somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

[রং=মৎববহ][গাঢ়]দেয়ালের দাগ[/গাঢ়][/রং]

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ রাত ১২:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দেয়ালের এক পাশে ছাপ্পান্ন নাম্বার দাগ দেওয়ার সময় দরজায় ঠক ঠক করে আওয়াজ হলো। দাগটা টেনে মতিন সাহেব দরজা খুলে দিলেন।
'চাচা আমাকে চিনতে পারছেন? আমি সাইদ, রনজুর বন্ধু।'
মতিন সাহেব কোনো কথা বললেন না। কিন্তু সেদিকে সাইদের খেয়াল নেই। সে নিজেদের পরিচয় দেওয়ায় ব্যস্ত_ 'আমার কথা কি আপনার মনে পড়ছে না? সিলেটে আপনাদের আর আমাদের বাড়ি ছিল পাশাপাশি। আমার বাবা তারাপুর চা-বাগানে চাকরি করতেন।'

তারাপুর চা-বাগান কথাটা মতিন সাহেবের মাথায় ঢুকেছে। এর আগে সাইদ যা বলেছে তিনি তার কিছুই শোনেননি। এমনকি তিনি ছেলেটাকে চিনতেও পারছেন না। হঠাৎ তার খেয়াল হলো_ তিনি ওর কথা যেমন শুনছেন না, তেমনি বলছেনও না কিছু। তাই প্রশ্ন করলেন_ 'তুমি এখন আসছ কোত্থেকে? প্রশ্নটা করে একটু অস্বস্থি হলো, তুমি বলাটা কি ঠিক হলো...!
'চাচা সিলেট থেকেই আসছি।'

মতিন সাহেবের অস্বস্তি কেটে গেল। চাচা বলছে যখন তখন ্তুমি বললে সমস্যা হবে না। আর অস্বস্তি কেটে যেতেই তিনি সাইদকে চিনতে পারলেন। সাইদ, রনজুর বন্ধু। গিয়াস উদ্দিন সাহেবের ছেলে। ওর মা, পারুল ভাবী। খুব সুন্দরী ছিলেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পায়েস রাঁধুনী। রনজু আর সাইদের খুব ভাব ছিলো। একবার এই ছেলে রনজুর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। সেই সাইদ, তার একমাত্র ছেলে রনজুর কিশোর বেলার বন্ধু। তাকে চিনতে এত দেরি...! ভেতরে ভেতরে মতিন সাহেব লজ্জায় নুয়ে গেলেন।

সাইদ কথা বলেই চলেছে। সে এসএসসি পাস করেই চলে গিয়েছিল সৌদি আরবে। চার বছরে চারবার হজ্ব করেছে। টাকা রোজগার করেছে বেশ ভালোই। একমাস আগে ছুটিতে এসেছে। খুব লজ্জা নিয়ে বলল। বিয়ে করে তারপর ফিরে যাবে। মতিন সাহেবের পাশে এখন মর্জিনা বেগম এসে বসেছেন। তিনিই কথা বলছেন সাইদের সঙ্গে। আরবের গল্প হচ্ছে।

'বুঝলেন খালাম্মা, হেরা গুহা হইলো আপনের পঞ্চাশ তলা বিল্ডিংয়ের চাইতেও উচায়। একেবারে খাড়াখাড়িভাবে উঠে গেছে। সেই খানে যাওয়া বিরাট কষ্টের কাজ। তাকত না থাকলে ওঠা সম্ভবই না। আমি আল্ল্লাহ-নবীর নাম নিয়ে একদিন ওঠা শুরু করলাম। ভাবলাম নবী করিম (সা.) রোজ রোজ উঠতে পারলে আমি তার উম্মত হয়ে ক্যান পারবো না। বিশ্বাস করেন খালাম্মা, আল্লাহ আমারে সেই খোশ নসিব দিলেন।'

সাইদ যা যা বলছে, মর্জিনা বেগম এর সবটাই জানেন। এসব কথা তিনি কতবার শুনেছেন! তবুও সাইদের মুখ থেকে শুনতে তার ভালো লাগছে। অন্য কেউ এ রকম কথা বললে সামনেই বসতেন কি-না সন্দেহ। বাচাল বলে হয়তো উঠে যেতেন। কিন্তু এখন তার উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এই ছেলেটাকে রনজুর মতো আদর করতে ইচ্ছে করছে। বার বার পুরনো কথা মনে পড়ছে। তিন বছর ছিলেন সিলেটে। তখনকার প্রতিবেশি সাইদরা। রনজু আর সাইদ এক সঙ্গে থাকত সারাদিন। কিন্তু দুজনের চরিত্র দু'রকম। রনজু মেধাবী, ধীর স্থির আর খুব লাজুক। সাইদ ঠিক উল্টো। হৈ চৈ করতেই ওস্তাদ, পড়ালেখায় তেমন মন ছিল না। কিছুটা মনভুলা আর পাগলাটেও ছিল। এখনো মনে হয় সে রকমই আছে। ভুলোমন, পাগলাটে, বাচাল। তবু মর্জিনা বেগম বিষণ্ন মুগ্ধতা নিয়ে সাইদকে দেখছেন। কাস এইট পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছে রনজু আর সাইদ। তারপরই বিচ্ছিন্ন। এরপর রনজু ভালো রেজাল্ট করে কলেজে গিয়েছে। সাইদ গিয়েছে সৌদি আরবে। সাইদ শরীরের চামড়া পুড়িয়েছে মরুভূমির তাপে। আর রনজু পুড়িয়েছে তার ভেতর, অন্য আগুনে। সাইদ হেরা পর্বতের চূড়ায় উঠে নিচের দিকে তাকিয়ে পিপড়ার মতো প্রায় অদৃশ্য মানুষ দেখেছে। আর মর্জিনা বেগম সমতলে থেকেও নিজের ছেলের কাছে আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে গেছেন।

