সাইটসিইংএর যে গল্পটা ওরা করছিল তাতে তাতে একটা খেজুরগাছের গল্প ছিল। চৌদ্দ না ষোল মাথার এক খেজুর গাছ নাকি আছে এখানে, যা দেখতে ট্যুরিষ্টেরা খুব ভিড় করে! তো আমি রিক্সাচালককে জানিয়ে রাখলাম ফেরার পথে ঐ খেজুরগাছ যেন দেখিয়ে দেয় আমাদের। রিক্সাচালক সম্মত হয়ে মন দিল রাস্তার দিকে। বড় রাস্তা ছেড়ে রিক্সা পড়ল এক সরু রাস্তায়। বড় ফলকে দেখলাম লেখা আছে 'বেনফিশ মত্স বন্দর'। ভ্যান থামল এক ইটপাতা এবড়ো খেবড়ো রাস্তার মুখে। এই পর্যন্তই ছিল ভ্যানের যাত্রা। সামনেই নদীর পাড়। ওটুকু হেঁটে যেতে হবে। ভ্যান চালক এখানেই অপেক্ষা করবে আমাদের জন্যে। আমরা ফিরলে বকখালি পৌঁছে দিয়ে তবে তার ছুটি। এখানে এক পেট্রল পাম্প দেখলাম যার তৈলাধার মাটির উপরে। বিশাল পেটমোটা ডিম্বাকৃতি এক তৈলাধার যার দুটি মাথাই কাটা। এই প্রথম এক পেট্রল পাম্প দেখলাম যার তৈলাধার মাটির উপরে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, ইঞ্জিনের নৌকোরা সব এখান থেকেই তেল নিয়ে যায় আর যে সমস্ত যানবাহন আসে এখান থেকে মাছ নিয়ে যেতে তাদেরও তেলের যোগান এখান থেকেই যায়। উঁচু বাঁধানো পার ধরে আমরা এগোলাম নদীর দিকে। প্রথমেই যা চোখে পড়ল, সার সার র ংবেরঙের নৌকো দাঁড়িয়ে আছে মাটিতে। ভাটার নদী সরে গেছে বহুদূরে। সরু এক ফিতের মতো পড়ে আছে সামনে। আর বালুমাটিতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে নৌকোরা সব। জোয়ারের অপেক্ষায়।
একথাক বাঁধানো সিড়ি বেয়ে নেমে গেলাম এক লম্বা সিমেন্টের চাতালে। নদীর পারে খানিকটা জায়গা বাঁধিয়ে তৈরী হয়েছে এই বন্দর। বেনফিশের মত্স বন্দর। শেষ রাতের অন্ধকারে নৌকোরা সব এখান থেকে বেরিয়ে যায় সমুদ্রে । মাছ নিয়ে আবার এখানেই ফেরে দুপুরের শেষভাগে। তিনটে বাজতেই ফেরা শুরু হয় নৌকোদের। একে একে নৌকোরা সব ফেরে। সবই ইঞ্জিনের নৌকো। যেখানটাই 'ছই' থাকার কথা সেখানে এই নৌকোগুলোতে আছে এক কাঠের কেবিন। কোন কোন নৌকোর কেবিন আবার দোতলা। রঙ্বাহারি সব কেবিন। প্রায় সব নৌকোরই কেবিনের উপর সরু দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা আছে সারসার লটে মাছ, শুকিয়ে শুটকি করা হচ্ছে। নৌকোরা যেসময় ফিরতে শুরু করে , সেই সময় ধরে ওখানে হাজির হয় মাছের খরিদ্দারেরা। দু চারজন বেড়াতে আসা মানুষ ছাড়া আর যারা এখানে আছে সবাই মাছের সাথেই যুক্ত। কেউ কিনতে আসে তো কেউ সমুদ্র থেকে মাছ ধরে বিক্রি করতে। খদ্দেরও মিশ্র, কিছু স্থানীয় মানুষও আসে একটু কম দামে ভাল মাছ কিনতে আর আসে সব পাইকার, এখান থেকে সস্তায় কিনে নিয়ে একটু বেশি দামে বাজারে বিক্রী করতে। এই বাঁধানো চাতাল থেকে একটু দূরে ঐ তৈলধারের পাশেই বসে এক নিলামের বাজার। নৌকো থেকে মাছ নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ঐ মাঠে। নিলাম হয় সব মাছ আর তারপরেই সব লাল, নীল, হলুদ আর সবুজ প্লাষ্টিকের প্যাকি ংবাক্সে উপরে নিচে বরফ বিছিয়ে দিয়ে বাক্সবন্দী হয় সব মাছে। অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা ছোট বড় মাঝারি সব ট্রাক আর লরী। মাছের বাক্স পিঠে চাপিয়ে এখুনি সব ছুটবে গঞ্জ-শহরের উদ্দেশ্যে।
