somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রংপুরের পত্র পত্রিকার দেড়শ বছরের ইতিহাস : দেশের প্রেথম সংবাদ পত্র "রঙ্গপুর বার্তাবহ"

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সম্প্রতি রংপুরবাসী ধারাবাহিক আন্দোলনের ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় রংপুর সিটি কর্পোরেশন। এর আগে হয় রংপুর বিভাগ। ফলে দেশের অন্যতম প্রধান নগরী হিসেবে পরিচিত রংপুর দেশের সপ্তম বিভাগীয় শহর এবং দশম সিটি কর্পোরেশন। তবে একটি দিক দিয়ে রংপুর অন্য অঞ্চলের থেকে অনেক অনেক দূর এগিয়ে রয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে আজ থেকে দেড়শত বছর আগে রংপুরের সদ্যপুস্করনী এলাকা থেকে সংবাদ পত্র প্রকাশিত হয়েছিল যা ছিল বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র।

রংপুরের পত্র পত্রিকা :


১৮৪৭ সালের আগস্টের শেষভাগে (ভাদ্র ১২৫৪ বঙ্গাব্দ) রংপুর থেকে প্রকাশিত হয় সংবাদ পত্র "রঙ্গপুর বার্তাবহ"। কুন্ডির জমিদার কালী চন্দ্র রায় চৌধুরীর অর্থায়নে প্রকাশিত হয় এই পত্রিকা। সম্পাদক ছিলেন গুরুচরন রায়। এটাই বাংলাদেশের প্রথম সংবাদ পত্র। ১৮৫৭ সালের ১৩ জুন গভর্নর লর্ড ক্যানিং জারী করেন ১৫ নং আইন। মুদ্রণ যন্ত্রের স্বাধীনতা নাশক এই আইনে ১৮৫৯ সালে বন্ধ করে দেয়া হয় রঙ্গপুর বার্তাবহ। প্রকাশিত হওয়ার সময় থেকে পরের এক যুগ সময় রঙ্গপুর বার্তাবহ মানুষকে সচেতন করার ক্ষেত্রে যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিল তা সত্যিই গর্ব করার মতো।

এর পরে বৃহত্তর রংপুর থেকে আর একটি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৬০ সালের এপ্রিলে "রঙ্গপুর দিক প্রকাশ" প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কাকিনার জমিদার শম্ভু চন্দ্র রায় চৌধুরী। সম্পাদক ছিলেন মধু সূদন ভট্টাচার্য। এই পত্রিকাটি ২৪ বছর টিকে ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে রংপুর অঞ্চল থেকে বেশ কিছু পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রংপুরের আদি শহর মাহিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত "উত্তরবঙ্গ হিতৈষী"। পাক্ষিক এই পত্রিকাটির প্রকাশ কাল ১৮৮৭ সাল।

১৯০৭ সালে প্রকাশিত হয় "রংপুর দর্পণ"। এই পত্রিকাটি ছিল সাপ্তাহিক। ১৯০৮ সালে বৃহত্তর রংপুরের লালমনিরহাট এর কাকিনা শাহরিয়া প্রিন্টিং ওয়ার্কস থেকে কবি শেখ ফজলুল করিমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় "বাসনা"। এটি ছিল সমালোচনা ধর্মী মাসিক পত্রিকা একটি । এই পত্রিকাকে ঘিরেই রংপুর অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল একটি শক্তিশালী সাহিত্যিক গোষ্ঠী



১৯১০ সালে ক্ষত্রিয় সমিতি প্রতিষ্ঠিত হলে প্রকাশিত হয় "ক্ষত্রিয়" নামে একটি পত্রিকা। ১৯২৬ সালে রাম মোহন ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হলে ক্লাব কর্তৃপক্ষ "মিলন" নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করে। এই পত্রিকা প্রথম ত্রৈমাসিক ছিল পরে যা মাসিক রূপে প্রকাশিত হয়। দেশ বিভাগকালীন সময়ে রংপুর থেকে প্রকাশিত হয় "কোরবান", যা ছিল মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের পত্রিকা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলে এই পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৬০ সালে আবু সাদেক পেয়ারার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় "সাপ্তাহিক উত্তর বাংলা"। ইসহাক চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় "বার্তা" নামে আরেকটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। ১৯৬১ সালে কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক মোঃ আবু তালিবের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় "রাহবার"। একই সময় জেলা পরিষদের উদ্যোগে এবং কবি কায়সুল হকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় "মাসিক উন্নয়ন"। পরে এই পত্রিকার সম্পাদক হন অধ্যাপক নূরুল ইসলাম। এসময় সন্ধানী সংঘের তসলিম উদ্দিন বাবু বের করেন মাসিক সন্ধানী।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত হতো "রণাঙ্গন" নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা যার সম্পাদক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা বাটুল। খুব গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হতো। মূল্য ছিল পনেরো পয়সা (০.১৫ পয়সা)। একই সময়ে সাপ্তাহিক "সোনার বাংলা" প্রকাশিত হতো ফুলু সরকারের সম্পাদনায়। রংপুর অঞ্চলে মুক্তি সংগ্রামে এই দুই পত্রিকার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

