somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার প্রথম বরফ (স্নো) ছুঁয়ে দেখা...

১৮ ই মার্চ, ২০০৭ সকাল ৮:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার জীবনে খুব বেশী বাংলা গল্প-উপন্যাস পড়ার সুযোগ হয়ে উঠেনি। তবে যতটুকু পড়েছি তা ইন্টারম্যাডিয়েট-এ। ওই সময়টাতে বেশী পড়েছি সুনীল আর সমরেশ মজুমদারের বিখ্যাত সব উপন্যাস গুলো। বিশেষ করে সমরেশ -এর উপন্যাস গুলো আমাকে চুম্বকের মত টানত। পড়ে শেষ না করা পর্যন্ত কিছুতেই উপন্যাসের জগৎটা থেকে বের হয়ে আসতে পারতাম না। একটা ঘোরের মাঝে কাটতো পুরোটা সময়। এই ঘোর লাগা সময়টাতে আমি উপন্যাসের নায়কের সাথে ভূটানের পাহাড় কিংবা দার্জিলিং -এর চা বাগান গুলোতে ঘুরে ফিরতাম। আর কল্পার উপভোগ করতাম সমুদ্র সমতল থেকে কয়েক হাজার ফুট উপরে পাহাড়ের গায়ে ভেসে বেড়ানো ধোঁয়াটে মেঘের হীম শীতল ছোঁয়া কিংবা পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা পেঁজা তুলার মত বরফের শীতল স্পর্শ। কিছুতেই সেই স্বপ্নময় জগৎটা থেকে ফিরতে ইচ্ছে হত না। কিন্তু এক সময় তো ফিরতে হতই। তবু যতটা সময় পারতাম, পেঁজা তুলার বরফ আর ধোয়াটে মেঘের স্পর্শের স্বপ্নময় অনুভুতিটা ধরে রাখতে চেষ্টা করতাম।

উপন্যাসের চরিত্রের সাথে ঘোরের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়ে বরফ আর মেঘের স্পর্শের যে আনন্দ অনুভব করতাম তা যে সত্যি হয়ে আসবে আমার জীবনে সেটা ভাবার কোন যৌক্তিক কারণ আমার ছিলনা। যতটুকু ভাবতে পারতাম, সেটা ছিল দার্জিলিং কিংবা নেপাল-ভুটান ঘুরে মেঘ আর বরফ ছুঁয়ে দেখা। কিন্তু জীবনের একটা ছোট্র হলেও উল্ল্যেখযোগ্য সময়ই যে মেঘ আর বরফের সাথে কাটাতে হবে, সেটা ভুলেও কখনো ভাবতে পারিনি। যে মেঘ আর বরফের সুন্দর অনুভুতি হারিয়ে যাবে বলে উপন্যাস পড়ার পরও চোখ খুলতাম না অনেক ক্ষণ, সে মেঘ আর বরফই যে বিরক্তির কারণ হবে, কে ভেবেছিল।

