somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিরপেক্ষতার কশাঘাতে বিপ্লব ও সংহতি দিবস

১৫ ই নভেম্বর, ২০০৬ ভোর ৬:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

--------------------------------
আমাদের কিছু ব্লগবন্ধুদের জন্য [ইটালিক]যায়যায়দিন[/ইটালিক]-এর 11 নভেম্বর, 2006 তারিখের উপসম্পাদকীয়টি নিবেদন করলাম। পাশাপাশি আমার নিজের এবং সকল জাতীয়তাদীদের জন্যও। কারণ ... "তাদের" বক্তব্যের সমুচতি জবাব যুক্তি দিয়ে, আবেগের বশবর্তী না হয়েও যে আরো সুঁচালোভাবে দেয়া যায় - এর উদাহরণ খুবই কম।
--------------------------------

সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ইতিহাসের অনেক পাতা বদলে যায়। দলীয় সরকার নির্বিঘ্নে নিজেদের বিশ্বাস অনুযায়ী বিভিন্ন দিবস পালন করে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য এই দিবসগুলো বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তেমন একটি দিন ছিল 7 নভেম্বর। এই দিনে নিরপেক্ষতা দেখানো সত্যিই কষ্টকর হয়ে পড়ে।

প্রতি বছর এই দিবসের প্রাক্কালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে যিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত করতেন এবার সেই একই প্রেসিডেন্ট ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ জিয়ারত করা থেকে বিরত থাকলেন। এবং থাকলেন সঙ্গত কারণে। পূর্বসূরির যে অপরাধ বা ভুলের কারণে তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন শেষ পর্যন্ত সে একই ধরনের কাজ তাকেও করতে হলো। নিজের লালিত দর্শনের বিপরীত কাজ করে পূর্বসূরির নেয়া বিতর্কিত পদক্ষেপকে তিনি সঠিক বলে রায় দিয়েছেন এবং পূর্বসূরির পদত্যাগ ও নিজের এই পদে আরোহণ অনৈতিক হিসেবে নিজেই প্রমাণ করে ছেড়েছেন।

ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের জন্য এটা অপরাধ না হলে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর জন্য কেন তা অপরাধ হয়েছিল সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। বিরোধী পক্ষের চাপ সামলাতে ব্যতিব্যস্ত তার উপদেষ্টারা এক্ষেত্রে তাকে সঠিক উপদেশ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। চাপে পড়ে এবার মাজার জিয়ারত করা থেকে বিরত থেকে তিনি প্রমাণ করেছেন, আগের জিয়ারতগুলোও তাকে অন্য ধরনের চাপ থেকেই করতে হয়েছিল।

এখনো সরকারিভাবে 7 নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস। দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি জনগণ দিনটিকে এভাবেই গণ্য করে। গণভোট হলে এটাই টিকে যাবে। তাছাড়া অন্য কোনো আদেশ বলে তা রহিত করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অংশ হিসেবেই প্রেসিডেন্ট ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তা করতে পারতেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিরোধীদের মুখ বন্ধ করতে তার একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও দিতে পারতেন। আওয়ামী লীগ তো তার প্রতিটি কাজেই প্রশ্ন তুলছে। না হয় আরো একটি প্রশ্ন বেশি তুলতো।

নিজের নিরপেক্ষতা নিয়ে এমনিতেই যিনি বিড়ম্বনায় পড়েছেন, জানি তাকে এ জাতীয় প্রশ্ন আরো বিব্রত করে তুলবে। দেশ যখন এর চেয়েও বড় সমস্যা নিয়ে টালমাটাল তখন এটা নিয়ে নাড়াচাড়া করলে অনেকে আমার আক্কেল নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু প্রবাসী এই মনটা কেন যেন তা মানতে চায় না।