সাইদ চা খাচ্ছে আর তারাপুর বাগানের গল্প করছে। মতিন সাহেব খুব অবাক হয়ে গল্প শুনছেন। সাইদের জানার যেন আগ্রহ নেই। তার যত আগ্রহ সব বলতে। কোনো প্রশ্ন নেই। যেন সবকিছু তার জানা। মতিন সাহেব কিংবা মর্জিনা বেগম কাউকেই কোনো প্রশ্ন করেনি সে। এমনকি কোনো কুশল সংবাদও জানতে চায়নি। সবচেয়ে আশ্চর্য হলো, যে রনজুর পরিচয় নিয়ে সে এ বাড়িতে এসেছে তার কথা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করছে না। অবশ্য এজন্য মতিন সাহেব বেশ আনন্দিত। আগ্রহ, প্রশ্ন এসব কম থাকাটাই ভালো। রনজুর সঙ্গে সাইদের পার্থক্য এখানেই। রনজুর আগ্রহ যতটা উঁচু, প্রশ্ন ততটাই। সাইদ বড় ভালো, ওর ভেতরে প্রশ্ন কম।

মর্জিনা বেগম তাড়াহুড়া করে রেধেছেন। রনজুর পছন্দের খাবার তার বন্ধুর জন্য। চিংড়ি মাছ দিয়ে পুইশাক আর মোরগের মাংস। টেবিলে খাবার সাজিয়ে তিনি সাইদকে ডাকতে এলেন।
'খালাম্মা, দুইটা তো বেজে গেল। রনজু এখনো এল না? এক সঙ্গে বরং খাই।'
মর্জিনা বেগম স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে গেলেন। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

সাইদ বোকা বোকা চোখে মতিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন সে শ্রোতা।
'রনজু খুব ভাবত আর প্রশ্ন করতো। সব কিছু বদলে গিয়ে নতুনভাবে গড়তে চাইত। কিন্তু কীভাবে সেটা করতে হবে জানত না। তাই ছুটত ভাবনার পেছনে। মানুষের পেছনে ছুটত, ভুল মানুষের পেছনে। আমরা সেসব কিছুই জানতাম না। বুঝতাম না। শুধু রনজুকে ভুল বুঝলাম। তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম না। কিন্তু পরাজয় মানতে চাইনি কোনো দিন। তাই রনজু অভিমান করে চলে গেল। আজ থেকে ছাপ্পান্ন দিন আগে পাড়ার মোড় থেকে সে পালিয়েছে। দুটি সিসার পিণ্ড বুকের ভেতর রয়ে গিয়েছিল। তৃতীয়টা ফুসফুস ফুটো করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল...ঠিক ছাপ্পান্ন দিন আগে...।'





---------------------------------------


এই গল্পের পেছনে আছে আরেকটা গল্প। 2000 সালের দিকে, মৌলভীবাজারে একটা অনুষ্ঠানে দেয়ালে এমন দাগ দিয়ে স্মৃতি ধরে রাখার একটা গল্প বলেছিলেন wMqvm fvB। সেরাতেই লিখেছিলাম গল্পটা। ছেপেওছিলেন তিনি। তবে জানতেননা এই পেছনের কথা। আজ জানিয়ে দেয়ার পাশপাশি এও বলি কতটা এক হয়ে থাকতাম ভাবনায় আমরা তাকি বুঝতে পারেন গিয়াস ভাই?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
৪১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্যামুয়েল ব্যাকেট এর ‘এন্ডগেম’ | Endgame By Samuel Beckett নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা

লিখেছেন জাহিদ অনিক, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৮



এন্ডগেম/ইন্ডগেইম/এন্ডগেইম- যে নামেই ডাকা হোক না কেনও, মূলত একটাই নাটক স্যামুয়েল ব্যাকেটের Endgame. একদম আক্ষরিক অনুবাদ করলে বাংলা অর্থ হয়- শেষ খেলা। এটি একটা এক অঙ্কের নাটক; অর্থাৎ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যাঙ দমনের নেপথ্যে এবং রাষ্ট্রীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয়

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৭


ব্যাঙ দমনের বাংলায় একটা ইতিহাস আছে,খুবই মর্মান্তিক। বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানির কোন সার কেনা হতো না। প্রাচীন সনাতনী কৃষি পদ্ধতিতেই ভাটি বাংলা ফসল উৎপাদন করতো। পশ্চিমবঙ্গ কালক্রমে ব্রিটিশদের তথা এ অঞ্চলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পজ থেকে প্লে : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন বন্ধু শুভ, ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১৫


.
একটা বালক সর্বদা স্বপ্ন দেখতো সুন্দর একটা পৃথিবীর। একজন মানুষের জন্য একটা পৃথিবী কতটুকু? উত্তর হচ্ছে পুরো পৃথিবী; কিন্তু যতটা জুড়ে তার সরব উপস্থিতি ততটা- নির্দিষ্ট করে বললে। তো, বালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামে ভুল থাকলে মেজাজ ঠিক থাকে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৫


বেইলি রোডে এক রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে একজন একটা পোস্ট দিয়েছিলেন; পোস্টের শিরোনামঃ চুরান্ত অব্যবস্থাপনার কারনে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডকে দূর্ঘটনা বলা যায় না। ভালোভাবে দেখুন চারটা বানান ভুল। যিনি পোস্ট দিয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×