somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জন্ম-৫

০৭ ই জুন, ২০০৭ রাত ৩:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(আগের কিস্তির পরে)
---------------------------------------------------------
এরমাঝেই ও অসুস্থ হলো, প্রথম প্রথম পাত্তাই দিতে চাইতো না অসুস্থতাটাকে। জিজ্ঞাসা করলেই সেই হাসি দিয়ে বলতো, “আরে এইসব কিছুই না, দু’দিনের জন্যে আসছিল, আমাকে পছন্দ হইছে, সাতদিন থাকতেছে, এইতো সময় হয়ে গেছে, চলে যাবে”। আমি অবাক হয়ে ওর এরকম নির্বুদ্ধিতার কথা শুনতাম। অনেকবার বকাবকি করলাম, অবশেষে জোর করে ধরে নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। নানা টেস্ট দিল, অনেক চেক-আপ করলো আর কিছুদিন পরে আসতে বললো। আর সেই সাথে নান-ধরণের বানী-চিরন্তনী টাইপ উপদেশ তো দিলই। আসতে আসতে ও ঠাট্টা করে বললো, “ দেখলি এই কারণেই ডাক্তারের কাছে যাইনা। কতো হাজার রকমের টেস্ট রে বাবা! পাক্কা এক ব্যাগ রক্ত নিয়ে নিলো মনে হয়, আর তার উপরে হেন খেতে হবে, তেন খেতে পারবানা, বিশ্রাম নাও। আরে আমি তো সারাক্ষন খাওয়া আর ঘুমের উপরেই তো আছি। ঘুমকে বিশ্রাম বলবা না তো কাকে বলবা!” আমি ওর কথা বলার ধরণে হেসে ফেলি। আমাকে হাসতে দেখে আজাদ ও হেসে উঠে।

হাঁটাতে থাকলে ও একটা পার্কে বসার অনুরোধ জানায়। আমরা পার্কে ঢুকে মনমতো একটা জায়গায় একটা বেঞ্চে বসি।কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পরে ও বলে, “আমার একটা স্বপ্ন আছে,শুনবি?” আমি ছোট্ট করে হেসে বলি, “তোর তো গন্ডায় গন্ডায় স্বপ্ন, একটা আবার কিরে?” ও বলে, “ এটা খুব ব্যক্তিগত, অনেকটা স্বার্থপরের মত একটা স্বপ্ন।“ আমি বেশ উৎসাহ নিয়েই ওকে স্বপ্নটা বলতে বলি। আর ও শুরু করে, আর ওর কথার সাথে সাথে আমি নিজেও যেন স্বপ্নটাকে ছবির মত চোখের সামনে দেখতে পাই। ও বলে যেতে থাকে, “ আমার নামের মানেটা যেহেতু স্বাধীন, সেকারণে চিরজীবনই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাটা যেন আমার জন্য বরাদ্দ। তাইতো ভাবি আমার মৃত্যুর পরে যখন আমি পুরোপুরি স্বাধীন হয়ে যাব, তখন আমার মুক্ত ডানায় ভর করে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াব, উড়ে বেড়াব আমার দেশের আনাচে-কানচে। কত সবুজ, কত কত সুন্দর, কত বর্ণিল বিচিত্রতা যা এতদিন চোখের আড়ালেই রয়ে গেছে আর ক্লান্ত হয়ে গেলে হয়তোবা কোন গাছের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নিব। আর বৃষ্টি আসলে হয়তোবা পাতার ফাঁক গলে দেখব আকাশে মেঘেদের উন্মত্ত ভালবাসাবাসি।আমি আসলে এই পৃথিবী ছেড়ে যাব না, যাব না আমার দেশকে ছেড়ে। বার বার ফিরে আসব গাছের ছায়ায়, নদীর বাঁকে, সরিষা মাঠের মিষ্টি হলুদে, সবুজ প্রান্তরে আর দিগন্তে অস্ত যাওয়া সূর্যের লালচে আভাতে”।

এই যে এত স্বপ্নময়তা, এত ভালবাসা বোধহয় আজাদের পক্ষেই সম্ভব। আমি যেমন ওর কোমল আর্দ্র মনটা দেখেছি, তেমনি দেখেছি অসহায়ের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কিছু করার ব্যাকুলতাকেও। আজাদ কতবার নিজের উদ্যোগেই কতবার কতধরণের সাংগঠনিক কাজ করেছে, ত্রাণ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় গেছে, নানা ধরণের বিকল্প পেশার কথা চিন্তা করে তা কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছে- তা শুধুমাত্র ওর কাছের বন্ধুরাই হয়তো জানে। আসলে নিজের কথা বলার চাইতে অন্যের কথা শুনাতেই যেন অর আগ্রহ ছিল বেশি, তবে নিজের কথা যাদেরকে বলতো তাদেরকে সবটুকুই বলতো। আমি নিজেও ওর সাথে এইসব কাজের সাথে কিছুপরিমাণে যুক্ত ছিলাম, কিন্তু আমার মনযোগ ঠিক ভেজালের ঊর্ধ্বে ছিল না। আর আজাদের স্বত্তাটায় যেন ছিল এসবে বাঁধা।

