somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উইকিপিডিয়ার Troll কাহিনী

৩০ শে এপ্রিল, ২০০৭ সকাল ৮:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উইকিপিডিয়াতে লেখার জন্য আহবান অনেক জানিয়েছি, আজ বরং ওখানকার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু লিখি। দুনিয়ায় কতো আজব রকমের মানুষ আছে, উইকিপিডিয়ায় গত তিন বছর কাজ করার সুবাদে তা দেখার কিঞ্চিত অভিজ্ঞতা হয়েছে।

যাহোক, বিস্তারিত কাহিনী আরেকদিন বলা যাবে, আজ লিখবো উইকিপিডিয়ার Troll বাহিনীকে নিয়ে।


Troll শব্দটির অর্থ হলো স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বামনাকার দানো। কিন্তু উইকিপিডিয়া ও অন্যত্র "খাইস্টামি" করে যারা, তাদেরকে Troll বলা হয়ে থাকে। উইকিপিডিয়াতে লেখালেখি করাটা উন্মুক্ত, এর সুবাদে অনেকেই বিভিন্ন নিবন্ধ ভ্যান্ডালাইজ করার (মুছে ফেলা, গালাগালি করা ইত্যাদি) কাজ করে। এদেরকে ঠেকাবার জন্য রয়েছে সদা সতর্ক অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের দল। আমি সহ ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে প্রায় ১০০০ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর আছে।

কিন্তু অন্যরকম Troll, যারা সরাসরি গালি গালাজ বা ভ্যান্ডালিজম করে না, কিন্তু নিবন্ধে তাদের চরমপন্থী মতবাদ যোগ করতে থাকে, তাদের ঠেকানোটা কঠিন। আমার ৩ বছরের জীবনে বিভিন্ন রকম Troll কে মোকাবিলা করতে হয়েছে, যেমন


১) পাকিস্তানী (হানাদার) Troll :
২০০৫ সালের জুন-জুলাই মাসে আমি যখন উইকিপিডিয়াতে বেশ সময় দিচ্ছি, ঐ সময় উদ্ভব হলো কিছু পাকিস্তানী Troll এর, যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নিবন্ধে বিভিন্ন মিথ্যা প্রপাগান্ডা যোগ করা শুরু করলো। ঐ সময় ওয়াশিংটন ডিসিতে কোনো এক সেমিনারে শর্মিলা বোস নামের এক (জ্ঞানপাপী) অধ্যাপিকা দাবি করে বসেছিলেন, ১৯৭১ সালে মোটেও বেশি লোক মারা যায়নি, পাকিস্তানীদের দাবি করা ২৬০০০ এর চাইতে অল্প কিছু বেশি মরতে পারে, কিন্তু মোটেও লাখের বেশি না। আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে প্রশ্ন কেউ করেছিলো ৩০ লাখ মারা যাওয়ার ঘটনা সত্যি কি না, তিনিও বলে বসেছিলেন ৩০ লাখ সম্ভবত ঠিক না। আর যায় কোথায়!! পাকিস্তানী Troll বাহিনী লেগে পড়লো ঐ নিবন্ধে মৃতের সংখ্যা ২৬০০০ বানানোর কাজে। আমি ঐ সামারে সুপারকম্পিউটার সেন্টারে গবেষণা করছিলাম, কয়েকদিন কম্পিউটার বিজ্ঞান বাদ দিয়ে লেগে থাকলাম একাডেমিক জার্নালে মুক্তিযুদ্ধের নিহতের সংখ্যার উপরে গবেষণার খোঁজে। অবশেষে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ বের করে এদের ঠেকানো গেলো। এর পরে গত দুই বছরে বহুবার এরা হাজির হয়েছে, এদের ঠেকাতে ও ভাগাতে অনেক খাটতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নিবন্ধ গুলোই এদের মূল আক্রমণের লক্ষ্য, তাই ঐগুলোকে নিয়মিত চোখে চোখে রাখতে হচ্ছে।


২) ভারতীয় Troll:
ভারতীয় Troll বাহিনী কি পিছিয়ে আছে? মোটেও না। কয়েক দিন পর পরই বিভিন্ন Troll এসে হাজির হয়, "দাদাগিরি" শুরু হয়ে যায়। এদের প্রিয় কিছু বিষয় হলো বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মের নিবন্ধ গুলো। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে যে অত্যাচার চলে ও চলেছে, তা সত্যি, কিন্তু ভারতীয় বিজেপি সমর্থক পত্রিকাতে যে প্রপাগান্ডা চলে, তাকেই এরা পরম সত্যি বলে চাপাতে আসে। আর বিভিন্ন নিবন্ধে যোগ করতে থাকে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বাংলাদেশীরা অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে দখল করে ফেলছে, বাংলাদেশীরা সীমান্তে গুলি করে বিএসএফকে মারছে (আসলে তো উল্টাটাই সত্য!!), ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু কিছু প্রবাসী বাঙালিও এই Troll-গিরি করার কাজে ব্যস্ত - সেটাই দুঃখ। আর হিন্দুত্ববাদী Troll তো গাদায় গাদায়। দুই দিন পর পরই কেউ না কেউ "তাজমহল একটা মন্দির ছিলো, শাহজাহান ওটাকে সমাধি বলে চাপা মেরেছে" - এরকম বিজেপি/শিবসেনা টাইপ মিথ্যাচার যোগ করতে থাকে। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের এক ভারতীয় ছাত্র কয়েক মাস চরম প্রপাগান্ডা চালিয়েছিলো, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মুসলিম সম্প্রদায়, খ্রিস্টান সম্প্রদায় - এর সাথে সম্পর্কিত সব নিবন্ধে হিন্দুত্ববাদের পুরাপুরি সবরকম প্রপাগান্ডা যোগ করতো। কোনো কোনোদিন এই ব্যাটাকে দিনে ১৮ ঘন্টা উইকিপিডিয়াতে এই কাজ করে বেড়াতেও দেখেছি। (পরে অবশ্য রীতিমত শালিশ ডেকে ব্যাটাকে ব্যান্ড করা হয়েছে, যদিও নামে বেনামে সে প্রায়ই হাজির হয়)।

