somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রকাশিতব্য বইয়ের বিজ্ঞাপন >> যোগাযোগের গভীর সমস্যা নিয়ে কয়েকজন একা একা লোক

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ রাত ১২:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও ব্রাত্য রাইসু বিরচিত
যোগাযোগের গভীর সমস্যা নিয়ে কয়েকজন একা একা লোক

(এই উপন্যাসটা আমরা লিখছিলাম 1994 থিকা 1996 সাল পর্যন্ত। আমি তখন বাংলাবাজার পত্রিকায় চাকরি করতাম। ওইখানে সাহিত্য পাতার সম্পাদক আছিলেন নির্মলেন্দু গুণ। তার সহকারী হিসাবে পাতার দেখাশোনা করতাম আমি। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যাররে আমি প্রস্তাব দিছিলাম দুই জন মিলা একটা গল্প লেখার। সে প্রস্তাবনা আছিল 1991 সালের। ভোরের কাগজ অফিস আছিল তখন শাহবাগে, সেইখানে। তখন স্যার কইলেন, গল্প দরকার কি, আমরা একটা উপন্যাসই তো এইভাবে লিখতে পারি। যুগ্মভাবে লেখা উপন্যাস কি ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপতে দৈনিক পত্রিকা তেমন ভাবে রাজি হয় নাই। বা আমরাও চেষ্টা করছিলাম কিনা মনে নাই। পরে গুণদা সানন্দে রাজি হইছিলেন।

এইখানে উপন্যাস পুরাটা আমরা এইখানে পোস্ট করবো না। এই পোস্ট বিজ্ঞাপনের অধিক কিছু না। বিজ্ঞাপনের বিনামূল্য পদ্ধতি হিসাবে সামহোয়্যাররে গ্রহণ করা হইল। বইমেলায় বইটা বের হইব কিনা দেখার বিষয়। কারণ প্রুফ দেখা সবে শুরু করছি। বইটা সন্দেশ থিকা বাইর হওনের কথা।)


এক

1.
প্রচুর ঘাস। গরু চরছে। মানুষও চরছে। চারণক্ষেত্র অভিন্ন। তবে মানুষের চারণের কারণ ভিন্ন। সেসব কারণ জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে জানানো সম্ভব। সংক্ষেপে জানাই : কারণ দার্শনিক। (যে-কোনো মহৎ সাহিত্য পাঠককে দর্শন উপহার দেয়। আমাদের এই এটুকু দর্শন উপহার দিতে পেরে আমরা গর্বিত।

মানুষেরা কেন চরে বেড়ায়? মানুষ তো (বইপত্রে যদ্দুর জানা যায়) ঘাস খায় না, তবুও মাঠে তারা কেন যায়? কিছু মানুষ গরুদের চ'রে-বেড়ানো অজটিল করার জন্যে মাঠে যায়, সেটা আমরা স্বীকার করি; এছাড়া আরো অনেকে যায়, যাদের সাথে গরুদের কোনো সম্পর্ক নেই।
ওই মাঠে একটি গাছের নিচে দুজন যুবককে দেখতে পেয়ে আব্দুর রাজ্জাক সেদিকে ধাবিত হয়। আব্দুর রাজ্জাকের হাতে একটি পলিথিনের ব্যাগ, তাতে এক পাতিল কাচাগোল্লা। সে দুজন যুবকের একজনকে--যে গোল সোনালী ফ্রেমের চশমার অভ্যন্তর থেকে করুণার দৃষ্টিতে জগৎ এবং মাঠকে পর্যবেক্ষণ করছিলো--জিগ্যেশ করলো, 'দীঘাপাতিয়ার রাজবাড়ির পথ কোনদিকে?'

করুণানিধি বললো, 'ক্ষমা করবেন, কোথায় যাবেন বললেন?'

