গুনগুন করে গান গাইতে ছিলাম। কি নামে যে ডাকি...। বাসে ওঠার সময় মনে হলো কোন বাসে যে উঠি। কয়েকজন অতিচালাক বন্ধু আবার মেয়েদের আধিক্য যে বাসে সে বাসে গিয়ে উঠল। এদিকে আমাদের বাসের কয়েকজনের আফসোস, তারা বড় ধরনের মিস করে ফেলেছে। এ ভুলের উসুল বুঝি আর কখনোই হবে না। ডিপার্টমেন্টের রূপসী বলে কথা! বাসে উঠে বসে বসে ভাবছি কখন বাস ছাড়বে। আর যাব তেপান্তরে। কিন্তু বিপত্তি বাধল তখনই। জানতে পারলাম আমাদের ইয়ারের একজন এখনো পেঁৗছেনি। ধ্যাত, লেটকামারদের জ্বালাতনে আর পারা গেল না।
অবশেষে গাড়ি চলা আরম্ভ হলো; কিন্তু টিএসসির সামনে গিয়েই আবার থামল। তখন তো বাসের একজন গান গাওয়া আরম্ভ করল, গাড়ি চলে না, চলে না, চলে না রে। শো শো করে বাস ছুটে চলছে। কিছুক্ষণ পরেই রীতিমতো তা-ব শুরু হলো। প্রফেশনাল কোনো কনসার্টকেও হার মানাবে গানের আয়োজন। পাশাপাশি নাচানাচি তো আছেই। মনে মনে বললাম, তোমাদেরকেই খুঁজছে বাংলাদেশ! আমাদের বাসের ড্রাইভার মামাটি আবার বেশ করিতকর্মা। প্রমাণ দিচ্ছি। আমাদের বাসের সামনে অনেক বাস ছিল; কিন্তু ড্রাইভার মামার কারণেই আমাদের বাসটি চলে গেল সব বাসের সামনে। একেকটি বাস ক্রস করার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় প্রবল হাততালি। মনে হলো আইনের মোটামোটা বই পড়ার পাশাপাশি বছরে দু'তিনবার পিকনিক হলে মন্দ হয় না; কিন্তু ডিপার্টমেন্টের স্যাররা কি আর সেই কথা মানবেন!
অবশেষে গাড়ি ঠেকল তেপান্তরে। বলে নিই তেপান্তর একটি শুটিং সঙ্ট। এটি ময়মনসিংহে অবস্থিত। গাড়ি থেকে শুরু হলো হুড়োহুড়ি করে নামা। কার আগে কে নামতে পারে। বাস থেকে নামার পর তেপান্তরে প্রবেশ করলাম। ঢুকেই চার ক্রাউনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। মনে হয়েছিল তারা যেন আমাদের স্থাগত জানাচ্ছে। তাদের সঙ্গে একটা ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না। এখানে বলে রাখি এই ক্রাউনদের কিন্তু প্রাণ নেই। তেপান্তরে গিয়ে সবচেয়ে মজার যে জিনিসটি আমি আবিস্কার করলাম সেটি হলো তেপান্তরের দোলনা। বসে বসে দোল খেতে খেতে মনে হলো তেপান্তরে হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা; কিন্তু তা আর পারলাম কই? জনাকয়েক বড় আপুরও ইচ্ছে হলো তার দোলনায় চড়বে। অগত্যা আমাকেই ত্যাগ স্বীকার করতে হলো।
দোলনা ছেড়ে হেঁটে হেঁটে দেখছিলাম তেপান্তরের পথ। এক জায়গায় দেখলাম বড় এক ড্রাগন হা করে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে ড্রাগনের কাছেই গেলাম না! কিছুক্ষণ পরেই শুরু হলো নানা ধরনের আয়োজন। বিস্কিট দৌড়, মোরগের লড়াই, পিলু পাসিং, সুই-সুতা দৌড়সহ নানা ধরনের আয়োজন। সুই-সুতা দৌড়ে আসিফ নজরুল স্যারের মজার কারচুপি ছিল উপভোগ করার মতো। তারপরই শুরু হলো শিক্ষাথর্ী এবং শিক্ষকদের মধ্যে আকর্ষণীয় ক্রিকেট খেলা। আজব সব নিয়ম তাতে। যেমন স্যারদের বিরুদ্ধে জোরে বল করলে নো বল হবে, স্যাররা ক্যাচ আউট হবেন না ইত্যাদি। অবশেষে স্যাররাই ম্যাচটি জিতে নিলেন। ম্যাচ শেষে খাবারের আয়োজন। তারপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরু। শুরু হলো ইমন স্যারের গান দিয়ে। স্যার গাইলেন 'যেখানে সীমান্ত তোমার সেখানে বসন্ত আমার...'। গান শুনতে শুনতে মনে হলো আসলেই আমাদের বসন্তের শুরু পিকনিকের বর্ণিল আয়োজনের মাধ্যমে। এভাবেই নানা বর্ণিল আয়োজনের মাধ্যমে চলতে থাকে পিকনিক উৎসব। পিকনিক শেষে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান তাসলিমা মনসুর ম্যাডাম জানালেন, আমরা নাকি খুবই ভদ্রভাবে পিকনিক শেষ করতে পেরেছি। আমাদের ধন্যবাদও দিলেন। তখন আমাদের আর পায় কে। একজন তো বলেই ফেলল, দেখতে হবে না আমরা ঢাকা ইউনিভার্সিটির ল' ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট!
পাখির নীড়ে ফিরে আসার মতোই আমাদেরও আয়োজন শেষে ফেরার পথে যাত্রা শুরু করতে হয়েছে। সঙ্গী তখন একদিন তেপান্তরে কাটানোর স্মৃতি। স্মৃতিকাতরতা নিয়েই গাড়িতে উঠলাম ফিরতি পথে। সন্ধ্যা গড়িয়ে তখন রাত নেমেছে মাত্র। পিকনিক শেষ বলে পিকনিকের মুড কিন্তু তখনই শেষ হয়ে যায়নি। প্রমাণ পেলাম ফেরার পথে গান শুনে আর নাচানাচি দেখে। সে কথা আর না-ই বললাম।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০