somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্যান্সার।

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দৃশ্য: ০১

হাসপাতালের কেবিনের বারান্দায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে মেহেদী বুঝতেই পারেনি সে।গত দুই মাস সিঙ্গাপুরের একটা হাসপাতালে ভর্তি আছে তার মা তনু।ক্যানসার ধরা পড়ার পরপরি তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে বিন্দুমাত্র সময় অপচয় না করেই।তার যে বাবা ব্যবসায়ের ব্যাস্ততার কারনে সংসারেই ঠিকমত সময় দিতে পারে না তিনি সব কাজ ফেলে এখানে আছেন দুমাস যাবৎ।সংসারের কর্তীই যদি না থাকেন তবে সংসার দিয়ে কি হবে?? মা বাবার একমাত্র ছেলে মেহেদী মেডিকেল ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্ট।

হঠাৎ যেন চেতনা ফিরে এল মেহেদির।নার্স ইনজেকশন পুশ করে চলে গেল।তনুর ক্যান্সারটা অস্বাভাবিক গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে।অপারেশন হয়েছে।এখন চলছে কেমোথেরাপি।এই থেরাপির বিষে সব চুল পড়ে গেছে তনুর।তার মার মিষ্টি মুখখানা যেন ফ্যাকাশে হচ্ছে দিনদিন।স্বাস্হ্যবান মায়ের স্বাস্হ্যটাও ভেঙে যাচ্ছে নদীর ভাঙনের মত।মেডিকেল স্টুডেন্ট হিসেবে সে জানে ক্যান্সার কতটা ভয়াবহ।কিন্তু মায়ের ব্যাপারে মনে সায় দেয় না সে।

দৃশ্য ০২:

এখন দারুন ব্যাস্ত সোহাগ।ক্যান্সারের উপর গবেষনা করছে অস্ট্রেলিয়ার একটা মেডিকেলে।চট্রগ্রাম মেডিকেলে পড়ত সে।কয়েকবছর প্র্যাকটিসও করেছে মফস্বলের একটি হাসপাতালে।ভীষন ব্যাস্ত ছিল তখন।এখন আরও ব্যাস্ত।ব্যাস্ততা যেন জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে তার জীবনে।এত ব্যাস্ততা যে বিয়েটাও করা হলো না তার।ভীষন গোঁয়াড় ছিল একটা সময় সে।বলত কোথাও যাব না দেশ ছেড়ে।আজ সেই সোহাগ বিদেশে পড়ে আছে বিশ বছরেরও উপর।অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর কয়েকটা মেয়ের সাথে ভাব জমলেও টেকেনি বেশিদিন।গবেষনায় তার উন্নতি তাকে আরও কেরিয়ারিষ্টিক করে তোলে।তার জনপ্রিয়তা আর নাম আজ দেশে বিদেশে।দেশের পত্রিকাগুলোতেও তাকে নিয়ে ফিচার হয় প্রতি মাসে।সে এই জনপ্রিয়তা উপভোগ করে বেশ।একসময় তাকে একজন ফিরিয়ে দিয়েছিল বাঙালী ডাক্তার বলে।সেই লোকটাকে এখনও ভুলতে পারে না সোহাগ।লোকটা এতদিন বেঁচে আছে কিনা কে জানে??? বাঁচলে তাকে নিয়ে লেখাগুলো পড়ে তো???

দৃশ্য ৩:

নিজাম সাহেব বিরস মুখে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল।মেহেদির মুখোমুখি দাড়িয়ে কি কথা বলতে গিয়েও কেন জানি বললেন না তিনি।মেহেদি দেখল তার বাবা চোখ মুছছেন আড়ালে।ডাক্তাররা খুব আশাবাদী না তনুর ব্যাপারে।তাকে হয়তো বাঁচানো যাবে না।অথচ এতটুকু দেরী না করেই ছেলেকে নিয়ে বিশ্বের সেরা একটা হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয়েছে তার।কি লাভ হলো জীবনে এত টাকা রোজগার করে??? বাবার মুখের দিকে তাকাতেই পারছিলো না মেহেদি।বাবার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে কিছুক্ষন ভাবল সে।সে সময়টা বড় কষ্টময়…বড় বিষাদময়।

দৃশ্য: ০৪

সকালে ফোনের বিদঘুটে আওয়াজে ঘুম ভাঙল সোহাগের।তার প্রফেসর তাকে দেখা করতে বলেছে।কি এমন হলো যে এত সকালে স্মিথ তাকে ডেকে পাঠালো?? আলস্য শরীরে নিয়ে হাতমুখ ধুয়ে জ্যাকেটটা গায়ে চড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।আজ শীতটা কিছু কম।গাড়িটা ১২০ এ তুলে আধঘন্টায় পৌছে গেল সে মেডিকেলে।স্মিথ আজ এই শীতেও এসেছে থ্রি কোয়াটার পড়ে।লোকটা বোধ হয় আর শুধরোবে না।

দৃশ্য:০৫

আজ সকালেই কোমায় চলে গেল তনু।এখন আর তাকে মুখে তুলে খাওয়াতে হবে না।মেহেদি ডাক্তারি পড়ে।সে জানে এই অবস্হা থেকে ফিরে আসে কেবল অতি ভাগ্যবানরাই।বাবা প্রায়ই বলত …জানিস তোর মা আমার জন্য ভীষন লাকি রে।নইলে আমি একের পর এক ইন্ড্রাস্ট্রি বানাতে পারি??? তার নানা ভীষন বদমেজাজী ছিল।খুব বোকাঝোকা করত সবাইকে কিন্তু তার বড় মেয়ে তনু ছিল তার চোখের মনি।খালারা ভীষন হিংসা করত মাকে।নানুও বলতো…তোর মা টা ভীষন ভাগ্যবতী।যেখানেই এসেছে…আলো করেছে সব।