2005 -এর সেপ্টেম্বরের তিন তারিখ। জাপানের ছোট্র শহর কানাজাওয়া -র মাটি স্পর্শ করেই বুঝে ছিলাম শীতে এখানকার তাপমাত্রা কত নীচে নামতে পারে। শহরের দু'দিকে পাহাড় আর তার মাঝ খানের উপত্যকায় সুন্দর ছবির মত ছোট্র শহর এই কানাজাওয়া। নদী যেমন দূরের উঁচু কোন পাহাড় থেকে শুরু করে এক সময় সাগরের বিশাল বুকে হারিয়ে যায়, তেমনই কানাজাওয়া শহরটাও পাহাড়ের উপর থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে প্রসস্ত হতে হতে জাপান সাগরের তীর ঘেষে বিস্তৃতি লাভ করেছে। সাগরের অপর পাড়ে কোরিয়ান পেনিনসোলা। আমি থাকি পাহাড়ের ঠিক কোল ঘেষে গড়ে ওঠা একটা পাড়ায়। গ্রামকে জাপানীরা বলে "মাচি"। মাচি শব্দের আগে বিভিন্ন শব্দ জুড়ে দিয়ে জাপানীরা তাদের পাড়া গুলোর নাম করণ করে। যেমন আমি যে পাড়ায় থাকি তার পাশের পাড়ার নাম "থাইমাচি"। তবে আমার পাড়ার নামটা একটু অন্যরকম। মরিনোছাতু। সুন্দর এবং টিপটিপ। আমার এপার্টমেন্ট -এর পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা বাঁ দিকে চলে গেছে, সেটা আমার ইউনিভার্সিটি হয়ে দূরের কোন পাহাড়ি গ্রামে হারিয়ে গেছে। কিন্তু তার শেষ কোথায় হয়েছে, সেটা আমার এখনো জানার সৌভাগ্য হয়নি। আমি ওই গ্রাম পর্যন্ত গিয়েছি। পাহাড়ের ওই গ্রামে যাওয়ার যে রাস্তা, সেটা আমার দেশের কোন আন্তঃজেলা হাইওয়ের চেয়ে অনেক অনেক ভাল।

সেপ্টেম্বর আর অক্টোবর মাস নিজেকে নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে আর গুছিয়ে নিতে নিতেই কেটে গেল। শীতটা ও ধীরে ধীরে ঝেঁকে বসতে শুরু করল। ডিসেম্বর শুরু হতেই তাপমাত্রা দ্রুত শূণ্যের কাছাকাছি চলে গেল। শীত শরীরের মাংস ভেদ করে হাড় স্পর্শ করল। লোক মুখে শুনতে পারলাম শীগ্রই স্নো পড়তে শুরু করবে। আমার অপেক্ষার সময় যেন আর শেষ হয়না। কবে স্ন্াে পড়বে। আমি আমার মনের মাঝে আঁকা ছবিটার সাথে বাস্তবের ছবিটা মিলাতে আকুল হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। আকাশ থেকে বৃষ্টির পরিবর্তে পেঁজা তুলার মত স্নো পরবে আর আমি তার মাঝে দাড়িয়ে থাকব। মোটা জেকেটের উপর স্নো পড়তে পড়তে জমে সাদা হয়ে যাবে।

আমার রুমের এনট্রেন্স -এর ঠিক বিপরিত পাশের পুরো দেয়ালটাই গ্লাসের। পদর্া সরালেই দেখা যায় দুরের সারি সারি পাহাড়। সবুজ গাছে আবৃত। এখন কোন গাছেই পাতা নেই। সব ঝড়ে গেছে শীতের দাপটে। বরফ থেকে বাঁচতে মানুষেরা নিজেদের আশ্রয় মজবুত করলেও পাহাড়ের গাঁয়ের ওই সাড়ি সাড়ি গাছেরা তো আর নড়তে পারবেনা আশ্রয়ের খুঁজে। তাই শীতের ত্রীব্রতা থেকে নিজেদের বাঁচাতে দেহের সমস্ত পাতা ঝড়িয়ে দিয়েছে। ওরা এখন পুরোপুরি তৈরী শীতকে বরণ করে নিতে।