নদীর পারে বানানো এই চাতাল নদী থেকে প্রায় দু মানুষ সমান উঁচু। এই চাতাল ঠিক নদীর পারে নয় বলা চলে নদীর উপরেই বানানো হয়েছে। ভাটার নদী সরে যেখানে এসে দাঁড়ায় সেখানে এই বাঁধানো চাতাল। আমার বড় ইচ্ছে হচ্ছিল জোয়ারের নদী দেখার, জোয়ারে এই বন্দর কেমন দেখায় তা দেখার কিন্তু সে উপায় নেই। এখুনি ফিরতে হবে আর জোয়ার আসতে আসতে সেই সন্ধ্যে পার! চাতালের ডানপাশে নদীর শান্ত জল আর বাঁপাশে জল সরে যওঅ্যা নদীতট। যেখানে ইতস্তত : দাঁড়িয়ে র-ংবেরঙের সব নৌকো। আচ্ছা এই নৌকোগুলো কি জোয়ার এলে জালে ভাসে রোজ? কাকে জিজ্ঞেস করি? থাক! কি হবে জেনে ... নদীর ওপার কালচে সবুজে ছাওয়া। দৃষ্টি চলে না ঐ সবুজের ভেতর দিয়ে। যতদূর চোখ যায় এক কালচে গাঢ় সবুজ বিস্তৃত নদীতীর ধরে। ওখানে কি কোন গ্রাম আছে? আছে জনবসতি? আছে নিশ্চয়ই! কিন্তু এখান থেকে এই মত্সবন্দরে দাঁড়িয়ে তার আভাসটুকুও পাওয়া গেল না। চোখ গেল পশ্চিমে, যেখানে সূর্য ঢলে পড়েছে নদীর বুকে। নদীর জলে আরেকটা সূর্য দেখতে পেলাম। সূর্যের দিকে বেশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও চোখে লাগল না। এতটা নিষ্পাণ সূর্য! সরু রোগাভোগা নিস্তরঙ্গ নদীর বুকে এক নিষ্পাণ সূর্য ঢলে পড়েছে। এক মরা আলো শুধু চিকচিক করছে জলের ভেতর!
দুপুরে খেতে বসে মাছের গল্প শুনে আর এখানে এসে এই নৌকো থেকে মাছ নামানো দেখে মনে হল, কিছু মাছ কিনে নিলে কেমন হয়! রান্না তো সেই দোকানি বৌদি করে দেবেই বলেছে। তো যেই ভাবা সেই কাজ। মাছ কেনার উদ্দেশ্যে এবার শুরু হল এই নৌকো ঐ নৌকোতে চোখ দিয়ে খোঁজার পালা। কোন নৌকো থেকে কি মাছ নামছে সে দেখে নিয়ে সেইমত কেনা হবে। দেখলাম আরও বেশ কিছু বেড়াতে আসা মানুষও এভাবেই মাছ কেনার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছেন। এর মধ্যেই একটি নৌকো থেকে একজন জিগ্যেস করল, আপনারা কি জম্বুদ্বীপে যাবেন? চলুন না। বেড়িয়ে আসবেন! আমার তো নৌকোয় করে সাগরের উপর দিয়ে দ্বীপে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে ষোল আনা কিন্তু সময়! সময় কোথায়? এখন দ্বীপ দেখতে গেলে ফিরতেই তো সন্ধ্যে পার! তাহলে আর বকখালি বিচে বসা হবে না বিকেলে! দ্বীপে বেড়াতে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিলাম। একদিনে আর কতটুকুই বা দেখা যায়! একটি নৌকো এসে বন্দরে ভিড়ছে দেখে ওদিকে তাকালাম, ভেতরে লোকজন বসে আছে দেখে বুঝলাম, এই নৌকোটি সেই জম্বুদ্বীপ থেকে ফিরল! চাতালের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলাম বলে চোখে পড়ল, ভেতরে একজন মহিলা বসে আছেন। সাথে আরও কিছু লোকজন চোখে পড়ল কিন্তু সেদিকে মন গেল না। আবারও চোখ ফেরালাম মাছের নৌকোর দিকে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০