somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক শয়তানের জন্ম (3)

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৬ দুপুর ১:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



জুতা খুলতে গিয়ে দেখি য়ে য়ে তলা ফুটো হয়ে গেছে -
ক্ষয় ধরা তলা দিয়ে ময়লা জমে কালো হয়ে যাওয়া মোজার অংশটা বেরিয়ে পড়েছে। শালা - অসময়ে আর শেষ হওয়ার সময় পেলি না- মেজাজ খিচড়ে ওঠার ভেতরেকটা স্বস্তিদায়ক আনন্দের ঝনঝনানি টের পাই, দারুন সার্ভিস দিলো জুতোটা - পুরোটা আয়ু পায়ের নিচে কেটে গেল - সাধারনত আমার হাতে কোনদিনই কিছু বেশি টেকে না, সুনিপুন বিপননের কেতাদুরস্ত চৌকস ভাবগতির যুগে পুরানো ঢিলেঢালা গতর এলানো ব্যর্থ বিক্রেতাও সোনার চাদি বলে চকমকি পেতল গছিয়ে দিয়ে যায় অনায়াসে।

সেই আমি জুতো ব্যবহারের সাফল্যে ডগমগ হয়ে জুতো জোড়া ছুড়ে ফেলার আনন্দ মিইয়ে গেলো পকেটের শূন্য অবস্থার কথা ভেবে- আর এক জোড়া জুতো কেনার সামর্থ্য তার এখন নাই। খাটের তলায় বাতিল জঞ্জালের স্তুপে ছুড়ে ফেলা জুতো জোড়া আবার বগলদাবা করে নিয়ে যাই মুচির কাছে - কোনমতে সারিয়ে যদি ফুটোফাটা বন্ধ করে কয়েকদিন চালানো যায়-

বাসস্ট্যান্ডে যাবার পথে বাজারের পাশ ঘেসে সার বেধে গোটা তিনেক মুচি ছালা বিছিয়ে বসে থাকে, এই প্রথম বুঝে উঠি তাদের কখনই খেয়াল করে দেখিনি, সরু চোখে আমি তাদের দেখি। তিনজনের মুখের অভিব্যক্তি বুঝে ভাববার চেষ্টা করি কোন লোকটার কাছে গেলে ব্যাপারটা কম পয়সায় সারা যাবে।
আমার তাকানোর ভঙ্গিতেই আমি ধরা পড়ে যাই, কাছের লোকটাই সুবিধা পায় - আমি ধরা পড়া সঙ্কোচকে আড়াল করে কৃত্রিম গাম্ভীর্য্য চোখে মুখে জড়ো করে জুতোজোড়া মুচির কোলে ছুড়ে দেই - চারপাশে মানুষ দেখার ছলে এদিকে ওদিকে তাকাই কিন্তু নজর পড়ে থাকে মুচির হাতে। ও দুই হাতে উল্টে পাল্টে দেখে জুতাজোড়া - আমার আগে খেয়াল পড়ে নি এমন নতুন টোটাফাটাও ধরা পড়ে। মুচির চোখে মুখে জমাট বাধা অবজ্ঞা -নেহাত পেশাগত নিয়ম রক্ষার জন্য সে এটাকে নেড়েচেড়ে দেখছে কাজ করার কোন আগ্রহ সে পায় না মনে হয়।

ঠোট উল্টে মুচি এমনভাবে কথা বলে -তাকে মনে হয় যেন বিশেষজ্ঞ সাস্থ্য বিশারদ গুটিশুটি জড়ো হওয়া অর্ধাহারী অনাহারী মানুষগুলোকে সাস্থ্যরার উপায় বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা করছে। আমি আরেকজন এবং তারপর আরেকজনের কাছে যাই। ওদের প্রত্যেক চাউনি আমাকে লজ্জার ভেতরে ঠেলে দেয় -
আমার মনে পড়ে কতবার এই জুতোটার উপর অকারন অত্যাচার ঘটিয়েছি - তার প্রতি আর একটু সহানুভূতি দেখাতে পারলে হয়তো আরো কয়েকটা দিন আরো চালিয়ে নিতে পারেতো .. স্বপ্নহীন দরিদ্র জীবনের কেদাক্ত মূহূর্তগুলো জান্তব বিভীষিকা হয়ে ওঠে।

পা ঘষটে ঘষটে আমি ফিরে আসি ু মনে হয় জুতোজোড়া এখনকি আমার পা থেকে খসে পড়বে -আমার চোখ রাস্তার দিকে আটকে থাকে - আমার মনে হয় সবাই আমাকে দেখছে - ছোটবেলায় আমি ভাবতাম সবাই আমাকে দেখছে ু আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গায়ক কিংবা কবি, রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছি সবাই এ ওকে বলছে দ্যাক দ্যাখ - ঐ যে চলেছেন ...

