somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আদ্যেপান্ত এফএম বিশ্লেষণ

২১ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লাইভ এফএম ১: গান বাজছে- ‘ও..ও.. আমি শীলারে...
সেক্সি শীলারে...
আমাকে দেখে তুমি হবা...’

সময়: রাত ১টা পাঁচ মিনিট।
তারিখ: ২২-১১-২০১২ (বিষ্যুদ বার)।
শো: পিপলসরেডিও-এর ‘ড্রিমল্যান্ড এক্সপ্রেস’।



লাইভ এফএম ২: হ্যাল-লো লিসেনার, দিস ইজ রাজিব, ঘড়ির কাঁটা এখন ঠি-ক-ক রাত ১টা বেজে শূন্য ৫ মিনিট। আজ সারারাত আমি আপনার সঙ্গে কাটাব। মা-নে একসঙ্গে নয়, সারা রাতটা আপনাদের নিয়ে বিনোদনের ঘরে- আমি আপনাদের সঙ্গে থাকছি আর কি! আর সময়ক্ষণ দেখে না দেখে শোনাতে থাকব নানা ধরনের ড্যাসিং ডুসিং ফাট্টাফাট্টি গান আর সুরের মোহনায় জাগিয়ে তোলার চেষ্টায় থাকব জাগ্রত অবিরত, হু। তো চলুন এবার চুটিয়ে একটি পিরিতের গান শুনি। আর এ গানটির জন্য অনুরোধ পাঠিয়েছেন নটর ডেম কলেজের রুইছ ইবনে মাহীন, ঢাকা ইডেন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী তমা, ঢাকা কলেজের রুপম, মানিকগঞ্জের সাগর, সিরাজগঞ্জের যমুনা এবং আমার বাড়ির পাশের মেয়েটি টুম্মা। আর নতুন ভ্যারিয়েশনে সেই রিমিক্স গানটি হলো ‘...সোনা বন্ধু তুই আমারে ভোতা দা দি কাইট্টা লা, তোর পিরিতির কাঁথা দিয়া যাইত্তা ধইরা মাইরা লা।’



লাইভ এফএম ৩: ডিয়ার লিসেনার, রাত সোয়া ২টা, আমি আরজে সু পারভেজ। এখন শোনাবো তারুণ্যের মারদাঙ্গা হাওয়া খাওয়া মার্কা গান, যে গানটি শুনে আপনি জেগে উঠবেন এখনই। আই হোপ, মধ্যরাতের এ গানটি আপনাকে সত্যিই রোমান্টিক করে তুলবে। আর গানটি ভালো লাগলে ফোনে বসে আছি বলবেন এখনই হ্যাঁ! তাহলে শুনুন গানটি- ‘মন চাইলে মন পাবি, দেহ চাইলে দেহ, সবই হবে অগোচরে জানবে না যে কেহ।’
লাইভ এফএম (২-৩) প্রভাষক এম. আবদুল্লাহ সরকার-এর ‘রাতের এফএম রেডিও’ নামক লেখা থেকে চয়নকৃত।



কেস স্টাডি: ‘ট্রেন চাপায় কলেজ ছাত্র নিহত’- এমন সংবাদের ভেতরে ঢুকে আমরা দেখি: সিদ্ধেশ্বরী কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের এক ছাত্র ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হয়েছে। কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয় লোকদের ভাষ্যমতে, খিলগাঁও রেললাইনের ওপর দিয়ে ছেলেটি দু কানে ইয়ারফোন ঢুকিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। ট্রেনের বিকট হুইসেলও সম্ভবত সে শুনতে পায়নি। যে কারণে মৃত্যু!’