প্রতি দিনের মত সেদিন ও ভোর হল। কিন্তু সেদিনের সকালটা আমার জীবনের অন্যসব সকালের মত ছিলনা। একটা সপ্নময়, স্বপ্ন পুরণের সকাল। যে সকালটাকে নিয়ে আমি অজশ্র কাল্পনিক ছবি এঁকেছি মনের সাদা ক্যানভাসে। সেই কাল্পনিক ছবি গুলোর সাথে আজকের এই সত্যিকারের ছবিটা কতটুকু মিলবে? আজকে তা মিলিয়ে দেখার সময় এসেছে। আমার জানালার গ্লাসের উপর যে ভারি পদর্াটা আছে, সেটা আমি বরাবরের মত সেদিনও সরিয়ে রেখেছিলাম। লেপের তলায় উষ্ণতার মাঝে থেকেই শীতের সকালের প্রথম সূযের্াদয়টা আমি প্রতি দিনই খুব আরাম করে উপভোগ করি। বিছানায় শুয়ে শুয়েই আকাশটা দেখতে পারি। প্রতি দিনের মত সেদিন ও দুরের আকাশে চোখ রেখেছিলাম বিছানায় শুয়ে শুয়েই। কিন্তু সুর্যে সোনালী রংঙের পরিবর্তে সেদিন যে রংটা দেখেছিলাম, সেটা যে আমার মনের সাদা ক্যানভাসের কল্পনার রং। আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে ওঠে দাড়ালাম। দরজা খুলে খালি গায়েই বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। মাত্র এক ফুটের ব্যাবধানে পেঁজা তুলার মত স্নো পড়ছে। আমি পার্থিব সমস্ত অনুভুতি যেন হারিয়ে ফেল্লাম । শুণ্য তাপমাত্রায় যে খালি গাঁয়ে দাড়িয়ে আছি সেটা বেমালুম ভূলে গেলাম। হাত বাড়ালেই স্পর্শ করা যাবে পেঁজা তুলার মত নরম বরফ। কিন্তু স্পর্শ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ছুঁয়ে দিলেই যে স্বপ্নটা সত্যি হয়ে যাবে। এতদিন যে স্বপ্নটা সত্যি করে দেখার জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করেছি তা হাতের কাছে পেয়েও সত্যি করতে ইচ্ছে হচ্ছিলনা। এযেন প্রিয়তমাকে প্রথম ছোঁয়ার অনুভুতি।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মাটির কাছে যেতেই..

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

মাটির কাছে
যেতেই..


ছবি কৃতজ্ঞতাঃ https://pixabay.com/

ঠিক যেন
খা খা রোদ্দুর চারদিকে
চৈত্রের দাবদাহ দাবানলে
জ্বলে জ্বলে অঙ্গার ছাই ভস্ম
গোটা প্রান্তর
বন্ধ স্তব্ধ
পাখিদের আনাগোনাও

স্বপ্নবোনা মন আজ
উদাস মরুভূমি
মরা নদীর মত
স্রোতহীন নিস্তেজ-
আজ আর স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাকা ভাংতি করার মেশিন দরকার

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:১০

চলুন আজকে একটা সমস্যার কথা বলি৷ একটা সময় মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল৷ চাইলেই টাকা ভাংতি পাওয়া যেতো৷ এখন কেউ টাকা ভাংতি দিতে চায়না৷ কারো হাতে অনেক খুচরা টাকা দেখছেন৷ তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেলা ব‌য়ে যায়

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩০


সূর্যটা বল‌ছে সকাল
অথছ আমার সন্ধ্যা
টের পেলামনা ক‌বে কখন
ফু‌টে‌ছে রজনীগন্ধ্যা।

বাতা‌সে ক‌বে মি‌লি‌য়ে গে‌ছে
গোলাপ গোলাপ গন্ধ
ছু‌টে‌ছি কেবল ছু‌টে‌ছি কোথায়?
পথ হা‌রি‌য়ে অন্ধ।

সূর্যটা কাল উঠ‌বে আবার
আবা‌রো হ‌বে সকাল
পাকা চু‌ল ধবল সকলি
দেখ‌ছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পর্ণআসক্ত সেকুলার ঢাবি অধ্যাপকের কি আর হিজাব পছন্দ হবে!

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৩ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:২৭



ইন্দোনেশিয়ায় জাকার্তায় অনুষ্ঠিত একটা প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছে বাংলাদেশি নারীদের একটা রোবোটিক্স টিম। এই খবর শেয়ার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকা। সেখানে কমেন্ট করে বসেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ২৩ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:১৪


কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়
আমার বাবা-কাকারা সর্বমোট সাত ভাই, আর ফুফু দুইজন। সবমিলিয়ে নয়জন। একজন নাকি জন্মের পর মারা গিয়েছেন। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, আমার পিতামহ কামেল লোক ছিলেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×