7 নভেম্বর ও অন্যান্য সুস্পষ্ট জাতীয়তাবাদী দর্শন নিয়ে খোদ জাতীয়তাবাদী শিবিরে কেন এই দোদুল্যমানতা কিংবা হীনমন্যতা? এই হীনমন্যতা জাতীয়তাবাদী পক্ষের দুই দিকপাল বলে পরিচিত ছিলেন ও তার বলেই সবের্াচ পদে উন্নীত হয়েছেন পর পর এমন দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যেই দেখা যায়নি, এর প্রভাব রয়েছে আরো বড় জায়গা জুড়ে। স্বাভাবিক কিংবা আরামদায়ক চাপ ও তাপমাত্রায় জাতীয়তাবাদী শিবির কিলবিল করে। কিন্তু এই চাপ ও তাপমাত্রা সামান্য বাড়লেই জাতীয়তাবাদী উইকেট টপাটপ পড়তে থাকে। পরিবেশ সামান্য প্রতিকূল দেখলেই জাতীয়তাবাদের টুপি খুলে ফেলতে হয়। নিরপেক্ষ পরিবেশগুলোতে জাতীয়তাবাদের সব দাগ মুছে প্রবেশ করতে হয়।

অথচ প্রতিপক্ষ এসব ক্ষেত্রে খুব গর্ব ও আত্মবিশ্বাস নিয়েই নিজ দর্শন বজায় রাখে। কিংবা অত্যন্ত সফলভাবে তার দর্শনের একটা নিরপেক্ষ রূপ দিয়ে ফেলে। যে সিড়ি বলে ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ অনেকটা বিদ্যুততিতে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন সেসব জাতীয়তাবাদী বলয়ের বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব ছিল এই হীনমন্যতা দূর করা। এসব অঙ্গীকার নিয়েই তো তারা তাদের আগের পদগুলোর শোভা বর্ধন করেছিলেন। সুতরাং সহজেই বলা যায়, তারা তাদের আগের কাজগুলো সঠিকভাবে করেননি বা করতে পারেননি। তাই অত্যন্ত করুণ এই নৈতিক পরাজয় বরণ করতে হয়েছে- পরিস্থিতির দোহাই তারা যতোই দিন না কেন। করতে হয়েছে বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী শিবিরের বরেণ্য দিকপাল এক প্রফেসরকে!

7 নভেম্বরকে ঘিরে বিপরীতমুখী দুটি দর্শনের একটির রাজনৈতিক রূপ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও অন্যটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে এটা কোনো সমস্যা নয়। কারণ দু'টি পরিচয়ই আমাদের জন্য সঠিক। ভাষাগত পরিচয়ে আমরা বাঙালি আর ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ে আমরা বাংলাদেশি। তবুও কেন একটা গ্রুপ 'বাংলাদেশি' শব্দটা সহ্য করতে পারেন না? বাংলাদেশি নামক স্বতন্ত্র পরিচয়কে তারা পাকিস্তানের আদলে বাংলাস্তানি বলে উপহাস করেন। পাকিস্তানের প্রতি যে ঘৃণা তা বাংলাস্তানের লাইন বরাবর বাংলাদেশি ভাবধারায় ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। তখন 'বাঙালি'দের দাপটে বাংলাদেশিরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন।

দুভর্াগ্যক্রমে কিংবা সৌভাগ্যক্রমে তুলনামূলক ভোকাল অংশটি প্রথমোক্ত দলে পড়েছে। যাদের মুখ বেশি চলে তাদের কাজ একটু কম করলেও হয়। 1971 সালের স্বাধীনতা যুদ্ধেও এই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। যারা কলকাতায় শরণাথর্ী শিবিরে বা অন্য কোনো থিওরির ক্লাসে বসে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন কিংবা আদৌ করেননি তাদের দাপটে ফিল্ডের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন দেশে এসেও কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। তাই এই লাইন বরাবর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও বিভক্তি সৃষ্টি হয়ে যায়।

মুক্ত চিন্তার সর্বাধিক দাবিদার ভোকাল এই মহলটির চিন্তা কতোটুকু মুক্ত তাও গবেষণার বিষয়। এদের বক্তব্যে আবেগ ছাড়া যুক্তি খুজে পাওয়া কঠিন। কারণ 'এপার বাংলা ওপার বাংলা' নামক এক ধরনের নস্টালজিয়ায় এরা আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। আর এই আচ্ছন্নতার পরিমাণ দুভর্াগ্যজনকভাবে 'এ পারেই' বেশি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু দুই পারের অধিকাংশ জনগণের রাজনৈতিক চেতনা তাদের এই আবেগের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে বরাবর অবস্থান নিয়েছে।