মিডিয়ার ধেই ধেই বৃদ্ধিতে সমাজে উন্নয়নের বিপ্লব সাধিত হবে- এমনটি ভাববার অবকাশ নেই। মার্জিত, পরিশীলিত, দলীয় চেতনামুক্ত, অশ্লীলতাবিহীন এবং ধর্মীয় ভাবাপন্ন মিডিয়া দ্বারাই কেবল সমাজ উন্নয়ন সম্ভব। সমাজে জবাবদিহিতা কার্যকর হওয়া সম্ভব। নতুবা হাল আমলের দলীয় মিডিয়া হাউসগুলোর মাধ্যমে কস্মিনকালেও সমাজে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না। হয়ও নি। মিডিয়ার ব্যাপকতার সঙ্গেই সমাজে দুর্নীতি-অবৈধ কর্মকাণ্ড পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সমাজ-তারুণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা ঘোর আশংকায় নিপতিত হচ্ছি। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ধর্মকে অবজ্ঞা এবং অশ্লীলতাকে প্রশ্রয় দেয়াও সমাজ স্খলনের বড় একটি কারণ। ধর্মের কথা শোনে অনেকেই নাসিকা কুচকাচ্ছেন। তাদের জন্যে জনৈক ইংরেজ দার্শনিককে উপস্থাপনের লোভ সংবরণ করতে পারছি না। তিনি বলেছেন, ‘তুমি যদি সন্তানকে সবকিছু শিক্ষা দাও। কেবল ধর্ম না শেখাও। তাহলে সে বর্বর হবে।’
বাংলাদেশে এফএম জগতের সূচনা হয়েছে রেডিওটুডের মাধ্যমে। পরবর্তীতে এবিসি, আমার, ফুর্তি, স্বাধীন, ঢাকা, পদ্মা, পিপলস, ভূমি প্রভৃতি নামে অনেকে এফএম জগত সমৃদ্ধ করেছে। এফএম ফ্রিকোয়েন্সিতে যথেষ্ট জটলা তৈরি হচ্ছে। মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের ব্যবধানে জগতটিতে অভাবনীয় উত্থান ঘটেছে। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার একাংশের এমন ব্যাপক সাফল্যে সমাজ কতটুকু লাভবান হচ্ছে? কী পরিমাণ জবাবদিহিতা সমাজে নিশ্চিত হচ্ছে? তরুণ সমাজই বা কী পাচ্ছে? একটু ভাবি।



আমার ভালোবাসা অনুষ্ঠান
অস্বীকারের জো নেই, ‘লাভগুরু’ কিংবা ‘আমার ভালোবাসা’ সমসময়ের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় এবং আলোড়িত শো। এও নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে, কিশোর-তরুণরাই এফএম’র নব্বই ভাগ শ্রোতা। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, অনুষ্ঠান পরিচালকেরা এ বিষয়টি মাথায় রাখেন না। ফলে এই অনুষ্ঠান শোনে কিশোর-তরুণদের মাঝে যে কতো ধরণের বিরুপ প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে- লাভগুরুর আর এসব নিকাশের সময় কই! প্রমাণ দিই- “ফারিহা (ছদ্মনাম) ক্লাস ফাইভের ছাত্রী। পুরান ঢাকার মানুষ। বেশ অর্থ-কড়ির মালিক। মেয়েটি পাভেলকে (ছদ্মনাম) পছন্দ করেন। পাভেল একই স্কুলের ক্লাস সিক্সের ছাত্র। ফারিহার মতো পাভেলের পরিবার অতো প্রভাবশালী না, সম্পদশালীও না। ফারিহা প্রথমে বিভিন্ন স্টাইলে পাভেলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। লাভ হয় না। ফারিহা পরিবারের প্রভাবের আতংকেই পাভেল দূরে থাকে। কাছে ঘেঁষে না। ফারিহা নাছোড়বান্দা। প্রেম যে করেই হোক, সে করে ছাড়বে। উপরন্তু প্রপোজের ক্ষেত্রে হিন্দি সিনেমা আর লাভগুরুর ‘পবিত্র’ উপদেশ তো রয়েছেই। এবার ফারিহা সরাসরি পাভেলকে বলে। সাড়া না দিলে আত্মাহুতির হুমকিও দেয়। পাভেল তাতেও পাত্তা দেয় না। ফারিহা তখন পাভেলের সামনে চাকু দ্বারা নিজের বাম হাতের কব্জির উপরি অংশের মোটা রগটি কেটে ফেলে। ডান হাত দিয়ে সেটা টেনে চামড়া ভেদ করে কনুই পর্যন্ত নিয়ে আসে। কী নির্মম! কত ভয়াবহ! চিকিতসা শেষে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে ফারিহা বন্ধুদেরকে বলেছে, ‘ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার তাগিদে এমন ত্যাগের দীক্ষা নাকি সে লাভগুরু থেকে পেয়েছে। এমনকি বিভিন্ন কষ্টকর কাহিনী শুনে ধৈর্যের ব্যাপারটি হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে।” আমার আর কিছু বলার নাই। সকলেই বুঝতে সক্ষম হবেন যে, এ অনুষ্ঠানের কারণে তরুণ-কিশোর সমাজের অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে।