আব্দুর রাজ্জাক আবার বললো, 'দীঘাপাতিয়া রাজবাড়ি।'

করুণানিধি তাকালো আব্দুর রাজ্জাকের দিকে, যেমন নবকুমারের দিকে অপূর্ব সুন্দরী ওই মহিলা (নামটি মনে নেই) তাকিয়েছিল, এবং বলেছিল, 'পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ?' সে বললো, 'দীঘাপাতিয়া তো মহাশয় নাটোরে। এ জায়গার নাম সাপাহার। আপনি সাপাহারে আছেন, দীঘাপাতিয়া অন্তত দুশ মাইশ দূর।'

আমরা জানি করুণানিধি বাংলা সাহিত্যের কৃতী ছাত্র। কিন্তু ভুগোল বিষয়ে নিশ্চয় সে অশ্বডিম্ব। কারণ সাপাহার থেকে নাটোর বড়জোর পঞ্চাশ কিলোমিটার হবে। কিন্তু আব্দুর রাজ্জাকের তা জানা নেই। সে মাথা চুলকিয়ে বলে, কিন্তু আমি যে কাচাগোল্ল্লাও কিনলাম, এবং ময়রা আমাকে বললো যে ওই দিকে যান, ওই মাঠ পার হয়ে, যে মাঠে গরু চরছে।

করুণানিধির সহযোগী এবার কৌতূহলী হয়। সে একদা মার্ক্সবাদে দীক্ষিত ছিল, এখন পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মী, বাতাসকল নামে তার একটি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বিষয়ক কবিতাগ্রন্থও আছে। আব্দুর রাজ্জাকের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে সে পাতিলটাতে উঁকি দেয়, এবং অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। দুটি গরু ঘাস খাওয়া থামিয়ে তার দিকে তাকায়। নির্লিপ্ত বিরক্ত ধরনের চাহনী, গরুরা যেভাবে তাকায় এবং তাদের চোখের সামনেই সে একটি মিষ্টান্ন উঁচু করে ধরে বলে, 'এই আপনার কাঁচাগোল্ল্লা?'

দুটি গরু সবিস্ময়ে দেখে একদা মার্ক্সবাদীর (এমা) হাতে একটি বড় মণ্ডা। গরুদের বিস্মিত হবার একাধিক কারণ আছে, কারণ কাঁচাগোল্লাই হোক মণ্ডাই হোক সেসব তৈরি তাদের দুধ থেকে। একদা মার্ক্সবাদীর হাত থেকে ততঃপর সে-মণ্ডাটি তার মুখের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যায়।
আব্দুর রাজ্জাকের মনে হলো তার পায়ের নিচে মাঠ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, আর সে তলিয়ে যাচ্ছে। না, মণ্ডার দুঃখে নয়, তার অন্তর্জগতের অন্তর্গত বিভ্রমের প্রাবল্যে। সে অতিকষ্টে বলে, 'সাপাহার! সাপাহার! আপনি নিশ্চিত?'

করুণানিধি তার কাঁধে করুণার হাত রেখে বলে 'ভাই, এই আপনি এবং আমি যেমন সত্য, এই মাঠ ও গরুগণ যেমন সত্য, এটাও তেমনি সত্য যে আপনি এখন সাপাহারে আছেন, দীঘাপাতিয়া থেকে দু'শ মাইল দূরে।'

মাঠ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসে আব্দুর রাজ্জাক। তার সমস্ত চেতনা জুড়ে শুধু একটিই প্রশ্ন, এত বড় একটি বিভ্রম ঘটল কী করে?