তাই তার বাবাও শেষ চেষ্টাটা করতে চান।যদি ভাগ্যবলে ফিরে আসে তনু আবার এই সংসারে।আগের মত হাটতে চলতে না পারুক তবু সে থাকুক বিশাল বাড়ীটার একটা কোনে।সারাজীবন নিজাম সাহেব অর্থের পেছনেই ছুটেছেন।এতটুকুও সময় দেয়া হয়নি।শেষ জীবনটাতে সব পুষিয়ে দিতে চান তিনি।

দৃশ্য:৬

সিঙ্গাপুর এয়াপোর্টে নেমেই মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে রওনা দিল সোহাগ।এত কাজের মাঝে স্মিথের অনুরোধে তাকে আট ঘন্টার নোটিশে চলে আসতে হলো ।হাসপাতাল থেকে তাকে রিসিভ করতে গাড়ি পাঠানো হয়েছে।স্মিথের কাছ থেকে মেইলে পাওয়া রিপোর্টগুলো দেখে সহজেই বোঝা যায় এই রোগী বাঁচবে না।কিন্তু সে এসেছে এই রোগীকে চাক্ষুষ দেখতে যেটা তার গবেষনা কাজে তাকে সাহায্য করবে অনেক।

দৃশ্য:৭

সোহাগকে দেখে ভীষন অবাক হলো মেহেদি।এই লোকটার লেখা পড়েই পরীক্ষায় বসে হাজার হাজার মেডিকেল স্টুডেন্ট।দেশ-বিদেশের পত্রিকায় তাকে নিয়ে ফিচার হয় প্রতিনিয়ত।গত সপ্তাহেও বের হয়েছিল একটি।অথচ এই বিশাল ক্যানসার স্পেশালিস্ট ভীষন ছটফটে।এসেই কথা বলছেন সব ডাক্তার আর তার বাবার সাথে।মেহেদি বুঝতে পারলো তার মার ট্রিটমেনট করার জন্য তার বাবা উড়িয়ে এনেছে এই ক্যানসার স্পেশালিস্টকে।আশাবাদি হতে বড় ইচ্ছে হল মেহেদির।

দৃশ্য ০৮

সোহাগ হাত মেলালো মেহেদির সাথে।তারপরই একগাদা টেনশন আর রিপোরর্ট নিয়ে কেবিনে ঢুকে গেল সে।সঙ্গে কেবল দুইজন ডাক্তার আর একজন নার্সকে ঢোকার অনুমততি দেয়া হল।

রোগীকে দেখেই থমকে গেল সোহাগ।অতি ব্যস্ততা আর স্বভাবজাত অস্হিরতার কারনে রোগীর নামটাই পড়া হয়নি তার।পড়েই যেন আবার আঁতকে উঠল সে।এ যে সেই তনু।যাকে একসময় ভালবেসে ফেরারি হতে চেয়েছিল সোহাগ।আজ এতটা বছর পর এই কংকালসার তনুকে না দেখলেই কি হতো না??

একদিন তনুর বাবা তাকে ডিসপেনসারির স্বস্তা ডাক্তার বলে অপমান করেছিল।সেই অপমান গায়ে মেখে জেদ নিয়ে আজ সে এত বড় হয়েছে।আজ তার সবচে প্রিয় ভালবাসার মানুষটি সেই রোগে আক্রান্ত যে রোগে তার মত বড় স্পেশালিস্ট পৃথিবীতে অনেক কম।

তন্ন তন্ন করে রিপোর্টগুলো আবার দেখল সে।ঔষধ পাল্টে দিতে বলল নার্সকে।সারাটা রাত মেহেদির সাথে জেগে ছিল সোহাগ।প্র্রবল পরিশ্রমে ঘুমে ঢলে পড়ল মেহেদি।জেগে রইল কেবল সোহাগ।

একটু ছুঁয়ে দেখল তার তনুকে।যে তনু অনেক কথা বলত রাত জেগে…সেই তনু এত গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে যে এই ঘুম ভাঙছে না কিছুতেই।এতটা বছর পর দেখা দুজনার…একবারের জন্যও কি কথা বলবে না তনু??? সে চুপিসারে ডাকল তনু…শুনছ…আমি সোহাগ।চিনতে পারছো আমাকে??? সাড়া দেয় না বিছানায় মিশে যাওয়া তনুর শরীর।

সোহাগ জানে সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারবে না তনুকে।তনুর মৃত্যুকে দেখতে চায়না সে।রুম থেকে বেরিয়ে যাবার আগে আরেকবার তনুর মুখে আঙুল ছোঁয়লো সে।

সোহাগ সিধান্ত নিল আর কোনদিন ক্যানসার নিয়ে গবেষনা করবে না সে।কোনদিন আর আর্টিকেল লিখবে না সে।কোনদিনও না।এত পড়াশুনা,গবেষনা আর পরিশ্রম দিয়ে সে তার ভালোবাসার মানুষষটাকেই বাঁচাতে পারলো না।


তনুর বাবার কথাই ঠিক হলো।সে আসলেই এক অলিগলির ডাক্তার।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জলদস্যুরা কি ফেরেশতা যে ফিরে এসে তাদের এত গুণগান গাওয়া হচ্ছে?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭


জলদস্যুরা নামাজি, তাই তারা মুক্তিপণের টাকা ফেরত দিয়েছে? শিরোনাম দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু আসল খবর যে সেটা না, তা ভেতরেই লেখা আছে; যার লিংক নিচে দেওয়া হলো।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×