পুনশ্চ : এক. জনৈক শ্রোতা ‘আমার ভালোবাসা’ অনুষ্ঠানে ফোন করে লাভগুরুকে প্রশ্ন করেছিল, বিবাহপূর্ব ভালোবাসা তো ইসলামে নিষিদ্ধ। আপনি কেন একে বৈধ বলছেন? নবী জীবনের কিছু বিষয়ের অপব্যাখ্যা করে গুরু বলেছিল, খারাপ কিছু না থাকলে নাকি এ ভালোবাসা বৈধ। আমি জানি না, কাদের মিশন নিয়ে ‘লাভগুরু’ মাঠে নেমেছে। তাছাড়া এদেশে এমন ধর্মবিষয়ক মিথ্যাচার করার শক্তি সে কোথায় পায়! ইসলাম বলছে- প্রয়োজন ব্যতিরেকে নারীকে দেখা ও কথা বলা সম্পূর্ণ হারাম। যেখানে পরনারীর সঙ্গে দেখা কিংবা কথা বলারই সুযোগ নেই। সেখানে প্রেম-ভালোবাসা, মাখামাখি আর খুনসুটির অবকাশ কোথায়! আচ্ছা ধর্ম বাদ দিই। প্রেম আসলে আমাদেরকে কী দিচ্ছে? অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, সতীচ্ছেদ, লিভটুগেদার, প্রতারণা, ক্যারিয়ার নষ্ট, সংসারে অমিল, পরকীয়া- এই তো প্রেমের পরিণতি, নাকি! এসব নষ্টামিই তো আমাদের সমাজ শিখছে। রক্ষা পেতে চাইলে গুরুর এই শো’র ব্যাপারে সজাগ হওয়া উচিত।

দুই. গুরুর ভাষ্যমতে, ভালোবাসা-বাসির অধিকার কেবল পরিণত বয়সীদের। কিন্তু এসব শোনে অপরিণতরা যে অসত দৃঢ়তা অর্জন করছে- তা কি গুরু উপলব্ধি করেন না! এই কম বয়সীদের মাঝে যখন আবেগ কিংবা ভালোবাসার স্ফুরণ ঘটে, তখন কি তারা হাতে কিংবা কম্পিউটারে বয়স মাপার সুযোগ পায়! এসব বিবেচনায় আনা উচিত।