আর বিভ্রম তো একটি নয়, বহু। সে জানে, সে আশৈশব শুনে এসেছে, নাটোরের কাঁচাগোল্ল্লা জগৎবিখ্যাত। সাপাহার বাজারে একজন ময়রা তাকে এক কেজি মণ্ডা হাতে ধরিয়ে দিলো কাঁচাগোল্ল্লার বদলে, কাঁচাগোল্ল্লা বলে চালিয়ে দিলো, এবং সে-ও বিষয়টি বিন্দুমাত্র তদন্ত না করে, ব্যাগে ভর্তি করে ময়রা-প্রদর্শিত রাস্তা দিয়ে, অর্থাৎ গরু-অধু্যষিত মাঠের মধ্যখান দিয়ে সোৎসাহে রওনা হয়ে গেল দীঘপাতিয়া! তার চোখে একবারও দোকানের সাইনবোর্ড সাপাহার নামাঙ্কিত কোনো মাইলফলক কিচুই চোখে পড়লো না? কতো চিহ্ন, কত Signifier কত Signified চতুর্দিকে ভাসমান। তা থেকে একটিমাত্র সিদ্ধান্ত, একটি অর্থপূর্ণ টেক্সট সে উদ্ধার করতে পারলো না? একদা মার্ক্সবাদীর অট্টহাসি তার অস্তিত্বের মূলে আজ ধ্বস নামিয়ে দিয়েছে।

আব্দুর রাজ্জাক ভাবে, বাজার থেকে চলে আসার পর ময়রা ওই রকম অট্টহাসি হেসেছিল, ময়রার দোকানে বসা লোকগুলোও হেসেছিল; এমনকি দোকানের সামনে রাস্তায় পড়ে তাকা আতুড় অচল ভিখিরিটাও তাকে নিয়ে বিদ্রূপের হাসি হেসেছিল। হা খোদা! এবং হে ধরণী-দ্বিধা হও!
কিন্তু ধরণী দ্বিধা হলেও তার বিভ্রমের সুরাহা হয় কীভাবে? এই মৌল বিভ্রমের উৎপত্তি আজ সকালবেলায়। সেখানে, তার উৎসমুখে সন্ধান চালালে একটা বিহিত হয়তো হয়। কিন্তু চালাবে কে? আব্দুর রাজ্জাক? অসম্ভব?

আব্দুর রাজ্জাক এইমাত্র পা রেখেছে নিদাঘের মধ্যদিনে আতপ্ত এবং শুষ্ক বালুপথে। তার মাথায় অনেক চিন্তা। যে চিন্তাগুলো ঠোকাঠুকি করছে একটা আরেকটার সাথে। আরেকটা তার পরেরটার সাথে। তার মাথার ভিতরটা এখন ধীরস্থির চিন্তার জন্যে তৈরি নয়।

তাহলে বিভ্রম মোচনের দায়িত্ব কার? আমাদের? সে কী করে হয়, আমরা বিশ্বমানের একটি উপন্যাস লিখতে বসেছি-বাংলা ভাষায় এটি দ্বিতীয়; প্রথমটি অল্পকাল আগেই লিখিত হয়ে গেছে-আমাদের সে সময় কোথায়? এর বিকল্প হচ্ছে আপনাদের হাতে সে দায়িত্ব তুলে দেয়া; সেটিও অনুচিত; অথচ আব্দুর রাজ্জাক যেখানে নাটোরে থাকার কথা সেখানে সে এই মধ্যদিনে সাপাহারে উপস্থিত। এই রহস্যটির একটি কুলকিনারা তো করতে হয়। আমাদেরই করণীয় সেটি শেষ পর্যন্ত, এবং সেজন্য শুরু করতে হয় একেবারে শুরু থেকেই। ভাসমান বহু চিহ্ন জড়ো করে, আব্দুর রাজ্জাকের জীবনে ঘটে-যাওয়া অসংখ্য ঘটনা থেকে বাছাই করে কয়েকটি ঘটনা সূত্রবদ্ধ ক'রে, আমরা এই বিভ্রমের নিষ্পত্তি করবো।