ধর্ম যেমন একটা রাষ্ট্র গঠনের উপাদান হয় না তেমনি ভাষাও অনেক সময় একক রাষ্ট্র গঠনের উপাদান হয় না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির অভ্যুদয়ে এ দুটি ধারণাই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। 1947 সালে ভাষার ব্যাপারটি যেমন ফয়সালা হয়েছে তেমনি 1971 সালে ধর্মের ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়েছে। 1905 সালের বঙ্গভঙ্গ অন্দোলন থেকে এই বিপরীতমুখী চেতনা লক্ষ্য করা যায়। 1905 সালের বাংলা মায়ের অঙ্গচ্ছেদে যারা বিলাপ করেছিলেন তারাই 1947-এ এসে সেই বাংলা মায়ের অঙ্গচ্ছেদে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন।

ঐতিহাসিক ওই মায়াকান্না ও অঙ্গচ্ছেদ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে গোষ্ঠীগত একটি বিশেষ স্বার্থকে কেন্দ্র করে। এদের মধ্যে এমন বাঙালিরও পদচারণা লক্ষ্য করা গেছে যাদের নাম উচারণ করলেও আজ অনেকেই কষ্ট পান। বাংলা মায়ের চেয়ে ভারত মাতা ও পাকিস্তান মাতার কোলে আশ্রয় নেয়াতেই তখন সব 'বাঙালি' ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ভাষা মা ভুলে তখন সকলেই নিজ নিজ ধর্ম মাতার কোলে ঠাই নিয়েছিলেন। এটাই ইতিহাসের অপ্রিয় সত্য কথা। কাজেই কিছু বাঙালির মনে বৃহত্তর বাংলা গড়ার স্বপ্ন থাকলেও তা তেমন গুরুত্ব পায়নি।

1971-এ আমরা আমাদের এই ভুল আবেগ শুধরিয়ে নিলেও বিশেষ কারণে আমাদের 'ওপারের দাদারা' এখনও আরামদায়কভাবে তা ধরে আছেন। কোনোদিন তা ছাড়ার দুশ্চিন্তাও তাদের মনে উদয় হয় না। বরং সবাই ভারত মাতাতে বিলীন হওয়াতেই সমৃদ্ধি ও সুখের নতুন সোপান খুজে পেয়েছেন ও দিন দিন তা আরো পোক্ত হচ্ছে। তারা তাদের মতো সুখে আছেন, আমরা আমাদের মতো। একজন আরেক জনের সুখকে স্বীকৃতি দিয়েই আসল সুখ খুজতে হবে। কায়দা করে বা কৌশলে একজন আরেক জনকে নিজের সঙ্গে যোগ করানোতে সুখ নেই। এজন্যই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে আলাদা করে উভয়ের এ সুখের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং পারস্পরিক আহ্বানের কূটকৌশল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

সর্ব বাঙালি জাতীয়তাবাদে কেন জানি তারই একটা হাতছানি রয়েছে। 'এপার বাংলা ওপার বাংলার' আবেগ কিংবা এক জাতিতত্ত্বের মোড়কে এই আহ্বান একটা দিকেই ঢালু হয়ে আছে। ওই আবেগে সিক্ত হয়ে মাঝখানে এলে সেদিকেই হেলে পড়তে হবে, বৃহৎ ইনডিয়া মাতাতেই আমাদের লীন হতে হবে। অন্যদিকে 7 নভেম্বর সেদিকে হেলে পড়া থেকে আমাদের রক্ষা করেছে। আবার সঙ্গত কারণে বৃহত্তর স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখা অবান্তর। সুতরাং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশ ও ইনডিয়া নামক উভয় দেশের জন্যই মঙ্গলজনক।