ভারতীয় Trollরা আরেকটা কাজ প্রায় সংঘবদ্ধ ভাবে প্রায়ই চেষ্টা করে, তা হলো "বাংলাদেশের ইতিহাস", "পাকিস্তানের ইতিহাস" - এসব নিবন্ধে প্রাক ১৯৪৭ সব ঘটনা মুছে ফেলতে। বাংলাদেশের ভুখন্ডে জন্ম নেয়া ব্যক্তিদের বাংলাদেশী ঐতিহ্যের অংশ বলে স্বীকার করতে তাদের বড়ই অনিচ্ছা। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর কথা। বিক্রমপুরে বাড়ি তাঁর, ভিটা মাটি এখনও আছে, জন্ম ময়মনসিংহে। মারাও গেছেন ভারত বিভাগের আগেই। কিন্তু তাঁকে "ভারতীয়" (as in "citizen of Republic of India") ছাড়া অন্যকিছু বললেই এসব Troll রা হাজির হয়ে যায়। বাংলাদেশের ভুখন্ডে তাঁর জন্ম, পূর্বপুরুষের ভিটা - সবই, কিন্তু এর পরেও উনার জীবনীতে "বাংলাদেশ" শব্দটা দেখলে এসব ভারতীয় Troll দের গা জ্বালা করে!!!

৩) বর্মী ও রোহিঙ্গা Troll :
বার্মার আরাকান ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নিবন্ধগুলোতে এদের আনাগোনা। বর্মী মগরা চায় রোহিঙ্গাদেরকে বর্মী না বলে "প্রবাসী বাংলাদেশী" বলে দাবি করা কথা যোগ করতে। আর আরাকানী রোহিঙ্গারা চায় তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী সব ওয়েবসাইট যোগ করতে। এদের ব্যালান্স করতে গিয়ে দুই পক্ষথেকেই বিপুল গালি খেয়েছি, তবে এত দিনে চামড়া মোটা হয়ে গেছে বলে আর গায়ে লাগে না।

৪) অন্যান্যঃ
এরা ছাড়া তো অন্যান্য Troll আছেই। উইকিপিডিয়ার বিভিন্ন নিবন্ধে নিয়মিতভাবে এদের জন্য এডিট ওয়ার বা তথ্য যোগ বিয়োগের যুদ্ধ চলে। মধ্যপ্রাচ্যের নিবন্ধের কথা বলাই বাহুল্য, এতোটা নোংরামি চলে ওখানে, যে আমি আর ঐসব নিবন্ধ নিয়ে মাথা ঘামাই না। বছর দুয়েক হলো, আমি কেবল দক্ষিণ এশিয়ার নিবন্ধ নিয়েই কাজ করি ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে। এখানেই যা Troll রয়েছে, তাদের ঠেকাতেই অনেক চেষ্টা করা লাগে।

এর পরেও উইকিপিডিয়া টিকে আছে, টিকে আছে জনমানুষের তথ্যভান্ডার হিসাবে। এর কারণটা হলো, দুনিয়াতে Troll দের সংখ্যা বেশি না। সব দেশেই ভালো মানুষের সংখ্যাটা বেশি। ভারতীয়, পাকিস্তানি, আরাকানী, বর্মী, এরকম সব দেশের চমৎকার অনেক মানুষই উইকিপিডিয়াতে কাজ করছেন, Trollদের মোকাবিলাতে এঁদের সাহায্য আমি সবসময়ই পেয়েছি। আমার উইকি-বন্ধু নীরব মেহতা একনিষ্ঠভাবে প্রচুর সময় দিয়ে হিন্দুত্ববাদী Troll দের মোকাবিলা করছে, উইকিপিডিয়ার নিরপেক্ষতাকে সমুন্নত রেখে চলেছে। এভাবেই এসব Troll আর তাদের ঠেকিয়ে রাখা ভালো মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে চলেছে উইকিপিডিয়ার যাত্রা।

(লেখায় ব্যবহার করা ছবিটি একটা Troll -দানোর মূর্তি, ডিজনী ওয়ার্ল্ড থেকে, নেয়া হয়েছে উইকিমিডিয়া কমন্সের মুক্ত ছবি সংগ্রহ হতে)।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০০৭ সকাল ৮:২৮
২০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

---অভিনন্দন চট্টগ্রামের বাবর আলী পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয়ী---

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫৫





পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন বাবর আলী। আজ বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টায় এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন তিনি।

রোববার বেসক্যাম্প টিমের বরাতে এ তথ্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×