‘‘তোমাদিগদের কেহ যদি আমার কথা না মানো - তবে কিছুই হইবে না।
আর যদি মানো তবেও কিছুই হইবে না - ’’
ভাস্কো দা গামা বুক টান সেপাই এর তো সিনা টান করে দাড়িয়ে আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে চিৎকার করে উঠলো।
ডান্ডাগুলির খেলার মাঠে সেদিন আমাদের বড়োই ঝামেলায় পড়ে গেলাম। ভাস্কো দা গামা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ফেরত সৈনিক। বার্মা লাইনে সে বৃটিশ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছিল।
তার কাজ ছিল সৈন্যবাহিনীর গাইড হিসেবে - বুকে চাপর মারতে মারতে ..
সেই দিনগুলোর কথা ও যখন বলতো তার বুকের জৌলুশ চকমক করে উঠতো। উজ্জ্বল চকমকি সব শব্দে চারদিক সোনালি হয়ে উঠতো। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম আর ভাবতাম-
ঐ লোকটা বৃটিশদের পথ দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে যেত -
ওর কথায় হো হো অট্টহাসি দশদিক কাপিয়ে তুলতো - “হা রে ছওয়াল - তোরা কি দেখিছিস - সেই সাহেবদের - আমি মাঝে মাঝে রগর করতাম - সামনে বোধহয় সাপ আছে- ভালুক আছে - বাঘ আছে, সাহেবরা শিকারী জাত আছে কিন্তু ওরাও এ মাটিকে ভয় করতো - ওদের ঐ ভয়পাওয়া মুখ তোরা কি দেখেছিস-”
সত্যিইতো ভয়পাওয়া সাহেব আমি দেখিনি। আমার সবগুলো সাহেবের মুখ হাসিতে ভরা। গম্ভীর একটা সাহেবের বুড়োমুখও মনে পড়ে - কিন্তু ভাস্কো দা গামার ভয় তাড়া খাওয়া কোন সাদা লালচে মুক আমার চোখে পড়েনি। আমি দুলালকে জিজ্ঞাস করেছি-
'দেখেছিস কখনো? ”
না দুলালও দেখেনি। এমনি রফিক লাভলু - শাকিল বাবুল কেউ কখনোই দেখেনি একটাও ভয় পাওয়া সাহেবের মুখ। আমাদের কাছে ভাস্কো দা গামার কথা বই পড়া স্বাধীনতার গল্পের মতো মনে হয়। ভাস্কো দা গামা চলে গেলে রবি ফিসফিসিয়ে বললো -“ ব্যাটা একটা আস্ত চাপাবাজ - আগাগোড়া মিথ্যে বলে।”
কিন্তু পাড়ার বুড়ো ইলিয়াস কাকু দোকানে চা বানাতে বানাতে লাকড়ির আগুনটা আর একটু নেড়েচেড়ে ঝলকিয়ে দিতে দিতে বলেন - “ভাস্কো দ্য গামার নামটা দিয়েছিলেন লেফটেণ্যান্ট পিলিফ সাহেব। ভাস্কো দ্য গামার পথ ধরে ব্রিটিশরা এদেশে এসেছিল আর আমাকো সুখেন ওগো আসামে বনজঙ্গলের মধ্যে পথ চিনাইতো। ওর কথামতো ব্রিটিশরা আগাইতো পিছাইতো - এই কারনেই পিলিপ সাহেব এরে কইতো আওয়ার ভাস্কো দ্য গামা.।”
গনগনে কয়লা আর চায়ের কেৎলির মুখ দিয়ে গলগল ধোয়ার মধ্যে ইলিয়াস কাকুর মুখটা আরো লালচে দেখায় - আমাদের মনে হয় ইলিয়াস কাকু নয় - যেন লেফটেণ্যান্ট পিলিফ ভাস্কো দ্য গামার বিষয়ে আমাদের অবিশ্বাস দেখে নিজেই চলে এসেছেন -
আমরা ভয়ে চমকে চলে আসি।
আমাদের ভাস্কো দ্য গামা সম্পর্কে আমরা যে বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস করিনি- বরঞ্চ আমরা তার সম্পর্কে ঠিক ঠিক এই রকম কিছুই একটা ভেবেছিলাম- সে কথা আমরা ফিসফিস করে বলে উঠতেই দেখি- ভাস্কো দ্য গামা সোজা আমাদের ডান্ডাগুলির খেলার মাঠ দিয়ে চলে যাচ্ছেন। একবারও আমাদের দিকে না তাকিয়ে।
আমরা তখন লজ্জায় নয় ভয়ে মরে যাচ্ছিলাম। কেন না ভাস্কো দ্য গামা আর আমাদের কাছে একটা লোকমাত্র নয়। ঐ মুখটার ভেতরে যেন লুকিয়ে আছে হারিয়ে যাওয়া কাল। আমাদের উপর এক্ষুনি ঝাপিয়ে পড়ে নিয়ে যাবে সেই আসামের অরণ্যের অন্ধকারে। যুদ্ধের দিনগুলিতে-
আমরা ভয় পেয়ে এক অন্যের দিকে তাকাই কিন্তু কেউই কাউকে খুজে পাই না - আমাদের প্রত্যেকের মুখে আমরা দেখি ভয় পাওয়া সাহেবদের মুখ - আমরা সভয়ে চিৎকার করে দৌড়ে পালাই।
পেছনে নিয়তির মতো পড়ে থাকে ভাস্কো দ্য গামার উচ্চারিত কথাগুলো -
ভাস্কো দ্য গামা আসলে কি বলতে চেয়েছিল -
মানো আর নাই মানো - কিছুই হইবে না
আমরা যেন সেই কথার মানে আজো হাঁতড়ে বেড়াই-
আপনারা কেউ কি জানেন -
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ৭:৩১