অশ্লীলতা ও মুশকিল আসানকারী কবিরাজ
তরুণ-তরুণীদের অবাধ মেলামেশা; প্রেম-ভালোবাসা আমাদের সমাজ এবং নতুন প্রজন্মকে কতোটা নিচে নামিয়ে দিচ্ছে, তা ‘ধর্ম উপদেশ’ ছাড়াই সমাজের হালচাল দেখে বোঝা যায়। সমাজের অধিকাংশ ছেলে-মেয়েরা এখন এসবে মত্ত। কোনো কারণে কেউ যদি এ গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসতে না জানে, অশ্লীলতার অংশীদার না হতে পারে- তবে তার জন্যে এফএম থেকে বিশেষ সুবিধা রয়েছে। হতে পারেন আপনি সম্ভ্রান্ত, লাজুক কিংবা অন্য কিছু। কাউকে ভালোবাসার কথা জানাতে পারছেন না। থ্রি ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ড (Three magical word) ‘আই লাভ ইউ’ (I love you) বলার সাহস পাচ্ছেন না। শুধু একটা এসএমএস করে দেন রেডিওতে। রেডিও জকিরাই আপনার কথা বলে দেবে তাকে।
এফএম’র অধিকাংশ শ্রোতা স্কুল-কলেজপড়–য়া শিক্ষার্থী। রাতে এফএমগুলোতে মেয়েদের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। ছেলেদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এফএম শুনলেই বোঝা যায়, একজন আরজেকে কাছে পেয়ে কতো আনন্দে ছেলে-মেয়েরা রাত পার করে দিচ্ছে। তাদের ফুর্তির সীমা নেই। যেন বাঁধভাঙা উল্লাস। মুঠোফোনের মাধ্যমে ক্ষুদে বার্তায় একজন অন্যজনের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে প্রেমকাতর কথাবার্তা। মোবাইলেও কখনো কখনো প্রেমবিষয়ক কথা হয় আরজের সঙ্গে। আরজে শ্রোতার সমস্যা শুনছেন এবং সমাধান দিয়ে যাচ্ছেন। যেন স্বপ্নে পাওয়া অলৌকিক ক্ষমতা। গভীর রাতে এদেশের রেডিও জকিরা হয়ে যান মুশকিল আসানকারী কবিরাজ। অমার্জিত অশ্লীল কথার তুফান ছোটে তাদের মুখে। পরিকল্পিত ভাবেই এসব অশ্লীলতার প্রসার ঘটানো হচ্ছে। নতুবা ঢাকাএফএম ‘নেভার মাইন্ড’ ও ‘ক্লাব নাইনটি ফোর’, এবিসি ‘পার্টি নাইট’ এবং পিপলসরেডিও ‘ড্রিমল্যান্ড এক্সপ্রেস’-এর মতো ফালতু ছ্যাবলা নোংরা উদ্ভট অনুষ্ঠানসমূহ পরিচালনা করতো না।
নোংরামি আর অশ্লীলতা রাতের শো’গুলোতে মাত্রা হারিয়ে ফেলে। এ প্রসঙ্গে প্রভাষক এম. আবদুল্লাহ সরকার লিখেছেন, ‘আরজেরা যৌন সুড়সুড়িমূলক গান শোনাতে থাকেন সারা রাত ধরে। রাতভর চলে টিনএজদের প্রেম, অশ্লীল কথাবার্তা। পাঠানো হয় নোংরা ম্যাসেজ। শ্রোতাদের মধ্যে যারা মেয়ে, তারাও ঢালাও প্রেম-পিরিতের কথা এবং নানা ঢংয়ের যৌনতা নিয়ে কথা চালাচালি করে যাচ্ছে অহরহ। যেন এর কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই। কারো কাছেই যেন জবাব দেয়ার প্রয়োজন নেই।’
এভাবে যারাও একটু ভালো থাকতে চাইতো, তাদেরকেও অনৈতিক কাজের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে এফএম।



সাম্রাজ্যবাদীদের স্পন্সর
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত-পশ্চিমাদের টার্গেট হচ্ছে তরুণ সমাজ। যারা দেশের ভবিষ্যত কাণ্ডারি। এদের চরিত্র হননের চেষ্টা তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। অবাধে ফেনসিডিল, ইয়াবা পাচারের মাধ্যমে ভারত যে ক্ষতি করে চলেছে আমাদের উঠতি বয়সীদের, তা পুষিয়ে নিতে আমরা অক্ষম। এখন এফএমগুলোতে ভারত-পশ্চিমাদের মদদপুষ্ট কোম্পানিগুলো দেদারছে স্পন্সর করছে। এক্ষেত্রে মোবাইল কোম্পানিগুলো সবচেয়ে এগিয়ে। উপরন্তু তারা বিভিন্ন নামে শো পরিচালনা করছে। যেমন গ্রামীণফোন লাউঞ্জ, বাংলালিংক মিউজিক স্টেশন, এয়ারটেল লাইভ, জিপি লাউঞ্জ ইত্যাদি। অন্যান্য কোম্পানি যেমন- একেএস সোলিড গোল্ড আওয়ার, পেপসোডেন্ট নাইট ব্রাশিং আওয়ার ইত্যাদি। এর মাধ্যমে তরুণদের পড়ালেখা বিমুখ করে অঙ্কুরেই তাদের জীবন নষ্ট করা উদ্দেশ্য।



ভূত সাম্রাজ্য
ভূত এফএম’র নাম শোনেনি, এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। রেডিওফুর্তি সপ্তাহে একদিন এই শো পরিচালনা করে। অগণিত শ্রোতা এর। শ্রোতারা জানছে, ভূত বা খারাপ জিন কীভাবে মানুষকে ভয় দেখায়, কীভাবে তাদের ক্ষতি করে। এমনিতেই ব্যাপারটা বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। তারপর এসব শোনে ভয়ের ব্যাপারটা বদ্ধমূল হচ্ছে। কারণে-অকারণে মানুষ ভয় পাচ্ছে। এতে অনেকের খুব ক্ষতি হচ্ছে। কিশোরদের ক্ষেত্রে প্রভাবটা বেশ আশংকাজনক। অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, ভূত-টূত বলে বাস্তবে কিছু নেই। এসব মনের দুর্বলতা। আমরা কুরআনে বর্ণিত অসত জিনের কথা বিশ্বাস করি। তবু প্রশ্ন হচ্ছে, যারা এখনও ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি, তাদেরকে কেন ভয় পাইয়ে মানসিক বিকারগ্রস্ত করা হচ্ছে! এর থেকে কেউ কেউ শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীনও হচ্ছে।



