somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'সীমানা পেরিয়ে' আসে জীবনের জোয়ার

১৮ ই নভেম্বর, ২০০৬ ভোর ৪:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছবির গল্প:
ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের পর দুই মানব-মানবী নিজেদের জীবন্ত আবিষ্কার করে এক নির্জন দ্বীপে। এরা আগে থেকেই পরিচিত। পরিচয়ের পালা ছিল খণ্ডকালীন। দীর্ঘদীন পর মায়ের সঙ্গে দাদার বাড়ি বেড়াতে আসা শোষক জমিদারের নাতনীকে চিনতে পেরে হতদরিদ্র ছেলেটার চোখে জ্বলে উঠেছিল প্রতিশোধের ক্রোধ, মনে পড়েছিল খাজনা না দেওয়ার অপরাধে তার পূর্বসূরিকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছিল মেয়েটার পূর্বসূরি। নির্জন দ্বীপে একা পেয়ে প্রতিশোধের ধরণটা কেমন হবে, কতোটা নির্মম ও নোংরা_ তা নিয়ে দুর্ভাবনা ও ভয় কাজ করে বিদেশে উচ্চশিতি মেয়েটার ভেতর। নিজের খামখেয়ালিপনায় নৌকা ভেসে গেলে স্রোতে, বাঁচতে হলে ছেলেটার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হবে_ টের পেয়ে উচ্চবংশীয় মেয়েটা নিজের আচরণ খানিক সংযত করে এবং এই দ্বীপ থেকে উদ্ধার পাবার চেষ্টা করার পাশাপাশি যতোদিন আটকে আছে ততোদিন যেন ভালোভাবে কাটানো যায়_ সেই পরিকল্পনা শুরু করে। কিন্তু এরকম পরিবেশে একেবারে অনভ্যস্ততার কারণে আর বংশীয় ধারায় গরিবদের প্রতি অবিশ্বাস পোষণের ফলে কখনো মিথ্যে ভয় দেখিয়ে, কখনো বা গল্পের ছলে ছেলেটার উপর আদেশ জারির মতা একমুহূর্তের জন্যও হাতছাড়া করে না মেয়েটা।
এসব ভাবনা নেই ছেলেটার। সহকারীার মৃতদেহ কবর দিয়ে, নির্লিপ্ত ঢঙে ভাবতে থাকে ফিরে যাওয়ার উপায়। সে জানে, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে আর যাই হোক, সঙ্গী শত্রু হলেও তার অনিষ্ট করতে নেই, প্রতিশোধ তো পরের ব্যাপার। ভালোভাবে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে শিতি মেয়েটার নির্দেশনা মেনে নিতে গিয়ে দিনরাত অবিরাম খাটে সে। গড়ে তোলে চমৎকার ঘর। এরই মধ্যে মেয়েটার প্রাকৃতিক আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারে না। জীবনকে আবিষ্কার করে নতুনভাবে। তারা প্রচলিত মানবসমাজের বাইরে, এই নির্জনদ্বীপে অনন্তকাল থেকে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ছুড়ে ফেলে দিয়ে উদ্ধার-সহযোগিতার নিশানা, নরোম মাটির উদরে বপন করে ফসলের বীজ। কেননা, প্রচলিত মানব-সমাজের যে জাত-বিভেদ ও মানুষের অবস্থান নিয়ে ভাগ-বাটোয়ারা, সে সমাজ তাদের এ সম্পর্ক মেনে নেবে না; মেনে নিলে সমাজের বাহাদুরি থাকবে না, সব মানুষকে তো আর এককাতারে রাখতে চায় না পুঁজিবাদী সমাজ।
না চাইলেও একসময় কোনো এক জাহাজের ক্যাপ্টেনের বাইনোকুলারে ধরা পড়ে তারা। তাদের উদ্ধারের নামে নামিয়ে দিয়ে আসে পুঁজিবাদী সমাজের রাুসে বিবাদে। ওরা, সেই সমাজকে তোয়াক্কা না করে, সেই সমাজের সীমানা পেরিয়ে উঠে পড়ে নৌকায়, যে নৌকা তাদের পেঁৗছে দেবে বিভেদহীন স্মৃতিময় দ্বীপে।