এই এত আবেগী আজাদের যে এমন কিছু হয়ে যাবে তা আমাদের কল্পনাতেও ছিল না। কেন জানি প্রকৃতি মাঝে মাঝে হিসাবে গড়বড় করে ফেলে, এমন ইচ্ছাকৃত ভুল এই প্রকৃতি কেন করে, কেউ কি বলতে পারে? এইসব নিয়ে এইসময় আর ভাবতে ইচ্ছা করেনা, যখন মনে পড়ে আজাদ চলে যাবে আমাদের সবাইকে ছেড়ে, যখন পৃথিবীর বুকে কলুষতা ছড়ানোর জন্য আমার মত মৃতপ্রায় দূষিত কীটেরা থেকে যাবে। সেসময় ঘৃণায়, লজ্জায় ভেতরটা কুঁকড়ে যায়, মনে হয় আত্মহত্যা করা বুঝিবা বেঁচে থাকার চেয়ে শ্রেয়।কিন্তু এখানেও চলে আসে আজাদ ,আর তার কথা। ও বলতো, “ আমার বেঁচে থাকা তোদের মধ্যে, তোদেরকে ছাড়া তো আমি একটা দলছাড়া পিঁপড়া। তোরাই তো আমার দল, আমার সবকিছু। তোরা যেমন সেভাবেই তোরা শ্রেষ্ঠ। তোরা আমার বন্ধু, তোরাই আমার সবটুকু”।

একের পর এক মেসেজ আসতে থাকে। সবগুলোই আজাদ কোথায়, কোন হাস্পাতালে ভর্তি হয়েছে, কেমন আছে এইসব কথা দিয়ে ভরা। আমি ফোন ধরছি না দেখে, এত এত মেসেজ এসে জমা হয়েছে। এরপর একদিন কি মনে করে জানি লাবণ্যের ফোনটা ধরি। লাবণ্য বেশ অবাক গলায় খানিকটা শ্লেষ মিশিয়ে বলে, “ কেমন মানুষরে তুই! একবারও ওর খোঁজ নিলি না ! আর তুই কিনা ওর জানের দোস্ত! আর আজাদটাও জানি কেমন! খালি বলে ওকে তোরা আস্তে জোর করিসনা, আমি জানি কেন ও আসেনা। হ্যাঁ রে, বল না কেন আসিস না?” আমি কোন উত্তর দেই না। শুধু ফোনটা কানে ধরে বসে থাকি। লাবণ্য এবার কান্না ভেজা গলায় বলে, “ তুই একটিবারের জন্য হলেও আয়। আর দেরি করলে হয়তোবা শেষ দেখাটাও দেখতে পারবিনা”।আমি এবারও চুপ করে বসে থাকি, কোন শব্দ করি না। ও এবার হতাশ গলায় বলে উঠে, “ আমি কোনদিনি তোদের বুঝলাম নারে!” আমি ফোনটা রেখে দিয়ে ক্লান্ত পায়ে আমার রুমে ফিরে আসি। কিন্তু ফিরে এসেও মনে শান্তি খুঁজে পাই না। আর একটা কেমন জানি অদম্য রাগ আমার ভিতরে উথলে উঠে। ভার্সিটিতে ওকে যারা ঈর্ষা করে, তারা নাকি ওর এইডস হওয়া নিয়ে নানা বাজে কথা বলছে। ঐসব ঠুনকো মানুষগুলোকে আমার পায়ের তলায় পিষে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করছে এখন। আসল কারণ না জেনে এই সুযোগে এমন কথা বলা ওদের মত নিচু মনের মানুষদেরকেই মানায়।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০০৭ ভোর ৪:৩৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যমদূতের চিঠি তোমার চিঠি!!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:০৮

যমদূতের চিঠি আসে ধাপে ধাপে
চোখের আলো ঝাপসাতে
দাঁতের মাড়ি আলগাতে
মানুষের কী তা বুঝে আসে?
চিরকাল থাকার জায়গা
পৃথিবী নয়,
মৃত্যুর আলামত আসতে থাকে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে
স্বাভাবিক মৃত্যু যদি নসিব... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×