প্রথম যেদিন ওদের বাড়ি গেলাম সেদিন ওর মা আমাকে দেখে আচঁলে হাত মুছতে মুছতে উঠে এলেন। আমার হাতে গুটিকতক চকলেট তুলে দিয়ে বললেন, খাও।
ভেতরের ঘরে দেয়ালে টাঙ্গানো দেবদেবীর ছবি। ঘরের অন্যান্য আসবাবপত্র দেখে মনে হয় আর্থিক ভাবে ওরা ততোটা সচ্ছল নয়। প্রকৃত পক্ষে খুব কষ্টে দিন কাটতো তাদের।বাড়ির সামনেই ছিলো ওদের নিজস্ব একটা মুদি দোকান। ওই দোকানের আয়ে চলতো ওরা।বিশ্বজিতের মাথার চুল লম্বা ছিলো। ক্লাসে শিক্ষকরা এই নিয়ে প্রশ্ন করলে বিশ্বজিৎ বলতো, স্যার মানতি (মানত) করছি।
শিক্ষকরা বেত উচাতে উচাতে বলতেন, এগুলো হবে না, চুল কাটাতে হবে।
আমরা কখনো জানতে পারিনি বিশ্বজিৎ কিসের জন্য মানত করেছিলো। শিক্ষকদের ভয়ে বেশির ভাগ দিন গুলো ও ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতো।
সে সময় চারিদিকে গুজব ছড়াতে লাগলো, ভারতে হিন্দুরা অযোধ্যায় বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে ফেলছে। পথে পথে নেমে গেল মিছিল- মসজিদ ভাঙ্গলে, মন্দির ভাঙ্গবে।
ক্রমেক্রমে শুরু হলো তান্ডব। হিন্দুদের বাড়িতে ইট ,স্যান্ডাল শুরু হলো। বাবা আমাকে স্কুলে যেতে দিলেন না। বারান্দায় গিয়ে ভীত চিত্তে দেখতে লাগলাম মানুষের তান্ডব।
বিশ্বজিৎদের বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছে ক্ষুব্ধ লোকজন। রাস্তায় ছুড়ে মারছে হাড়ি পাতিল, আসবাবপত্র। কেউ কেউ ওদের দোকান ভেঙ্গে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে দোকানের পণ্য, টাকা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম- বিশ্বজিৎদের ও হিন্দু বাড়ির আর্তনাদ!
মনের ভেতর তখন একটি কথাই বার বার উচ্চারিত হচ্ছিলো, বিশ্বজিৎরা তো কোনো দোষ করেনি। তোমরা ওদের ছেড়ে দাও। কে আর শোনে এই অক্ষমের কথা। মুহূর্তে শ্রীহীন হয়ে পড়লো বিশ্বজিৎদের ঘর। বিধ্বস্ত হয়ে পড়লো আশেপাশের সব হিন্দু বাড়ি।
বন্ধ হয়ে থাকা স্কুল অনেকদিন পর খুললো। বিশ্বজিৎ আর এলোনা। আমাকে সবাই জিজ্ঞেস করে, কিরে ওর খবর কি?
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। কি করে বলি, এটা কি কোনো মজাদার গল্প! আমরা তাঁর সন্তানতুল্য ছেলেরা সেদিন পাঁচ টাকা, দশ টাকা, বিশ টাকার নোট তুলে দিয়ে ছিলাম তাঁর হাতে।
একদিন হঠাৎ করেই গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। বিশ্বজিৎ বাড়িতে নেই। চাকরিতে আছে। খুব ইচ্ছা করছিলো ওর মা কে একনজর দেখে আসি। কিন্তু কি করে দাঁড়াই ওনার সামনে! কিই বা বলি। তিনি কি আগের মতো আমার হাতে চকলেট তুলে দেবেন? বিষন্ন মন নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
এখনো খুব জানতে ইচ্ছা করে কোথায়, কেমন আছে আমার বন্ধু, আমার চকলেট মা!
বিঃদ্রঃ গল্পটি যাযাদি(07/09/99) তে লেখক আতিকুল ইসলাম আনন নামে প্রকাশিত হয়ে ছিলো। গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার ছ'মাসের মাথায় আমি আমার হারানো বন্ধু ও চকলেট মাকে খুঁজে পেয়ে ছিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০