2.
আব্দুর রাজ্জাক মাঠ পেরিয়ে প্রথমে দেখতে পায় সর্ষের ফুল। তারপর ক্ষেত। সর্ষের ক্ষেত যেখানে শেষ তার থেকে শুরু কলার বাগান। কলা বাগান তাকে আকর্ষণ করে। সে কলা বাগানের দিকে ছুটতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর সে তার ধাবমানতার কারণ বুঝতে পারে। কলাবাগানে দণ্ডায়মান দুটি বালিকা। নিরাপদ দূরত্ব থেকে তাদের সে নিরীক্ষণ করে। হঠাৎ আবিষ্কার করে বালিকা দুটি আসলে বালিকা নয়, তারা যুবতী। যুবতী দর্শনে আব্দুর রাজ্জাকের মনে ভাবের উদয় হয়। সে যে নাটোরে নেই এবং এই সাপাহারে উপস্থিত এতে সে যারপরনাই পুলকিত বোধ করে। সে মৃদু হাসি সহকারে কলাবাগানের দিকে অগ্রসর হয়। সে দেখতে পায় যুবতী দুজন বাড়ির ভেতরে চলে যাচ্ছে। কলা গাছের চারদিকে কেরোসিন কাঠের বেড়া। কেরোসিন কাঠের গেট বাড়িতে ঢোকার। একটি নামফলক সেখানে সাঁটা আছে। লেখা সরফরাজ খান / 'রাজবাড়ী' / দীঘাপাতিয়া / নাটোর। সে গেটের সামনে গিয়ে স্বর উচ্চ করে, 'বাড়িতে কেউ আছেন?'
মেয়ে দুটি এবার বাইরে বেরিয়ে আসে। যেন এর আগে আব্দুর রাজ্জাককে তারা দেখতে পায়নি। দুজনের একজন-আব্দুর রাজ্জাক ঠিক করতে পারে না কোনজন-বলে, 'বাড়িতে আমরা সবাই আছি। সবাই ছাড়াও একটি কুকুর আছে। আপনি কাকে চান?'

আব্দুর রাজ্জাক সাহস সঞ্চয় করে, 'এটি কি রাজবাড়ি?'

'জ্বী, এটি রাজবাড়ি, সরফ রাজ বাড়ি।'

এরপর আব্দুর রাজ্জাক কী বলবে ভেবে পায় না। কূটিল এই মুহূর্তে সরফরাজ খান বেরিয়ে আসেন। তিনি আব্দুর রাজ্জাককে দেখেই বিগলিত হয়ে পড়েন। তাকে ঘরে টেনে নেন। পরিচয় বরিয়ে দেন তার দুই মেয়ের সঙ্গে। বড় মেয়ের নাম বাবু, ছোট মেয়ে আনজু। আব্দুর রাজ্জাক বুঝতে পারে না কেন তাকে এত খাতির করা হচ্ছে। সে এখানে এসেছে একটি বিয়ের ঘটকালী করতে। ঘটকালী বললে বেশি বলা হয়। কিন্তু এছাড়া অন্য কিছু বললে সেগুলি আবার কম বলা হবে।

3.
আমাদের আব্দুর রাজ্জাক মোটামুটি মাসুদ রানার বয়সী। অথচ সরফরাজ সাহেব তাকে বিবেচনা করছেন অ্যাজ এ বয়স্ক লোক। বাধ্য হয়ে মহাশয় রাজ্জাককেও একটা হামবড়া হামবড়া ভাব বজায় রাখতে হচ্ছে। লাভ একটা হয়েছে তাতে। সরফরাজ সাহেব তাকে সিগারেট অফার করছেন। সে তা খাচ্ছেও। তুলনায় অসুবিধা হচ্ছে বেশি। এবং তা বেশ ইজ্জতমারা ও গুরুতর।
আব্দুর রাজ্জাকের যা যা খারাপ হচ্ছে :

