এলাটিং বেলাটিং সই লো।
কি খবর আইলো?
রাজায় একটা মাইয়া চাইলো ।
কোন মাইয়া চাইলো?
আগে তো তার ছোট ডাক্তারী বাক্স নিয়ে সে আসত আমার চিকিত্সা করতে। সে নাকি অপারেশন করবে। ইকেশান দেবে! ডাক্তার আন্টিকে বলে তার সেই চিকিত্সা করানো বন্ধ করা গেছে কিন্তু সুঁই নিয়ে সে মাঝে মাঝেই এখনও ইকেশান দিতে আসে। এবার খালুজিকে বলতে হবে। খালুজিকে দেখলে আমার বেশ ভয় ভয় করে। যদিও তিনি কোনদিনই আমায় একটুও বকেননি বরং তার ঐ দুষ্টু ছেলেটাকেই অনেকবার বকেছেন আমাকে ভয় দেখায় বলে । কিন্তু তবুও আমার বেশ ভয় করে খালুজিকে । সকাল বেলায় ঠিক আটটার সময় খালুজির কালো গাড়িটা বেরিয়ে যায়। খালুজী নিজেই গাড়ি চালান । নিজে এসে গ্যারেজের দরজা খোলেন, গাড়ি বার করেন। কাশেম তখন খালুজির কালো ব্যাগ হাতে পেছন পেছন ঘোরে। খালুজির কালো গাড়ি বেরিয়ে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে আর তার ঠিক খানিক পরেই ডাক্তার আন্টি বেরোন হাসপাতালে যাবেন বলে। রিকশা ওয়ালা এসে দাঁড়িয়ে থাকে আগে থেকেই । সেই রিকশায় চেপে ডাক্তার আন্টি হাসপাতালে যান। দুই ঈদের দিনে শুধু ডাক্তার আন্টি, খালুজি আর খালেদ ভাই তিনজনে মিলে একসাথে গাড়িতে করে বেড়াতে যায়। নইলে কক্ষণো ডাক্তার আন্টি গাড়ি চড়েন না । আম্মা বলে, ডাক্তার আন্টিও নাকি খুব বড় ডাক্তার । আমি ভেবে পাই না । কত বড় ডাক্তার? কি করে বড় হয়? ডাক্তার আন্টি তো মাথায় আম্মার চাইতেও খাটো! মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে ডাক্তার আন্টিকেই জিজ্ঞেস করি । কিন্তু তাকেও যে আমার ভয় করে! ডাক্তার আন্টিকে দেখতে খুব সুন্দর । ধবধবে ফর্সা গায়ের রং । মুখটি ভারী মিষ্টি । কিন্তু ডাক্তার আন্টি হাসেন খুব কম। কথা বলেন আরও কম । সবসময় চশমা পরেন বলে চোখের কোলে চশমার দাগ কিন্তু তাতে যেন ডাক্তার আন্টিকে আরও সুন্দর দেখতে লাগে । বাড়িতে তার কোন রোগী আসে না । পাড়ার কারও সাথে মেশেন না ডাক্তার আন্টি আর কেউ তার বাড়িও যায় না অথচ ডাক্তার আন্টির মত এত মিষ্টি মানুষ হয় না । তবে কেন কেউ তার বাড়ি যায় না? আমি আম্মাকে জিজ্ঞেস করব ভাবি কিন্তু কেন যে আমি আম্মাকে সব কথা বলতে পারি না! নিজেই ভেবে ঠিক করে নিই, আসলে ডাক্তার আন্টি এত ভালো যে সবাই তাকে হিংসে করে তাই কেউ তার কাছে যায় না । আম্মা মাঝে মাঝে সন্ধ্যের পরে ওবাড়ি বেড়াতে যায় । সাথে আমিও । কিন্তু আমি যেতে চাই না । আমার যে খুব ভয় করে কিন্তু ডাক্তার আন্টি যে খুব ভাল হালুয়া বানায় ! তাই না গিয়েও পারি না । কখনও গাজর কখনও ছোলা তো কখনও ময়দার হালুয়া । সব সময়েই