বাঙালি সংস্কৃতি উপেক্ষা
রেডিওটুডের ‘টুডে’জ ওয়ার্ল্ড মিউজিক’ এবং ‘রক দ্য স্টেশন’, এবিসির ‘হিন্দি সঙ’, এবং রেডিওআমার-এর ‘মিউজিক তুফান’সহ প্রায় সবগুলো এফএম বিচিত্র সব নামে ইংলিশ ও হিন্দি গানের বিশেষ ব্যবস্থা রাখছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি তরুণ সমাজে ঢোকানোর জন্যে তাদের যে কতো কোশেশ- দেখলে হতবাক হতে হয়। অথচ এক সময়ের সাড়া জাগানো ভাটিয়ালি, লালন কিংবা নজরুল গীতি- এসবকে সেভাবে ফোকাস করা হয় না। অবশ্য ব্যতিক্রম শুধু এবিসি এবং টুডে। এবিসিরেডিও ‘গাও গেরামের গান’ নামে লোকসংগীতের একটি বিশেষ আয়োজন পরিচালনা করে। আর রেডিওটুডে ‘বায়োস্কোপ’ নামে পুরনো বাঙলা সংগীতের একটা শো করে। এবিসিতে আধুনিক গান শেখার একটি অনুষ্ঠান আছে। যারা কোনো কারণে মুভি দেখতে পারেন না, তাদের জন্য এবিসিতে বিশেষ ব্যবস্থা আছে। হিন্দি কিংবা ইংলিশ মুভি অন করে তারা শোনাতে থাকে। আর দুজন তার ব্যাখ্যা করে। এভাবেই এফএমগুলো তারুণ্যকে ঐতিহ্যহারা করছে।
বাংলা ইংলিশের মিশেলে ‘বাংলিশ’ বানিয়ে আমাদের মাতৃভাষার ওপর যে হামলা আরজেরা করছে, তা নিয়ে কিছু বল্লাম না। ভাষাবিজ্ঞানীরা এটা বলবে।



ধর্মকে অবজ্ঞা এবং মৌসুমি ধর্মপালন
এফএমগুলোতে চব্বিশ ঘন্টা উদ্ভট, অর্থহীন, রোমান্টিক, অশ্লীল সব গান চলতে থাকে। সমাজে পঙ্কিলতা ছড়াতে এরা সদা উদ্যোমী। ধর্মগ্রন্থে এসবের ব্যাপারে কড়া হুঁশিয়ারি রয়েছে। এতোকিছুর পরেও এফএমগুলো কোনো ধর্মীয় শো রাখেনি। ধর্মকে চরমভাবে অবজ্ঞা করে চলেছে। ভোররাতে কুরআন তিলাওয়াত আর পাঁচ ওয়াক্তের আযান কোথাও কোথাও হচ্ছে। অনেকে এটাও উপেক্ষা করছে। বিশেষত: প্রথমআলো-এর এবিসিরেডিও-এর কথা বলতে হয়। এসব ব্যাপারে এরা ব্যাপক উদাসীন। এবিসি-এর আলোচনামূলক অনুষ্ঠান ‘এবিসি মিঠাকড়া’তেও ধর্মীয় ব্যাপারে অসতর্ক এবং অপরিনামদর্শী কথা বলতে দেখা যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরা সবাই আবার মৌসুমি ধর্মপালনে বেশ উতসাহী। রমজানে ইফতার আর সেহরীর সময় বেশ কিছু অনুষ্ঠান করে। সর্বোপরি ইসলামী সংগীত, ধর্মীয় আলোচনা- এ জাতীয় শো চালু করা উচিত।