ক.
মেয়ে দুটি (তার সমবয়সী না হলেও ভাববিনিময় সম্ভব এরকম বয়সী) তাকে চাচা ডাকা শুরু করেছে। একবার তাকে চাচা সাহেবও ডেকেছে। (সরফরাজ সাহেব তখন সামনে ছিলেন না)। দুটি মেয়েই আগাগোড়া শয়তান। ছিনাল ছিনাল একটা হাসি ঝুলিয়ে রাখে চোখেমুখে। আব্দুর রাজ্জাকের একটা আবছা ধারণা ছিলো সংসারের বড়ো মেয়েরা শিষ্ট হয়। এখানে এসে এ-ধারণাটি গেছে। 'চাচা' শুনতে তার খারাপ লাগছে না। খালু তো আর ডাকছে না। চাচা ডাকছে, তবে ভাবটি চাচামূলক নয়।

খ.
ঘরের মধ্যে বসে থাকতে হচ্ছে। সরফরাজ সাহেব তাকে একঝাক চিত্রবাংলা এবং আনন্দবিচিত্রা এনে দিয়ে গেছেন। সুস্থ সংস্কৃতির পক্ষে তার ভয়াবহ ভালোবাসা। ঢাকায় সে একটা সুস্থতা-অন্বেষী গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। তারা মাঝে মাঝেই ঢাকার বাইরে সংস্কৃতির আলো ছড়ানোর জন্যে যায়। ফলে সে বিনোদনমূলক বা যা কিছু শিক্ষা কিংবা জ্ঞানের সঙ্গে যায় না তা পড়ে না। সে হুমায়ূন আহমেদের বইও পড়ে না। সে দেখেছে ঢাকায় যারা উঠতি এবং নামী এবং গুণীজন তারা হুমায়ূন আহমেদের নাম শুনলেই নাক এবং ভুরু কুঁচকায়। সে নিজেও সেরকম অভ্যাস করেছে। তবে এখানে কেউ তো আর দেখতে পাচ্ছে না। সে হুমায়ূন আহমেদের বই নিয়ে এসেছে। রাতে পড়বে। এর মধ্যে একটি মেয়ে এসে মণ্ডা আর চা দিয়ে গেছে। এটি বাচ্চা এবং নিরীহ। বড়ো দুটির মতো পাকনা নয়।

কী নাম তোমার?

মেয়েটি তার নাম বলে। সফিয়া। আব্দুর রাজ্জাক ফিল করে জগতে সব মানুষেরই নাম থাকে। কারু একটি নাম, কারু দুটি।

সফিয়া, তোমার কি একটাই নাম?

না একটা না। আমার নাম দুইটা। আমার আরেকটা নাম আপনাকে পরে বলবো।

পরে বলার মতো বয়স তো সফিয়ার হয় নাই। সে কেন পরে বলতে চায়।

কীসে পড়ো তুমি?

নাইনে পড়ি। তবে নাইনে পড়ি বলে আমাকে ছোট ভাববেন না।

নাইনে পড়ে বলে কেন ছোট ভাবা যাবে না আব্দুর রাজ্জাক বুঝতে পারে না। নাইনে তো আরো অনেকেই পড়ে এবং তারা ছোটও।

মেয়েটির জ্ঞানতৃষ্ণা আছে বোঝা গেলো। দুটি প্রশ্ন সে রাজ্জাককে করেছে। দু'টির কোনোটির উত্তরই রাজ্জাক দিতে পারে নি। একটা প্রশ্ন ছিলো আব্দুর রাজ্জাকের রাজ্জাক নামটি সে নায়করাজ রাজ্জাকের নাম থেকে নিয়েছে কি না। দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিলো সে বিয়ে করেছে কি না।
আব্দুর রাজ্জাকের নিজেরও ধারণা তার নামটি অভিনেতা রাজ্জাকের নাম থেকেই তার পিতা-মাতা মেরে দিয়েছেন। তার মনে পড়ে সে ঢাকায় আসার পর প্রথম যখন দেশের বাড়িতে ফিরে যায় তখন তার পিতা-মাতা তার কাছ থেকে ঢাকার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক যে সব জিজ্ঞাসা তাকে করেছিল তার মধ্যে নায়করাজ রাজ্জাক সম্পর্কে একটি প্রশ্ন ছিলো। কিন্তু ততোদিনে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেল এবং উঠতি বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে শিখে নিয়েছে বাংলা ছবিতে দেখবার কিছু নেই। সে তার জনক-জননীকে জানায় যে সে আর এখন বাংলা ছায়াছবি দেখে না। বাংলা ছায়াছবি এখন আর মধ্যবিত্তের দেখবার জিনিস নয়। এখন কেবল রিকশাঅলারাই বাংলা ছবি দেখে। রিকশাঅলা উচ্চারণটি করার সময় আব্দুর রাজ্জাক স্বর প্রলম্বিত করে। বোঝা যায় সে যুগপৎ রিকশাঅলা এবং বাংলা ছবির নির্মাতা উভয়ের বিরুদ্ধেই ভয়ানক ক্ষিপ্ত।

