকে শহরের বাইরে দুয়েক রাত থাকতে হয়। ফিরবে আগামীকাল। এই সময় আর কাকে বলবেন! মজিবরকে বলতে যাবেন, এবারক হোসেন নিষেধ করেছিলেন। তাঁর ইচ্ছে নীরবে চলে যাওয়া, ওদের মুখের দিকে তাকালে যেতে বড়ো কষ্ট হবে যে! ‘ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি...’।

বুকের ব্যথাটা এবারক হোসেন অনেকক্ষণ ধরেই চেপে রাখার চেষ্টা করছিলেন। বিশেষ করে জোহরা বেগমকে ব্যথার তীব্রতা খুলে বলতে চাননি। যা জানার, তা তো জানবেই। একটু আগে বা পরে, এই যা। শুধু শুধু এখনই উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে কী লাভ! এখন কষ্টটা যন্ত্রণার পর্যায়ে চলে গেছে, সহ্যের সীমার মধ্যেও আর নেই। বুকের ভেতরটা প্রবলভাবে চেপে চেপে আসছে, সারা শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে। বললেন, রবি, আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

রবি নিজে ডাক্তার। এবারক হোসেনকে জড়িয়ে ধরে বসে সবই টের পাচ্ছিলো সে। কিন্তু ডাক্তারি বা সাধারণ বিবেচনায় সে জানে, হাসপাতালে পৌঁছার আগে কিছুই করার নেই। রাত দশটার দিকে খবর পেয়েছিলো রবি। মাত্র খেতে বসেছে, এই সময় মজিবর এসেছিলো। তখনই সে জানে, নিতান্ত নিরুপায় না হলে শীতের রাতে অতো দেরিতে কেউ আসে না। হাত ধুয়ে উঠে পড়েছিলো সে মজিবরের সঙ্গে রিকশায়।

রবি বললো, এই তো দাদু, আর একটু, হাসপাতালে পৌঁছে গেলেই একটা ব্যবস্থা করা যাবে।

ব্যবস্থা করা যদি না যায়, রবি?

এ কথার কোনো উত্তর হয় না। তবু রোগীর মনের জোর টিকিয়ে রাখা দরকার, ডাক্তার রবীন্দ্রনাথ সরকার জানে। বলে, এতো ঘাবড়াচ্ছেন কেন?

বুকের ভেতরে অমানুষিক খামচানির মধ্যেও এবারক হোসেনের হাসতে ইচ্ছে করে। মনে মনে বলেন, শরীরটা তো আমার, রবি! আমি জানি।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×