গণগনে সূর্যের নিচে শরীরে গলগলিয়ে নেমে পড়া ঘামেও এতটা অস্বস্তি লাগে না - আমি শুনতে পাই লোকেরা চোরা চাউনিতে আমাকে দেখছে ু আমি দ্রুত ফিওে যেতে গিয়েও থমকে যাই এত দ্রুত ছুটতে গেলে জুতোজোড়া চিরদিনের জন্য বিট্রে করে বসতে পারে। কোনমতে বাড়ি পৌছে গিয়ে হাপ ছেড়ে বাচি কিন্তু বেচে থাকলে আপনি কখনও একটি মূহূর্তে আটকে থাকতে পারেন না।

আমি বুঝতে পারি আমার কিছু করার নেই। একজোড়া জুতো আমার জীবনের কাঙালপনাকে প্রতি মূহূর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
একটা মানুষ কতদিন লড়াই করতে পারে? প্রতিটা পা আমাকে বিবমিষার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। ফেলে আসা সমস্ত অতীত এক লাফে সামনে চলে আসে। সমস্ত কিছু অর্থহীন মনে হয়। পেছনে- সামনে সবটুকুই উচ্ছিষ্ট মনে হয়। এটো জীবনটাকে আর কতকাল শুকিয়ে রাখা যায়। হটাৎ সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলি - সাথে সাথে নিজেকে কেমন ভারমুক্ত লাগে।

চারপাশের সবকিছু ছায়াছবির মতো ভাসমান মনে হয় - যেন এর অস্তিত্বটুকু কেবল আমার মস্তিষ্কের মধ্যেই - শো ভাঙরেই এরা হারিয়ে যাবে ফিতার মধ্যে - এই যে ছুটে চলা মূল্যবান মানুষ, গাড়ি, ফুটপাত, মনিহারী দোকান, মেঘ, এরাপ্লেনের আওয়াজ সব সবকিছুর অস্তিত্ব কেবল চোখের পর্দার মধ্যে - এর বাইরে নিকষ নিগম কালো। বেশ ফুরফুরে লাগে- জুতোজোড়ার কথা আর মাথায় থাকে না। হিন্দী সিনেমার একটা হিট গান মনের মধ্যে বেশ গুনগুনিয়ে ওঠে - দেখে চলতে পারো না - যতসব জঞ্জাল -ধমকের সুরে গানের সুরটা খেই হারিয়ে ফেলে- মাঞ্জাদেয়া পুরো শরীরটায় আমি যেন নোংরা ঢেলে দিয়েছি ু আমি ওর দিকে তাকাই , নিজেকে ঠিকঠাক করতে করতে ছেলেটা পাশের উজ্জ্বল মেয়েটার সাথে গজগজ করে- বুঝতে পারি আমাকে নিয়েই.. আমি একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি- জেল দেয়া চুল থেকে পায়ের জুতাটা পর্যন্ত দামী আর সৌখিনতার দামে মোড়া -

আমার মধ্যে এতনে জুতোটা ফিরে আসে -

কি যে হয় আমি ঠিক তখনো বুঝতে পারি নি- যখন খেয়াল হলো ছেলেটা ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে - ঠোট দুটোর জয়েন্টে লাল রক্তের ধারা- সঙ্গীনির মুখের দিকে তাকাই- তার চোখে ভীত হরিনীর কাপন দেখে নিজেকে বেশ একটা কেউকেটা মনে হলো- আমি খুশি হয়ে উঠি - গায়ের সমস্ত জোর পায়ের ডগায় জড়ো করে দুটো কিক বসিয়ে দি - ধুপ ধুপ শব্দ আমার কানে লেগে থাকে ু মনে হয় আশেপাশের সবকটাকে একঘাড় দিয়ে দেই-

মাথাটা হুট করেই নিচে নেমে আসে- চারপাশে পাবলিকের ফোড়ন গায়ে আরো জ্বালা ধরিয়ে দেয়- ভদ্রতার লেবাস নেই তখন আমার কোথাও - ফাক বুঝে আমি কেটে পড়ি পেছনে পড়ে থাকে চিৎকার আর ছেলেটার হুমকি - যা যা দেখি কি করতে পারিস- বাতাসে কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে আমি হাটতে থাকি ু পায়ের জুতোজোড়া এই দমকা চাপ না সইতে পেরে ওখানেই পড়ে রইলো - সে কথা আর আমার মনে পড়ে না।

আমি হাটতে থাকি , দু চোখে যা চোখে ভাসে সব কিছুকে নিজের পায়ের তলে নিয়ে আসতে ইচ্ছা করে, এক গোপন ঈর্ষায় চারদিকের চকচকে মানুষগুলো পুড়ে যায় .. আর তার লেলিহান উত্তাপে আমি ভুলে যাই সিদ্ধান্তটির কথা ু মৃতু্য স্থগিত থাকে অন্তর্গত এক শয়তানের জন্মের ইশতেহারে।


সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×