প্রথম প্রশ্নের উত্তরদানে ব্যর্থ আব্দুর রাজ্জাক চেষ্টা করে দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর দিতে। সে রহস্য করে। এবং পাল্টা প্রশ্ন করে। মেয়েটিকে বলে, 'তোমার কী মনে হয়?'

মেয়েটি, সফিয়া, জানায় যে তার কিছুই মনে হয় না। তখন রাজ্জাক সফিয়াকে বলে তার কাছে তাদের এই গ্রাম ভালো লেগেছে। মেয়েটি এতে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়। সে রাজ্জাককে বুঝিয়ে বলে কেন দীঘাপাতিয়া কোনো গ্রাম নয়। এবং ঢাকা শহরের লোকদের এই মানসিকতা অত্যন্ত খারাপ একটি মানসিকতা। ঢাকার বাইরের সবকিছুকেই তারা গ্রাম মনে করে। শেষে সে বলে যে ঢাকা একটি নোংরা শহর।

ঢাকায় গিয়েছ কখনো?

ঢাকা আমি অনেকবারই গিয়েছি। আমার কাছে ভালো লাগে নি।

ঢাকা ভালো না লাগার কারণটি বোধগম্য নয় রাজ্জাকের। তার ধারণা ঢাকার বাইরের লোকেরা ঢাকায় থাকতে না পারার কারণে এরকম বলে। সে তার উপলব্ধির কথা ব্যক্ত করার পর মেয়েটি হাসতে হাসতে চলে যায়। হাসির মধ্যে বিদ্রূপ ছিলো। ক্লাস নাইনের একটি মেয়ে কীভাবে বিদ্রূপপূর্ণ হাসি হাসতে পারে! এদের তো এখন পুতুল খেলার বয়স। অথচ পুতুল না খেলে এরা বিদ্রূপের হাসি হাসছে। হাসিটি সশব্দ না হলেও এই হাসি সে দেখেছে আজ সকালে মিষ্টির দোকানে। দীঘাপাতিয়ার লোকজন কি তার বিরুদ্ধে কোনো চক্রান্ত পাকাচ্ছে? তাকে হেয় করার কোনো পরিকল্পনা? কিন্তু তারা কীভাবে জানবে যে সে এখানে এই দীঘাপাতিয়ায় আসছে। আর মিষ্টির দোকানের ময়রার সঙ্গে নিশ্চয়ই এই কিশোরীর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে কিছুই অসম্ভব নয়। যতোই দিন যাচ্ছে সব কিছুই সম্ভবের আওতায় চলে আসছে।

4.
এই বিশ্বাস থেকেই সে মেয়েদের সঙ্গে একান্তে কথা বলার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। এর মধ্যে একবার তার খোঁজে যখন সরফরাজ সাহেব এসেছিলেন। তখন সে বলে সরফরাজ সাহেব, আমি আপনার কন্যার সঙ্গে একটু আলাদাভাবে কথা বলতে চাই। তার আশঙ্কা ছিলো ভদ্রলোক জিনিসটা ভালোভাবে নিবেন না। কিন্তু ভদ্রলোক একজন প্রকৃত ভদ্রলোক বিধায় মেয়েদের ডাক দিলেন, 'বাচ্চারা যাও, চাচাকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসো।' বাবু আনজু দু বোনই সেজেছে।

