somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ষোড়শী হয়েই গেলি তবে!

১০ ই এপ্রিল, ২০০৭ রাত ১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার বয়স তখন সাড়ে চার। ভাইয়ার ছয়। কয়েক দিন ধরেই মা বাবা জিজ্ঞাসা করছিল, তোমরা কি একটা ভাইয়া চাও নাকি আপু চাও? আমি এক কথায় 'আপু'! ভাইয়া বলে 'ভাইয়া'। যার যার খেলার সাথীর ধান্দা।

তারপরে, এক রাতে মা বাসায় ছিল না। খুব অসুস্থ তাই হাসপাতালে। বাসায় বেড়াতে এসেছে কামরান ভাইয়া। আমি, ভাইয়্যুন আর কামরান ভাইয়া ডিম লাইটের আলোয় অনেক রাত পর্যন্ত গুট গুট গল্প করলাম, মনে আছে। পরের দিন বাবা মশারি খুলতে খুলতে ডাক, আমরা তো কিছুতেই চোখ খুলব না! বাবার এক কথা, 'খুব মজার একটা খবর আছে, তাড়াতাড়ি উঠে টুথ ব্রাশ করো, বলছি।' আমরা উঠবই না। 'আগে বলতে হবে'। শেষ মেষ বাবাই আর চেপে রাখতে পারল না, 'তোমাদের একটা আপু হয়েছে।'

আমরা উঠে দাঁড়িয়ে বিছানায় সে কি লাফ!

অত আগের কথা, কিন্তু দিব্যি মনে আছে, আমরা 'মিস্তিরী মিস্তিরী' খেলছিলাম, যখন মিশুকে করে লাল ওড়না পড়া মা ইঁদুরের মত লাল মুখের এক পোটলা সহ বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। পোটলাটাকে নিয়ে আমাদের কি উৎসাহ উত্তেজনা! হাত মুখ ধুয়ে গোল হয়ে বসলাম পোটলার চার পাশে। তার চোখ, নাক, ঠোঁট, হাতের মুঠি সব বিশ্লেষন করা শুরু করলাম।

এর কয়েক দিন পরের কথা। মা দাবী করছে, বাসায় যেই মেয়েটা থাকতো, ও নাকি মীরাকে আমাদের চেয়েও বেশি ভালবাসে। কারণ, ও মীরার ময়লা কাঁথা, ন্যাপি ধোয় অম্লান বদনে। সেটা শুনে ভাইয়ার সে কি রাগ! ছয় বছরের ছেলেটা বোনের প্রতি ভালবাসা প্রমান করতে পিচ্চি মীরার কাঁথা ধুতে বসল। সাথে ভালবাসার তীব্রতা প্রমানে ক্লাসিক সেই উক্তি--'কোন গন্ধ নাই, একদম ডালের মত!'

যেদিন মীরা বাসায় আসল, আমাদের ঝিকাতলার ওই ছোট্ট বাসাটায়, বাবা সেদিন মাকে এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা আর একটা কার্ড দিয়েছিল, আমার মনে আছে। কার্ডে ডোরা কাটা শাড়ি পড়া দু'টো মেয়ে, সরিষা ক্ষেতের মাঝে বসে একজন আরেকজনের চুল বেঁধে দিচ্ছে। বাবা দেখিয়ে দিল, 'এটা হচ্ছো তুমি, আর ওটা মীরা'।

সেই তখন থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, মীরা কবে বড় হবে? আমার চুল বেঁধে দিবে? গুট গুট করে গল্প করবে আমার সাথে?

