somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পায়ের তলায় সর্ষে-4

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০০৬ রাত ১১:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফ্রেজারগঞ্জে বেনফিশের মত্স বন্দর দেখব বলে এগোলাম ভ্যানরিক্সার দিকে। এখান থেকে যেতে হলে ভ্যান ছাড়া গতি নেই। ভ্যানরিক্সার চালকেরা এক জায়গায় জটলা করছিল কেউ বসে কেউ বা দাঁড়িয়ে। দু-তিনজন এগিয়ে এল আমাদের দিকে। সাইটসিইং এ তারা কোথায় কোথায় নিয়ে যাবে সে শুনিয়ে রেখেছিল আগেই। দর দস্তুর করে একজনকে ঠিক করা হল। সাইটসিইং এর জন্যে নয়, সে শুধু আমাদের ঐ মত্সবন্দরে নিয়ে যাবে আর তারপর আবার এখানেই ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। ভ্যানচালক মশায় বহু ভ্যানতারা করছিলেন, কি কি দেখার আছে এখানে, যা না দেখলে এই বকখালি আসার কোন মানেই হয় না কিন্তু আমার কত্তা তাঁর কোন কথাতেই কান দিলেন না, হুকুম দিলেন, তুমি আমাদের ঐ বন্দরে নিয়ে চল আর কিছু দেখাতে হবে না! অগত্যা ভ্যানচালক মন দিলেন ভ্যান চালানোতে। আমরা দুজনেই দেখতে শুনতে মাশ আল্লাহ তো ভ্যানচালকের পরামর্শ অনুযায়ী ভ্যানের দু মাথায় দুজনে বসলাম। তিনি সামনের দিকে মুখ করে আর আমি পেছনের দিকে। আমি দেখছি ফেলে আসা রাস্তা তো তিনি দেখছেন সামনের রাস্তা, বেশ রোমান্টিক যাত্রা। নীরব শুনশান রাজপথ। দুপাশে কোথাও বিস্তৃত ফসলের মাঠ তো কোথাও দূরে গ্রাম। জনপ্রাণী নেই কোথাও। পড়ন্ত দুপুরের নিষ্পাণ রোদ। কারও মুখে কথা নেই এমনকি ভ্যানচালকেরও নয়। ভ্যানরিক্সার চলার শব্দ শুধু।

সাইটসিইংএর যে গল্পটা ওরা করছিল তাতে তাতে একটা খেজুরগাছের গল্প ছিল। চৌদ্দ না ষোল মাথার এক খেজুর গাছ নাকি আছে এখানে, যা দেখতে ট্যুরিষ্টেরা খুব ভিড় করে! তো আমি রিক্সাচালককে জানিয়ে রাখলাম ফেরার পথে ঐ খেজুরগাছ যেন দেখিয়ে দেয় আমাদের। রিক্সাচালক সম্মত হয়ে মন দিল রাস্তার দিকে। বড় রাস্তা ছেড়ে রিক্সা পড়ল এক সরু রাস্তায়। বড় ফলকে দেখলাম লেখা আছে 'বেনফিশ মত্স বন্দর'। ভ্যান থামল এক ইটপাতা এবড়ো খেবড়ো রাস্তার মুখে। এই পর্যন্তই ছিল ভ্যানের যাত্রা। সামনেই নদীর পাড়। ওটুকু হেঁটে যেতে হবে। ভ্যান চালক এখানেই অপেক্ষা করবে আমাদের জন্যে। আমরা ফিরলে বকখালি পৌঁছে দিয়ে তবে তার ছুটি। এখানে এক পেট্রল পাম্প দেখলাম যার তৈলাধার মাটির উপরে। বিশাল পেটমোটা ডিম্বাকৃতি এক তৈলাধার যার দুটি মাথাই কাটা। এই প্রথম এক পেট্রল পাম্প দেখলাম যার তৈলাধার মাটির উপরে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, ইঞ্জিনের নৌকোরা সব এখান থেকেই তেল নিয়ে যায় আর যে সমস্ত যানবাহন আসে এখান থেকে মাছ নিয়ে যেতে তাদেরও তেলের যোগান এখান থেকেই যায়। উঁচু বাঁধানো পার ধরে আমরা এগোলাম নদীর দিকে। প্রথমেই যা চোখে পড়ল, সার সার র ংবেরঙের নৌকো দাঁড়িয়ে আছে মাটিতে। ভাটার নদী সরে গেছে বহুদূরে। সরু এক ফিতের মতো পড়ে আছে সামনে। আর বালুমাটিতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে নৌকোরা সব। জোয়ারের অপেক্ষায়।