আব্দুর রাজ্জাকের হৃদয়বৃত্তির আওয়াজ নিশ্চয়ই সরফরাজ সাহেব শুনতে পান নাই।

5.
আব্দুর রাজ্জাক জিজ্ঞেস করে, 'এখানে সাপ নেই?'

মধ্যম মেয়েটি--আনজু--জবাব দেয়, 'না হাপ নাই।'

'হাপ' কথাটি প্রথমে আব্দুর রাজ্জাক ধরতে পারে না। সাপকে হাপ বলতে সে দেখেছে অশিক্ষিত লোকদের। মেয়েটি শিক্ষিত হয়েছে কিন্তু সাপকে হাপ বলছে! এ-শিক্ষার মূল্য কোথায়। আসলে যা পড়ানো হয় সমাজে তার কোনো প্রয়োগ নেই। এরা শুদ্ধ করে সাপের নামটি বলতে পারছে না, এদের দিয়ে কী হবে। আজকে বিয়ে হলে কালকে অশুদ্ধ ভাষায় ঝগড়া শুরু করবে। সে জেনেশুনে কীভাবে...

6.
আব্দুর রাজ্জাককে মাঝখানে রেখে তিন বোন দু'পাশে হাঁটতে থাকে। আব্দুর রাজ্জাকের চিত্তে দোলা দেওয়ার জন্যেই বোধহয় এ-সময় চাঁদ ওঠে। পুকুরের পানিতে চাঁদ, ধানক্ষেতে আলো, ছাড়িয়ে মাঠে সর্ষের ক্ষেত সেখানে আলো, দূরে বোধহয় স্টেশন হবে সেখানেও আলো। পুকুরের চারপাশে নারকেল গাছ। তাতে আলো পড়ছে। গাছ এড়িয়ে আলো পড়ছে পুকুরে। তাতে আবার গাছের ছায়া। সৌন্দর্যের এই মহামারী আব্দুর রাজ্জাককে হতচকিত করে দেয়। আব্দুর রাজ্জাক ঝলকে ওঠে, 'আপনারা গান পারেন নাকি?'

--কেন, বিয়ের পর গান শোনাতে হবে নাকি?

এরা এমন ভাবে কথা বলছে যেন বিয়েটা আজ বাদে কাল ঘটতে যাচ্ছে। এখনো কোনো কিছুরই কোনো ঠিক নেই, বলছে বিয়ের পর গান শোনাতে হবে নাকি। বিয়ের পর গান শোনাতে হবে না নাচ দেখাতে হবে আব্দুর রাজ্জাক তার কী জানে। তার ঘুরতে ভালো লাগে, তার বস বলেছে বিয়ের পর গান শুনতে চাইবেন কিনা তা সে কীভাবে বলে। জগতে সব সময়ই ভুল প্রশ্ন ভুল লোককে করা হয়। সে বলে, 'এ-ব্যাপারে আমার ঠিক জানা নেই। তবে গান শুনেছি তিনি পছন্দই করেন।'