স্বাধীনতার পরে সাপ্তাহিক "রণাঙ্গন" ছাড়পত্র না পাওয়ায় জনাব গোলাম মোস্তফা বাটুল সাহেব বের করেন "মহাকাল"। পরে ১৯৮১ সালে তিনি প্রকাশ করেন "দৈনিক দাবানল"। পত্রিকাটি এখনও চালু আছে। ‘দৈনিক রংপুর’ রংপুর থেকে প্রকাশিত প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র। যা ১৯৭২ সালের মার্চে প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘দৈনিক রংপুর’ ছিল মিনি সাইজের পত্রিকা, দাম মাত্র পাঁচ পয়সা। মোনাজাত উদ্দিন ছিলেন এর সম্পাদক-প্রকাশক। কিন্তু এই পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে আর্থিক সাপোর্ট ছিল স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর। তার সাথে মোনাজাত উদ্দিনের সম্পর্কের ইতি ঘটলে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়ে বেশ কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হলেও সেগুলি টিকতে পারেনি। যাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন প্রকাশ করেন "সাপ্তাহিক জনতার কণ্ঠ"। "সাপ্তাহিক আলোর সন্ধানে" প্রকাশ করেন সৈয়দ শাহজাহান মিয়া। রয়েছে আব্দুল হাফিজ সম্পাদিত "সাপ্তাহিক প্রতিফলন"। আশির দশকে এ্যাড শাহ্‌ আনিসুজ্জামান প্রকাশ করেন "সাপ্তাহিক রাঙ্গা প্রভাত"। পরে এই পত্রিকা দৈনিকে রূপান্তরিত হয় এবং দীর্ঘ দিন চলার পরে এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। 'আঁখিরা' ও 'রংপুর বার্তা' নামে আরও দুইটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। আঁখিরা পরে দৈনিক হিসেবে মাসুদ উর রহমান মিলুর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি এখনও অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়।

১৯৯২ সালে প্রিন্টিং জগতে বিপ্লব সাধিত হয় কম্পিউটার কম্পোজের মাধ্যমে অফসেট প্রিন্ট আসায়। এসময় শিল্পপতি রহিম উদ্দিন ভরসার অর্থায়নে প্রকাশিত হয় "দৈনিক যুগের আলো" যা এখনও প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে পত্রিকাটি বহুল প্রচারিত একটি স্থানীয় সংবাদপত্র। নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগে ফজলুল হকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় "দৈনিক পরিবেশ"। বর্তমানে পত্রিকাটি বহুল প্রচারিত। ১৯৯৩ সালে বিজলী নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হলেও তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালে দৈনিক রংপুর পৃথক ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত হলেও কিছুদিন পরে তা অনিয়মিত হয়ে যায়। ১৯৯১ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা মুকুল মুস্তাফিজের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় "সাপ্তাহিক অটল"। তিনি দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে ১৭ বছর চলার পরে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০০০ সালে হাবিবুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দৈনিক অর্জন। এরপরে প্রকাশিত হয় "দৈনিক রংপুর চিত্র", "দৈনিক মায়া বাজার","দৈনিক সাইফ"। এই পত্রিকা গুলি এখনও প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে নিয়মিত এবং ভূমিকা রাখছে রংপুরের সার্বিক উন্নয়নে।

তথ্য সূত্র :
১) লেখক, সাংবাদিক মাহবুব রহমান হাবু ভাইয়ের প্রবন্ধ : "রংপুরের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট"
২) রংপুর সংবর্তিকা : অধ্যাপক আব্দুল আলিম উদ্দিন
৩)

ফটো ক্রেডিট : সুশান্ত চন্দ্র খান, ৪৫৬ বিঘা জমি দানকারী কারমাইকেল কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সম্পাদক সুরেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরীর নাত জামাই।

লেখক ঃ প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী ও সাবেক ছাত্রনেতা।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এমপি আনারের মৃত্যু এবং মানুষের উষ্মা

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:২৯


সম্প্রতি ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার পর আনোয়ারুল আজীম আনার নামে একজন বাংলাদেশি এমপি নিখোঁজ এবং পরবর্তীতে তাকে শ্বাসরোধে হত্যার পর তার মরদেহের হাড়-মাংস আলাদা করে হাপিত্যেশ করে দেওয়া হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

দোয়া ও ক্রিকেট

লিখেছেন শাহাবুিদ্দন শুভ, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৪


দোয়া যদি আমরাই করি
তোমরা তাইলে করবা কি?
বোর্ডের চেয়ারম্যান, নির্বাচকের
দুইপায়েতে মাখাও ঘি।

খেলা হচ্ছে খেলার জায়গা
দোয়ায় যদি হইত কাম।
সৌদিআরব সব খেলাতে
জিতে দেখাইত তাদের নাম।

শাহাবুদ্দিন শুভ ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে “বাঘ” বলা বন্ধ করুন!!

লিখেছেন অন্তর্জাল পরিব্রাজক, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:২১



দয়া করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে “বাঘ” বলা বন্ধ করুন!! X( এরা ছাগলের দলই ছিল, তাই আছে, তাই থাকবে :-B !! এরা যেমন ধারার খেলা খেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তোমার বকুল ফুল

লিখেছেন নীল মনি, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৪

বকুল ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরে থাকে আমার এই ঘর। আমি মাটির ঘরে থাকি। এই ঘরের পেছন দিকটায় মা'য়ের হাতে লাগানো বকুল ফুলের গাছ৷ কী অদ্ভুত স্নিগ্ধতা এই ফুলকে ঘিরে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেট্রোরেল পেয়েছি অথচ হলি আর্টিজানে নিহত জাপানিজদের ভুলে গেছি

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৫ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:১১

জাপানে লেখাপড়া করেছেন এমন একজনের কাছে গল্পটা শোনা৷ তিনি জাপানে মাস্টার্স করেছিলেন৷ এ কারণে তার অনেক জাপানিজ বন্ধু-বান্ধব জুটে যায়৷ জাপান থেকে চলে আসার পরেও জাপানি বন্ধুদের সাথে তার যোগাযোগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×