অন্যান্য ক্ষতি
এক. বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশেষ শক্তিশালী নয়। এফএমগুলোর মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ যে বিদেশি মোবাইল কোম্পানিগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে- তার হিসেব করাই দায়। এসবের মাধ্যমে অঢেল সম্পদের অযথা অপচয় হচ্ছে। এখনই তার লাগাম টেনে না ধরলে অবস্থার চরম বিপর্যয় ঘটতে বাধ্য।
দুই. চিকিতসা বিজ্ঞান বলছে, ইয়ারফোন ব্যবহারে মস্তিষ্ক এবং কানের বিরাট ক্ষতি হয়। অর্থাত এফএম রোগ ছড়াতেও কার্যকরী।
তিন. কোনো কোনো দেশে ওয়াশরুমে ছোট ছোট লাইব্রেরী রয়েছে। দৃষ্টিকটু ঠেকলেও সময়ের গুরুত্ব অনুধাবনে মেছালটি যথার্থ। সময়ের মূল্যায়ন ছাড়া কেউ বড় হতে পারে না। এটা সর্বজনবিদিত। এদেশের তরুণরা মোবাইলে কথা বলে আর রেডিও জকিদের ফাও প্যাচাল শোনে সময় নষ্ট করে। এতে তাদের মেধার সম্ভাবনা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। পড়াশোনা লাটে ওঠছে। মেধা অবিকশিত থাকছে। লাভের টিকিটিও হচ্ছে না।



যতসামান্য সুফল
মিডিয়ার হর্তাকর্তারা একটু সতর্ক হলেই এর মাধ্যমে বেশ সুফল পাওয়া যেত। কিন্তু এফএমগুলো অনৈতিক কাজে অধিক পারদর্শী। এর ভেতর থেকেও জনগণ যে কিছু কিছু সুফল পাচ্ছে, এবার তা বলছি।
এক. ট্রাফিক আপডেট: প্রতি ত্রিশ মিনিট অন্তর রেডিওটুডে এবং এবিসিতে পুরো ঢাকা শহরের রাস্তার অবস্থা জানায়। এতে যানজটের তারতম্য বিবেচনা করে গাড়ীগুলো চলতে পারে। রেডিওটুডের ব্যবস্থাপনা এক্ষেত্রে সন্তোষজনক। কারণ, গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে সার্বক্ষনিক প্রতিনিধি রেখে এরা আপডেট জানাতে চেষ্টা করে। এবিসি ট্রাফিক কন্ট্রোলরুম থেকে পাওয়া তথ্য প্রচার করে।
দুই. সংবাদ: এফএমগুলো প্রতি ঘন্টায় ছোট আকারে হলেও শ্রোতাদের সংবাদ জানাচ্ছে। সংবাদের বিশেষ অনুষ্ঠানও অনেকে করছে। তাছাড়া শেয়ারবাজার, আবহাওয়া, সাধারণ বাজার নিয়েও অনেকে বিশেষ অনুষ্ঠান করছে।
তিন. শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান: ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে অনুষ্ঠানগুলো বেশ ফলপ্রসূ। কোনো কোনো সময় নির্দিষ্ট ভার্সিটি কিংবা পড়াশোনার নির্দিষ্ট বিষয় নিয়েও জরুরী আলোচনা হয়।
এবিসিতে চাকুরি, বাণিজ্য এবং ক্যারিয়ার গঠনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশ ভালো একটা শো হয়। এখান থেকে অনেকে লাভবান হচ্ছে।
চার. ফানি শো: অশ্লীলতামুক্ত রম্যরস করে শ্রোতাদের আনন্দ দেয়ার ব্যাপারটিকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। রেডিওটুডের ‘উইকেন হাঙ্গামা’, এবিসি-এর ‘বিপির প্রেম’ এবং ‘শব্দ গল্প দ্রুম’, রেডিওআমার-এর ‘সানডে নাইট’, ঢাকাএফএম-এর সপ্তাহব্যাপি ঢাকাইয়্যা ভাষায় সিফাত-পারুলের আলোচিত শো ‘রঙিন ঢাকা’- এসব কিন্তু শ্রোতাদের হৃদয়ে বেশ প্রশান্তির প্রলেপ দিচ্ছে।
পাঁচ. লাভগুরুর সাফল্য: এটা লিখতে এসে আমি ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছি। ফাতেমা, তন্বী, ইভা, নিঝুম, লতাসহ আরো মনে না থাকা বেশ ক’জনের বেদনার্ত নারীকণ্ঠ ইথারে-পাথারে আওয়াজ তুলছে। আর্তচিতকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করছে। যাদেরকে প্রেম ছলনা কিংবা জীবন সংগ্রামে সঙ্গী হবার স্বপ্ন দেখিয়ে পুরুষরা দিনের পর দিন ধারাবাহিকভাবে ভোগ করে চলছিল। পুরুষরূপী হায়েনারা অন্যদের ভোগসামগ্রী হিসেবেও এদের ব্যবহার করে যাচ্ছিল। তাদের নির্যাতন করছিল। নিপীড়ন চালাচ্ছিল। ইজ্জত ভুলুণ্ঠিত করে তাদের ছিন্নভিন্ন করছিল। এদের অনেকেই এই বৃহত প্লাটফর্মে এসে সাধারণ মানুষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং মানবাধিকার সংগঠনের সহযোগিতা পেয়েছে। তারা এখন অনেক ভালো আছে। তাদের সুখের জন্যে যে রেডিওআমার এবং ‘লাভগুরু’র অবদান- তা আমি কেন অস্বীকার করবো? স্যালুট লাভগুরু!
অনেক ছেলেও এর মাধ্যমে অস্বাভাবিক জীবন থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। সেজন্যেও গুরুকে অভিনন্দন। ইদানিং এই শো’তে বৃদ্ধাশ্রমের নিরীহ দুঃখী মা জননীদের আনা হচ্ছে। তাদের জীবন থেকে সমাজ অনেক কিছু শিখতে পারবে। পাশ্চাত্য আর ইসলামী পরিবার ব্যবস্থার ফারাক উন্মোচিত হবে। একে স্বাগত জানাই।
ছয়. স্বাস্থ্য সচেতনতা: রেডিওটুডে এবং ঢাকাএফএম স্বাস্থ্য বিষয়ক শো করে। যা লাভজনক।
সাত. শিশু সচেতনতা: শিশু অধিকার ও তাদের সচেতনতার উদ্দেশে নির্মিত বিশ্বব্যাপি আলোড়িত ‘মীনা-রাজু’কে নিয়ে এবিসিরেডিও প্রতি শুক্রবার দারুণ একটি অনুষ্ঠান করে। শুভ প্রচেষ্টা। ধন্যবাদার্হ।
আট. জ্ঞানমূলক: পিপলসরেডিও দৈনিক ‘পিপলস ম্যাগাজিন’ নামে একটি শো করে। যেখানে বিবিধ উপকারী তথ্যের সমাহার। সবার জন্যেই এটা কল্যাণকর।