কেউ কেউ মনে করেন সে কারণেই ইনডিয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে ভয়ের চোখে দেখেছে। মুজিব সরকারের পতনের সময় সবাইকে অবাক করে ইনডিয়া নীরব থেকেছে। কাজেই কারো মনে সায় দিক আর না দিক এই ধারাটি থেকে সুস্পষ্টভাবে একটা জায়গায় আমরা আলাদা হয়ে পড়েছি। আর সেটাই হলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। কারণ এই শব্দটির মধ্য দিয়ে আমাদের কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। এর মধ্যে শুধু রহিম করিম আবদুলরা নয়- যদু মধু পরিমলরাও আছে। তাই বাংলাদেশি জাতিসত্তাকে বাংলাস্তানি হিসেবে যারা উপহাস করেন তাদের করুণা করা ছাড়া উপায় থাকে না।

তাদের যুক্তি 1971 সালে বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে দ্বি-জাতিতত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এটুকু বলে ক্ষান্ত হলেও কিছুটা ঠিক ছিল। কিন্তু ঠিক তত্ত্বটি জানাতে গিয়ে তারা আরো বড় ভুল করে বসেন। দ্বি-জাতিতত্ত্ব অবাস্তব প্রমাণিত হওয়া মানেই এক জাতিতত্ত্বের সঠিকত্ব নির্দেশ করে না বা তার কাছে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বরং আরো একটা নতুন তত্ত্বের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। তা হলো ত্রি বা বহু জাতিতত্ত্ব। ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এক জাতিতত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করে দ্বি-জাতিতত্ত্বের উদ্ভব হয়েছিল। সময়ে এটাও ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণিত হয়ে আরো সঠিক ও সংশোধিত রূপ ত্রি-জাতিতত্ত্ব বা বহুজাতিতত্ত্বের বাস্তবতা উদ্ভাসিত হয়েছে।

পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের অভু্যদয় এবং ইনডিয়ায় আরো অন্যান্য জাতিসত্তার স্বাধিকারের সংগ্রাম সেই বাস্তবতার দিকেই ইঙ্গিত করে। বলা হয় বর্তমান অবয়বের ভারতবর্ষ বা ইনডিয়া বৃটিশরাজের এক সুন্দর উপহার ছাড়া কিছু নয়। কারণ সুদীর্ঘ ইতিহাসের কখনোই এই অবয়বের একত্রিত ভারতবর্ষ ছিল না। তারপরও এসব তত্ত্ব বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্নভাবে ধরা দিতে পারে। গভীর জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত একজন ইনডিয়ানের কাছে এক জাতিতত্ত্ব সঠিক মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তেমনি একজন পাকিস্তানির কাছে দ্বি-জাতিতত্ত্ব সঠিক বলে মনে হবে। একই ফমর্ুলায় একজন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশির পক্ষে ত্রি বা বহুজাতিতত্ত্ব সঠিক মনে হওয়া উচিত।

কিন্তু অস্বাভাবিক ঠেকে যখন একজন গভীর দেশপ্রেমে উজ্জীবিত বাংলাদেশির কাছে ত্রি-জাতিতত্ত্বের অস্তিত্ব ধরা পড়ে না, মন বাধা পড়ে থাকে এক জাতিতত্ত্বে, কারো কারো আবার দ্বি-জাতিতত্ত্বে। বলা যায়, এখানে ভুল শব্দটি আমরা ভুলভাবে ব্যবহার করে এসেছি। ভুল বা ঠিক শব্দ দুটিকে 'ক্ষতিকর' কিংবা লাভজনক দুটি শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করলে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হতে পারে। যেমন এক জাতিতত্ত্ব বর্তমান ইনডিয়ার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য যতোটুকু লাভজনক হয়েছে, পাকিস্তানিদের জন্য ততোটুকুই ক্ষতিকর হতো বলে প্রমাণিত হয়েছে।

সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ইনডিয়ায় সংখ্যালঘু মুসলমানদের শিক্ষা ও অন্যান্য সামাজিক অবস্থান শিডিউল ট্রাইব ও শিডিউল কাস্টদের চেয়েও নিচে অবস্থান করছে। আরো বিব্রতকর কিংবা মজার সংবাদ হলো, যেসব রাজ্যে উদার ও ধর্মকে অস্বীকারকারী দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছে সেখানে ধর্মভিত্তিক এই অবিচারের চিত্র আরো করুণ। পশ্চিমবঙ্গে এই অবস্থা অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে অনেক মারাত্মক। তারপরও যারা এক জাতিতত্ত্বের পক্ষে ওকালতি করেন তাদের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

একইভাবে দ্বি-জাতিতত্ত্ব পাকিস্তানিদের জন্য লাভজনক হলেও বাংলাদেশিদের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশিদের জন্য সর্বাধিক লাভজনক হয়েছে ত্রি-জাতি বা বহু জাতিতত্ত্ব। তবে এই দ্বি-জাতিতত্ত্ব ত্রি-জাতিতত্ত্বের উদ্ভবকে সম্ভব করেছে। সেদিন ইনডিয়া থেকে আলাদা করে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ না হলে একাত্তরের আমাদের কাঙ্খিত স্বাধীনতা কখনোই সম্ভব হতো না- একথা অতি সহজে বলে দেয়া যায়। পাকিস্তানের মানসিক ও সামরিক সহযোগিতা নিয়ে যে কাশ্মির গত 50 বছরেও স্বাধীন হতে পারছে না সেখানে আমাদের অবস্থা কি হতো তা সহজেই অনুমেয়।

তবুও হাজারো প্রশ্নের মতো এই প্রশ্নেরও জবাব নেই- আমরা কেন দ্বি-জাতিতত্ত্বের কথা স্মরণ হওয়া মাত্র অভিশাপ দিই। তারা অভিশাপ দেবে যাদের জন্য এই তত্ত্ব ক্ষতিকর হয়েছে, বৃহৎ ভারত মাতাকে ছিন্ন করায় যাদের মনে যুক্তিসঙ্গত বেদনা রয়েছে। হাত থেকে শিকার ছুটে গিয়ে নিজের দিকে তীর মারার সক্ষমতা অর্জন করার সুযোগ পেয়েছে। আমরা বাংলাদেশিরা তো একে অভিশাপ দিতে পারি না বরং ঐতিহাসিক বাস্তবতা উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে এর ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতার সমালোচনা করতে পারি মাত্র।

কাজেই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ পাকিস্তানি ভাবধারা থেকে এখানেই নিজের সুস্পষ্ট দূরত্ব সৃষ্টি করে রেখেছে। যদিও বিশেষ বেদনা থেকে উপরোক্ত মহলটি সেভাবেই ভাবতে ভালোবাসেন। এক থেকে যেমন তিন হতে পারে না তেমনি এক জাতিতত্ত্ব থেকে লাফ দিয়ে বাংলাদেশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ত্রি-জাতিতত্ত্বের উদ্ভব হতে পারতো না। ইতিহাসের এই বাস্তবতা থেকে আমরা চোখ ফিরিয়ে রাখতে পারবো না। একে স্বীকার করা মানে আগের ত্রুটিপূর্ণ তত্ত্বকে সমর্থন করা নয়।

বাঙালি জাতিসত্তা থেকে পৃথক বাংলাদেশি জাতিসত্তার সৃষ্টি এর হাত ধরেই হয়েছে। এটাই এদেশের মূলধারা। এদেশের গণমানুষের বোধ-বিশ্বাস-স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পক্ষের ধারা। বাকি সব ধারা রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক গোলামি বা দালালির মনোবৃত্তি থেকে উৎসারিত - তা যতোই শৈল্পিক বা সাংস্কৃতিক সুষমায় আচ্ছাদিত করে পরিবেশন করা হোক না কেন।