একথাক বাঁধানো সিড়ি বেয়ে নেমে গেলাম এক লম্বা সিমেন্টের চাতালে। নদীর পারে খানিকটা জায়গা বাঁধিয়ে তৈরী হয়েছে এই বন্দর। বেনফিশের মত্স বন্দর। শেষ রাতের অন্ধকারে নৌকোরা সব এখান থেকে বেরিয়ে যায় সমুদ্রে । মাছ নিয়ে আবার এখানেই ফেরে দুপুরের শেষভাগে। তিনটে বাজতেই ফেরা শুরু হয় নৌকোদের। একে একে নৌকোরা সব ফেরে। সবই ইঞ্জিনের নৌকো। যেখানটাই 'ছই' থাকার কথা সেখানে এই নৌকোগুলোতে আছে এক কাঠের কেবিন। কোন কোন নৌকোর কেবিন আবার দোতলা। রঙ্বাহারি সব কেবিন। প্রায় সব নৌকোরই কেবিনের উপর সরু দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা আছে সারসার লটে মাছ, শুকিয়ে শুটকি করা হচ্ছে। নৌকোরা যেসময় ফিরতে শুরু করে , সেই সময় ধরে ওখানে হাজির হয় মাছের খরিদ্দারেরা। দু চারজন বেড়াতে আসা মানুষ ছাড়া আর যারা এখানে আছে সবাই মাছের সাথেই যুক্ত। কেউ কিনতে আসে তো কেউ সমুদ্র থেকে মাছ ধরে বিক্রি করতে। খদ্দেরও মিশ্র, কিছু স্থানীয় মানুষও আসে একটু কম দামে ভাল মাছ কিনতে আর আসে সব পাইকার, এখান থেকে সস্তায় কিনে নিয়ে একটু বেশি দামে বাজারে বিক্রী করতে। এই বাঁধানো চাতাল থেকে একটু দূরে ঐ তৈলধারের পাশেই বসে এক নিলামের বাজার। নৌকো থেকে মাছ নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ঐ মাঠে। নিলাম হয় সব মাছ আর তারপরেই সব লাল, নীল, হলুদ আর সবুজ প্লাষ্টিকের প্যাকি ংবাক্সে উপরে নিচে বরফ বিছিয়ে দিয়ে বাক্সবন্দী হয় সব মাছে। অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা ছোট বড় মাঝারি সব ট্রাক আর লরী। মাছের বাক্স পিঠে চাপিয়ে এখুনি সব ছুটবে গঞ্জ-শহরের উদ্দেশ্যে।

নদীর পারে বানানো এই চাতাল নদী থেকে প্রায় দু মানুষ সমান উঁচু। এই চাতাল ঠিক নদীর পারে নয় বলা চলে নদীর উপরেই বানানো হয়েছে। ভাটার নদী সরে যেখানে এসে দাঁড়ায় সেখানে এই বাঁধানো চাতাল। আমার বড় ইচ্ছে হচ্ছিল জোয়ারের নদী দেখার, জোয়ারে এই বন্দর কেমন দেখায় তা দেখার কিন্তু সে উপায় নেই। এখুনি ফিরতে হবে আর জোয়ার আসতে আসতে সেই সন্ধ্যে পার! চাতালের ডানপাশে নদীর শান্ত জল আর বাঁপাশে জল সরে যওঅ্যা নদীতট। যেখানে ইতস্তত : দাঁড়িয়ে র-ংবেরঙের সব নৌকো। আচ্ছা এই নৌকোগুলো কি জোয়ার এলে জালে ভাসে রোজ? কাকে জিজ্ঞেস করি? থাক! কি হবে জেনে ... নদীর ওপার কালচে সবুজে ছাওয়া। দৃষ্টি চলে না ঐ সবুজের ভেতর দিয়ে। যতদূর চোখ যায় এক কালচে গাঢ় সবুজ বিস্তৃত নদীতীর ধরে। ওখানে কি কোন গ্রাম আছে? আছে জনবসতি? আছে নিশ্চয়ই! কিন্তু এখান থেকে এই মত্সবন্দরে দাঁড়িয়ে তার আভাসটুকুও পাওয়া গেল না। চোখ গেল পশ্চিমে, যেখানে সূর্য ঢলে পড়েছে নদীর বুকে। নদীর জলে আরেকটা সূর্য দেখতে পেলাম। সূর্যের দিকে বেশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও চোখে লাগল না। এতটা নিষ্পাণ সূর্য! সরু রোগাভোগা নিস্তরঙ্গ নদীর বুকে এক নিষ্পাণ সূর্য ঢলে পড়েছে। এক মরা আলো শুধু চিকচিক করছে জলের ভেতর!

দুপুরে খেতে বসে মাছের গল্প শুনে আর এখানে এসে এই নৌকো থেকে মাছ নামানো দেখে মনে হল, কিছু মাছ কিনে নিলে কেমন হয়! রান্না তো সেই দোকানি বৌদি করে দেবেই বলেছে। তো যেই ভাবা সেই কাজ। মাছ কেনার উদ্দেশ্যে এবার শুরু হল এই নৌকো ঐ নৌকোতে চোখ দিয়ে খোঁজার পালা। কোন নৌকো থেকে কি মাছ নামছে সে দেখে নিয়ে সেইমত কেনা হবে। দেখলাম আরও বেশ কিছু বেড়াতে আসা মানুষও এভাবেই মাছ কেনার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছেন। এর মধ্যেই একটি নৌকো থেকে একজন জিগ্যেস করল, আপনারা কি জম্বুদ্বীপে যাবেন? চলুন না। বেড়িয়ে আসবেন! আমার তো নৌকোয় করে সাগরের উপর দিয়ে দ্বীপে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে ষোল আনা কিন্তু সময়! সময় কোথায়? এখন দ্বীপ দেখতে গেলে ফিরতেই তো সন্ধ্যে পার! তাহলে আর বকখালি বিচে বসা হবে না বিকেলে! দ্বীপে বেড়াতে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিলাম। একদিনে আর কতটুকুই বা দেখা যায়! একটি নৌকো এসে বন্দরে ভিড়ছে দেখে ওদিকে তাকালাম, ভেতরে লোকজন বসে আছে দেখে বুঝলাম, এই নৌকোটি সেই জম্বুদ্বীপ থেকে ফিরল! চাতালের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলাম বলে চোখে পড়ল, ভেতরে একজন মহিলা বসে আছেন। সাথে আরও কিছু লোকজন চোখে পড়ল কিন্তু সেদিকে মন গেল না। আবারও চোখ ফেরালাম মাছের নৌকোর দিকে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরী

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৯

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরীঃ


১। নিজের সিভি নিজে লেখা শিখবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করার অভ্যাস থাকতে হবে। কম্পিউটারের দোকান থেকে সিভি বানাবেন না। তবে চাইলে, প্রফেশনাল সিভি মেকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×