তারুণ্যের ভবিষ্যত ভাবনা মাথায় রেখে যে কথাগুলো এম. আবদুল্লাহ সরকার লিখেছেন, তা দিয়েই লেখার আবেদনের ইতি টানছি। তার ভাষায়- ‘টিনএজারদের একটা বড় অংশ রাত হলেই ডুব দিচ্ছে বিভিন্ন এফএম রেডিওর অনুষ্ঠানে। ইয়ারফোন লাগিয়ে পড়ার টেবিলে বসে শুনছে বাজে প্যাচাল ও গালগল্প। উন্নত বিশ্বে যেখানে সরকারি ও বেসরকারি রেডিও চ্যানেলগুলো শিক্ষা ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক পালন করছে, সেখানে দেশের এফএম নামধারী রেডিওগুলো যুবকদের বন্দি করছে যৌনতায়। সারারাত তাদের উদ্দেশে বাজানো হচ্ছে- রিমিক্স, ডাবল রিমিক্স, ফোক আর বাউন্ডেলে মার্কা আজেবাজে শব্দে ভরা গান। পাশাপাশি আরজের অসংলগ্ন প্রলাপ শুনে রাত শেষ করছে তারা। এর ফলে সকালে ঘুম থেকে ওঠা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ফলাফল- স্কুলে অনিয়মিত ও রেজাল্ট খারাপ হওয়া। এভাবেই এক সময় বখে যাচ্ছে মেধাবী ছাত্রটি। বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে এখনই।’

দ্রষ্টব্য : লেখাটি সদ্য প্রকাশিত 'বিবেক' ম্যাগাজিন এর প্রচ্ছদ কাহিনি হিসেবে ছাপা হয়েছে। এটি আমার অন্যান্য ব্লগেও প্রকাশিত।

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×