এখন ওর দিকে তাকাই আর মহা বিষ্ময় নিয়ে ভাবি, কোন ফাঁকে আমার কিউটিশ পিচ্চি গুটুশ আপুটা এত বড় হয়ে গেল? এখন ওকে দেখলে লোকে প্রায়েই আমার বড় বোন বলে ভুল করে। কোথায় গেল মীরাকে কোলে নেয়ার দিনগুলো, এখন ও অনায়েসে আমাকে উপরে তুলে ধরে। ওই যে, প্রথম যখন কথা শিখছে... তখনের ওর কিছু ছড়া কবিতা রেকর্ড করা আছে। ও তখন টোনাটুনির গল্প পারত। গল্প একবার এভাবে শুরু করেছে... 'এক দেশে এক টোনা ছিল।'
'তারপর?'
'একদিন টোনা বলল...'
'বল?'
'টোনা বলল...'
'কি বলল?'
'আমি বুজি না।'

মানে ওর মনে নাই। ওই তখন, ও খুব সুন্দর করে বলতে পারত, 'আমি বাবার মাইয়া'। বাবার মত দেখতে, সবাই বলতো, তাই বাবা শিখিয়েছে। 'পাগলা ঘোড়া ক্ষেপেছে, অনেক অনেক ক্ষেপেছে'... আরেকটা ক্লাসিক লাইন ছিল। কবিতা ভুলে গিয়েছিল, ওই তিন বছর বয়সেই কবির মুখে কথা যুগিয়ে দেয় এভাবে। ক্লাস ফোরে থাকতে এই পিচ্চি ক্লাসে দেয়ালিকা বের করে। দশ টাকা চাঁদা তুলে! আমাদের বাসার ফুচকা ফান্ডের ম্যানেজার ছিল। এখন কি সুন্দর বিতর্ক করে স্কুলে, বাসায় ঝগড়া করে আমার সাথে। তারপর, চোখে ওই বড় মানুষীয় ক্লান্তি এনে বলে, 'তুমি আমাকে বুঝতে পার না'!

পিচ্চিটা, কোন ফাঁকে ওই লাল টুকটুকে পোটলা থেকে বড় হয়ে একদম জীবন্ত, হাঁটিয়ে, কথা বলিয়ে, অভিমান করিয়ে মানুষ হয়ে গেল, শুধু আমার বোন থেকে আস্তে আস্তে আরও অনেকেরই 'কেউ' হয়ে গেল, একদম টের পাই নি! কাল রাতেই, বাসার সবাইকে জন্মদিন উপলক্ষে 'ফুল কোর্স ডিনার' খাইয়েছে। রীতিমত স্টারটার, আসল কোর্স এবং ডেজার্ট সহ। আসলেই রান্নায় কেউ সাহায্য করে নাই। আমারই চক্ষু চড়কগাছ!

যেই ব্যাপারটা আমাকে আসলেই মুগ্ধ করে... মীরা দেশ থেকে এসেছে দশ বছর বয়সে। হাতে লেখা ত্যাড়া বাঁকা। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা জন্মানোর সময় তখনও আসে নি। অথচ, সেই মেয়েটাই একে একে হুমায়ুন দখল করে, শরৎ পড়ে শেষ করল, রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ পড়লো। সাতকাহন পড়লো। শীর্ষেন্দু পড়লো। আমি যখন প্রথম বইগুলো পড়ি, তখনের কথা মনে আছে। নিজেকে কত্ত বড় বড় লাগছিল! মীরা কি সত্যিই অতো বড় হয়ে গিয়েছে?

ছোট্ট মীরাকে মিস করি। কিন্তু বড় মীরাকে দেখে যখন মনে হয়, নাহ, আমাদের সবাইকে ছাঁড়িয়ে আসলেই একটা উজ্জ্বল উপহার হয়ে থাকবে সারা পৃথিবীর জন্য, তখন একটা ভালো লাগায় মন ভরে থাকে।

আমি জানি, আমার নি:শর্ত ভক্ত মীরা। মানুষ হিসেবে আমি অনেক ভুল করি। ভুল সিদ্ধান্ত নেই, ভুল কাজ করি, ভুল অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেই। মীরা, আপুর ভয়াবহ 'মানুষ' ভুলগুলোকে কখখনো সামনে রাখবি না, ষোল বছরের চোখ আরও পরিপক্ক হোক, নিজের পথ নিজেই বেছে নেয়ার মত। লাভ য়ু সিস!

----------------------------------

ছবি: এক বছরের মীরাকে নিয়ে পাঁচ বছরের আমি।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০০৭ রাত ১:৪৮
৪৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×