অথচ সঠিক এই ধারণা বা ভাবনাকে ঘিরে সুকৌশলে হীনমন্যতা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। বুক ফোলানোর মতো দর্শন নিয়ে মাথা নুইয়ে থাকতে হয়েছে। সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে প্রবাহিত এক ধরনের আধিপত্য বা আজব ধরনের সন্ত্রাস এই অবস্থার সৃষ্টি করে রেখেছিল। অবস্থা অনেক দিন পর্যন্ত এমন ছিল যে, এক জাতিতত্ত্বের সমালোচনা করার আরেক নাম দ্বি-জাতিতত্ত্বকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করা। বুশ যেমন বলতে চান তার বিরোধিতা মানেই লাদেনকে সমর্থন করা। তৃতীয় কোনো রাস্তা নেই।

এসব আজব সন্ত্রাসীর ভাবখানাও ছিল অনুরূপ। এক পযর্ায়ে এই চিন্তাধারাকে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে এমন করে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং সার্বিক পরিবেশ এমন করে রাখা হয়েছে যে, তাদের এই মতের বিরোধিতা করা মানেই দেশের স্বাধীনতার বিরোধী হয়ে যাওয়া। নিজের দেশ-বোধ-বিশ্বাসের ওপর আবেগ প্রকাশ করলে কিংবা এদের কোনো অবিচারের বিরুদ্ধে মুখ খুললে পেচিয়ে এটাকে তারা পাকিস্তানপ্রীতি বানিয়ে ফেলতো।

শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বলয়ে উপরোক্ত মহলটি এমন আধিপত্য বিস্তার করে ফেলে যে, এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা রীতিমতো বিপজ্জনক হয়ে দাড়ায়। কারো দেশপ্রেম মাপা ও দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট বিতরণের একচ্ছত্র মালিক বনে যায় তারা। এই ধারণার বাইরে যেসব বুদ্ধিজীবী অবস্থান নিতেন তাদের বুদ্ধি ও দেশপ্রেম আদৌ আছে কি না তাই নিয়ে সংশয় দেখা দিতো। দু-এক জন গো ধরে বসলে বুদ্ধিজীবীদের খাতা থেকেই তাদের নাম কেটে দেয়া হতো। সাধারণ শিক্ষিত মহলে এর একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে। এই লাইন বরাবর চিন্তা তখন এক ধরনের ফ্যাশন হয়ে দাড়ায়।

সবার মনে গুঞ্জরিত এ সঠিক কথাটি তাই অনেকদিন পর্যন্ত বুক ফুলিয়ে বলতে পারা যেতো না। কথাটি প্রথম বলার সাহস যুগিয়েছে গেছেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ইতিহাসের বাকগুলোতে যেখানেই আমরা দ্বিধানি্বত ছিলাম, সেখানেই তার দৃঢ়কণ্ঠ বেজে উঠেছে। যখন মনে হয়েছে এখানে এখন একজন মানুষের দাড়িয়ে পড়া দরকার, তখনই তাকে সেখানে দেখা গিয়েছে। তার সফলতা যাদের ব্যর্থতা তুলে ধরেছে তারা সঙ্গত কারণেই তার এই 'অপরাধ' ক্ষমা করতে পারেনি।

1975 সালের 7 নভেম্বর যে জিয়াউর রহমানের বীরত্বপূর্ণ দেশপ্রেমিক ভূমিকা এই দেশটিকে এক জাতিতত্ত্বের ভাবাবেগে করদরাজ্য হওয়া থেকে রক্ষা করেছে, যার ভূমিকায় আজও কেউ কেউ মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্যপাল হওয়ার পরিবর্তে স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হয়ে ঘুরে বেড়ান তারাও এই দিনে তার কবর জিয়ারতে ভয় পান। অথচ অমন ভয়, হীনমন্যতাকেই জিয়াউর রহমান ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন।

এই ভয় পাওয়ার অপরাধে একজনকে শাস্তি বা গালি দিয়ে লাভ হবে না বা বলির পাঠা বানিয়ে লাভ হবে না। আরো গভীরে এর সমাধান খুজতে হবে।

[ইটালিক]যায়যায়দিন[/ইটালিক] - এর সৌজন্যে ([link|http://www.jaijaidin.com/view_news.php?News-ID=18864&issue=&nav_id=3|AbjvBb GwWk
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০০৬ সকাল ৯:২১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×