নির্মাণশৈলী:
জলোচ্ছ্বাসের দৃশ্যে 70-এর প্রলয়ঙ্কারী জলোচ্ছ্বাসের ডকুমেন্টারি এতো সাবলিলভাবে ঢুকে পড়েছে সিনেমায়, মনে হবে গল্পের খাতিরে একে নির্মাণ করা হয়েছে। বিত্তময় প্রাসাদের বিছানা কিংবা দ্বীপের উদোম বালুতে ঘুমে মেয়েটা হাসপাতাল ছাড়িয়ে ছুটে বেরিয়ে যাওয়ার যে দুঃস্বপ্ন দেখেছে বারেবার, তাতে তার প্রচলিত সমাজের একঘেয়ে নিয়ম থেকে অনন্ত মুক্তির পথে ছুটে যাওয়ার আত্মিক ইচ্ছা অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তোলেছেন নির্মাতা। 'বিমূর্ত এই রাত্রি আমার' গানে মেয়েটার [জয়শ্রী] চোখে-মুখে ও এঙ্্রপ্রেশনে আদিম কামবোধ ও আনন্দময় নতুন জীবনের ঝিলিক খেলা করেছে সমান তালে। আর, অদ্ভুত সুন্দরী ও উচ্চশিতিার একদম কাছাকাছি এতোটা দিন থেকেও, মেয়েটার এতো আন্তরিক চেষ্টার পরও ছেলেটা, মানে বুলবুল নিন্মবিত্তীয় আনস্মার্ট শারীরিক ভাষার প্রভাব কাটাতে পারেনি। এমনি করে ছবির শুরুর দিকে যেসব প্রশ্ন দর্শকের ভেতরে খোঁচা দেবে সিনেমা বানানোর খাতিরে পরিচালক বাস্তবতাকে পাশ কাটাচ্ছেন কিনা_ এ প্রশ্নে, ছবির শেষে পেঁৗছুতে পেঁৗছুতে বোধ করি তার সব উত্তর পেয়ে যাবেন তারা। এখানেও নির্মাতা হিসেবে আলমগীর কবিরের বিশালতা টের পাওয়া যায়।

আদিকথা:
'সীমানা পেরিয়ে' সম্পর্কে প্রয়াত আলমগীর কবিরের ভাবনা ছিল এরকম_ '1970-এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংসলীলার প্রায় তিন মাস পর একজোড়া মানব-মানবীকে বরিশালের দেিণর একটি সামুদ্রিক চরে আদিম পরিস্থিতিতে কোনোরকমে বেঁচে থাকতে দেখা দিয়েছিল। ঢাকার তৎকালীন সংবাদপত্রে ঘটনাটির বিবরণ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে ছবির ট্রিটম্যান্ট ইচ্ছাকৃতভাবে কন্ট্রিভড। যৌন আকর্ষণ বা ভায়োলেন্স ছাড়াও সমাজের ওপর এবং নিচতলার দুটি মানুষের মধ্যে, শ্রেণীগত পর্যায়ে নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো আন্তরিক সম্পর্ক সম্ভব কিনা এটা পর্যালোচনা করাই এই কার্যত ফ্যান্টাসি চলচ্চিত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল। আমার মতে এই সম্পর্ক সম্ভব, তবে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী শ্রেণীটি তা সহ্য করতে চাইবে না। ...ব্যবসায়ী পুঁজির চাপে ছবিটির বক্তব্য এবং গতি কিঞ্চিৎ ছিন্নভিন্ন।'

তথ্যব্যাঙ্ক :
দৈর্ঘ্য : 118 মিনিট (প্রায়)
মুক্তির সময় : 1977
গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ, প্রযোজনা ও পরিচালনা : আলমগীর কবির
সুর : ভূপেন হাজারিকা
কথা : ভূপেন হাজারিকা ও সংগৃহিত
যন্ত্রসঙ্গীত : আলাউদ্দীন লিটল অরকেষ্ট্রা
কণ্ঠশিল্পী : ভূপেন হাজারিকা ও আবিদা সুলতানা
চিত্রগ্রহণ পরিচালনা : এম.এ. মবিন
প্রধান সম্পাদক : বশীর হোসেন
প্রধান শব্দগ্রাহক : মালিক মনসুর
পরিবেশনা : আলমগীর পিকচার্স লিঃ
অভিনয় : জয়শ্রী কবির, বুলবুল আহমেদ, কাফি খান, মায়া হাজারিকা, গোলাম মোস্তফা, তনুজা প্রমুখ।
সম্মাননা : 'জাতীয় পুরষ্কার 1978'-এ শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার, শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা, শেষ্ঠ সম্পাদনা ও শ্রেষ্ঠ অভিনেতা_ এই চারটি ক্যাটাগরিতে বিজয়।
লেজার ভিশনের ব্যানারে সিনেমাটির ডিভিডি ও ভিসিডি সংস্করণ বাজারে এসেছে। পাওয়া যাচ্ছে ইস্টার্ণ প্লাজা, রাইফেল স্কোয়ার, বসুন্ধরা সুপার মার্কেট ও বিভিন্ন সিডি-ভিসিডির দোকানে।

[রুদ্র আরিফ, শাহবাগ, ঢাকা : নভেম্বর 2006]
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×