ডাক্তার আন্টির ফ্রিজে হালুয়া থাকে আর আমি গেলেই সেই হালুয়া আমার সামনে ।।। ওবাড়ি গেলে পর আর একটুও ভয় করে না। ডাক্তার আন্টি উঠে রান্নাঘরের দিকে যায় তারপর আবার ফিরে এসে বসে আর খানিক পরে মালেক ট্রে'তে করে দু-তিন রকমের হালুয়া, মিষ্টি নিয়ে আসে । ডাক্তার আন্টি আমাকে বলে, খেয়ে নিয়ে খেলা করো গিয়ে । আমি ঘুরে ঘুরে এঘর ওঘর দেখি । দাঁড়িয়ে থাকা ঐ নরকঙ্কালটাকে দেখে সিঁটিয়ে যাই ভয়ে । দৌড়ে গিয়ে আম্মার কোলের কাছটিতে বসে পড়ি । ডাক্তার আন্টি গাল টিপে দেন । বলেন, অতো ভয় পেলে চলবে? ডাক্তার আন্টিদের একটা বাগান আছে । বাড়িতে ঢুকতেই গেটের পাশে দুটো রক্তজবার গাছ । সারাবছর তাতে ফুল। ওদের একটা গোলাপজামের গাছও আছে । যা এপাড়ায় আর কারও নেই । গাছটাও এমন ছিল যে অনায়াসেই যে কেউ উঠে যেতে পারতো । আমি কখনও জিজ্ঞেস করে কখনও জিজ্ঞেস না করেই সেই গাছে উঠে পড়ি গোলাপজামের জন্যে । কাশেমটা মাঝে মাঝেই হাঁক দেয় বটে কিন্তু আর কেউ কিছু বলে না । দেওয়ালটাও তো খুব নিচু, গেট বন্ধ থাকলেও দেওয়ালের ওপাশে যাওয়াটা কোন সমস্যা নয়। তবে আব্বা বারন করার পর থেকে ওভাবে দেওয়াল টপকে গাছে চড়ি না আর!
এই দেওয়ালটা বেশ উঁচু । ফুটপাথের এই কদমগাছটা যে বড়ির সামনের রাস্তায় সেটি এক পুলিশবাড়ি । বাড়িটি আপাত:দৃষ্টিতে নীরব নিস্তব্ধ বলে মনে হলেও আসলে যে তা নয় সেটি বোঝা যায় ব্যস্ত-সমস্ত গাড়িদের আনাগোনায় । খানিক পরপরই গাড়ি ঢুকছে বেরুচ্ছে বাড়িটি থেকে আর প্রতিটি গাড়িরই চালক উর্দিপরা । আরোহীদেরও বেশির ভাগ উর্দিপরা থাকে । যখনই কোন গাড়ি ঢোকে কিংবা বেরোয় তখন ঐ বাড়ির গেটে দাড়িয়ে থাকা চার দারোয়ানের একজন এগিয়ে এসে ফুটপাথে দাঁড়ায়। সেও উর্দিপরা বলাই বাহুল্য। সেই দারোয়ান মাঝে মাঝেই এসে বাসের জন্যে অপেক্ষারত যাত্রীদের ওখান থেকে সরে দাঁড়াতে বলে । গেট ছেড়ে আরও এগিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াতে বলে । বড় হয়ে কিংবা সেই শহর ছেড়ে অন্য শহরে যাওয়ার পর আর কোনদিন কদমগাছ দেখিনি । আমি বারবার তাকিয়ে এই কদমগাছটাকে দেখছিলাম । সোজা উঠে গেছে অনেকখানি উপরে । আদ্ধেক ছড়ানো ডাল তার রাস্তার উপরে । আর সেই রাস্তায় বিছিয়ে আছে সরু সরু চিরল চিরল কদমের পাপড়ি । আশে-পাশে তাকালাম গোটা ফুলের খোঁজে। কিন্তু চোখে পড়ল না। নিজেকে শান্তনা দিলাম এ তো আর আমাদের সেই মাঠের কদমতলা নয় যে তাজা, আধপচা, পচা কদমফুলে ভরে থাকবে গাচতলা ! এ তো সরকারী রাস্তা আর তাও আবার পুলিশের ঐ বিশাল বাড়ির সামনের রাস্তা । এখানে এই পাপড়িদেরও তো বেশিক্ষণ থাকার অনুমতি নেই ।