7.
পুকুর পাড়টা তেমন উঁচু নয়। বেশ সমতল। ফলে বাগান বাগান একটা ভাব দেয়। চারদিকে সরল সুপারি আর নারকেল গাছ সঙ্গ দিচ্ছে পুকুরের আয়তক্ষেত্রকে। এতগুলো সরল জ্যামিতিক এক্সপ্রেশনের মধ্যে ততোধিক সরল (!) তিন তিনটা মেয়ে--আব্দুর রাজ্জাকের হৃদয় মুচড়ে ওঠে। কারো একজনকে পছন্দ করতে তার খুব ভাব হয়। সে ঠিক করতে পারে না কাকে পছন্দ করবে। এদের মধ্যে বড়ো যে মেয়েটি তকে তো তার বস বিয়ে করতে যাচ্ছেন। এই মেয়েকে পছন্দ করা ঠিক হবে না। বাকি দু'জনের একজনের আবার বয়স নিতান্ত অল্প। তের-চৌদ্দ বছরের একটি মেয়েকে পছন্দ করা নৈতিকভাবে ঠিক কিনা সে জানে না। এবার ঢাকা গিয়ে মফিজ ভাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে। মফিজ ভাই দার্শনিক। জগতে কী ভালো এবং কী মন্দ, এবং তা কেন ভালো এবং কেন মন্দ এবং যা আছে তা কেন আছে এবং যা নাই তা কেন নাই এসব নিয়ে বলেন তিনি। আব্দুর রাজ্জাকের মন খারাপ হলে সে মফিজ ভাইয়ের কাছে যায়। তিনি তার নৈতিক এবং মানসিক সমস্যার কিউর করেন।

সে মনে মনে ঠিক করে নৈতিক এবং পারিপাশ্বর্িক দিক থেকে তার পছন্দ করা উচিত আনজুকে। সে আনজুর দিকে মিহি দৃষ্টিতে তাকায়। সেই হাসি হাসি মুখ ছিনাল ছিনাল হাসি। আনজু তাকে জিজ্ঞেস করে, 'ছেলে কী করে?'

ছেলে কী করে তা আব্দুর রাজ্জাক কীভাবে বলবে। মানুষ যা করে আসলে কি সে তা করে? সে ভাবতে পারেনি এরা এখনই এই প্রশ্নটি করবে। তার নিজেকে পুনরায় অতিরিক্ত বয়স্ক বোধ হয়।
সে উদাস ভাবে বলে, 'ছেলে ব্যবসা করে।'

ব্যবসার কথায় মেয়েদের মধ্যে প্রশান্তির ভাব চলে আসে। তারা আর জানতেও চায় না ছেলে কীসের ব্যবসা করে। কোথায় ব্যবসা করে। আব্দুর রাজ্জাক ক্ষুব্ধ হয়, এখন কেউ আর জানতে চায় না কীসের ব্যবসা, কোথায় ব্যবসা। মুক্ত বাজারে এখন সব ব্যবসাই সম্ভব এবং সম্ভাবনাময়।

8.
আব্দুর রাজ্জাক বলে, ছেলের তো গাড়ি আছে।

আনজু বাচালতা করে, 'ও ছেলে তা হলে গাড়ি চালায়!'

--গাড়ি চালালে আপত্তি আছে কোনো?

'না কোনো আপত্তি নাই। আমাদের কোনো কিছুতেই কোনো আপত্তি নাই। আমাদের বাবা-মা রাজি থাকলে আমরাও রাজি।'

--আমরাও মানে? ছেলে তো একজন আপনারা 'আমরাও' বলছেন যে?

'আমরাও মানে আমি রাজি।' বড়ো মেয়েটি উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করে। 'আমি ছেলের ছবি দেখেছি। আগের বিয়ের খবরও শুনেছি। আমার কোনো আপত্তি নাই।'

--ছেলের বয়স কিন্তু একটু বেশিই।

'আমি জানি! বাচ্চা ছেলেদের আমি পছন্দ করি না। একটু বেশি বয়সের হাসব্যান্ডই আমার পছন্দ।' মেয়েটির কণ্ঠস্বর একটু শুষ্ক। বোঝা যায় কোনো একটা সমস্যা কোথাও আছে। কী সমস্যা আব্দুর রাজ্জাক জানে না। সমস্যা যে কী তা কি বড়ো মেয়েটি--বাবু--নিজেই জানে।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ দুপুর ১:২৫
১২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×