কোথাও যাওয়া না হলেও বইটা আমি প্রায়ই উলটে দেখি। প্রায় প্রতিবারেই একটা পাতায় এসে আমি আটকে যাই। একটা অদ্ভুত দোকানের ছবি। দোকান না, যেন একটা junkyard. দোকানের কোন জায়গা খালি নেই, চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো জিনিসপত্র। পুরনো বইপত্র-ঘড়ি-মালা থেকে শুরু করে পাখির খাঁচা পর্যন্ত। বিভিন্ন ধরনের চেনা-অচেনা জিনিসের ভিড়ে কিছু মুখোশও যেন উঁকি দেয় আর সেই কারণেই আমার এত আগ্রহ। যেখানেই কোন মাস্কের ছায়া দেখি, আমি সেখানেই হাজির।
দোকানটার নাম Odds 'N' Collectables, 128 তেলক আয়ার স্ট্রিটে। আমাদের নিত্যদিনের বাড়ি-ল্যাব-বাড়ির রাস্তা থেকে অনেক ভিন্ন পথে। বহুদিন ধরেই টিনাকে বলছিলাম আমার সাথে যেতে - হয়নি। সাদিক, সাজিদ আর ইন্দ্রনীলকেও বহুবার বলেছি 'চল' - তাও হয়নি। এমন কি একদিন ইরানী বন্ধু সাঈদের সাথে বেরও হয়েছিলাম, কিন্তু বাসে ওঠার পরে বই খুলে ও-ই বের করেছিল যে দোকানটা 6টায় বন্ধ হয়ে যায় আর তখন অলরেডি সোয়া সাতটা। যাই হোক, আজকে বিকাল যখন হাতে একটু সময় পেলাম তখন ভাবলাম, নাহ, আজকে যেতেই হবে। 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে'।
দুটো বাস বদলে পৌঁছে গেলাম তেলক ব্লাংগা'র বেশ কাছে (সবচেয়ে কাছের এম আর টি তানজং পাগার)। এরপরে একটু হাঁটলেই তেলক আয়ার স্ট্রিট। হাঁটতে হাঁটতে তেলক আয়ার স্ট্রিট আর তার সাথে আমোয় স্ট্রিট বলে আরেকটা স্ট্রিট খুঁজে পেলাম। তেলক ব্লাংগা'র হাই-রাইজের মাঝখানে এ দুটো রাস্তাতে হঠাৎ করেই কিছু ছোট ছোট শপহাউজ। বেশিরভাগই রেস্টুরেন্ট, কিছু বিউটি পারলার আর স্পা, আর বাকিরা ক্যাফে আর পাব। মাস্কের মতই পুরনো/নতুন শপহাউজ আমার আরেকটা প্রিয় জিনিস। তাই বেশ ভাল লাগা শুরু হল।
তখন বিকাল প্রায় সাড়ে পাঁচটা। কিন্তু এর মধ্যেই পুরো জায়গাটা বেশ নির্জন হয়ে এসেছে। দোকান-পাট প্রায় সব বন্ধ। খুঁজতে খুঁজতে আমার সেই দোকানটা পাওয়া গেল। ছবির মতই পুরোপুরি। কি আছে আর কি নেই! পুরো দোকানে একটা ফোঁটাও ফাঁকা জায়গা নেই। পুরনো বইপত্র, ছবি, মুর্তি, টেলিফোন, টিভি, রেডিও, ঘড়ি, খাঁচা, ঝুড়ি, নানা রকম শোপিস - কি নেই সেখানে! দোকানের মালিকের কথা আগেই পড়েছিলাম। জুযের সাইফি নামের এক প্রাক্তন অ্যাডভার্টাইজিং প্রফেশনাল। আজকে সামনাসামনি দেখা হল। আমি পুরোটা চক্কর দিয়ে, চিপার ফাঁক দিয়ে একটা টিনের প্লেট পায়ের উপর ফেলে দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছি দেখে জিজ্ঞেস করলেন কি খুঁজছিলাম। আমি বললাম, মাস্ক । যে দু'একটা ছিল দেখালেন কিন্তু ভাল লাগেনি। বললেন যে মাস্ক থাকে না, বিক্রি হয়ে যায়। টুকটাক গল্প হল আরো - কোন দেশী, কি করছি, কোথেথকে জানলাম - এই সব। বেশ ইন্টারেস্টিং একটা দোকানের ইন্টারেস্টিং মালিক। পুরনো সব বিবর্ণ জিনিসের মাঝে খুব স্পিরিটেড এক জোড়া প্রাণবন্ত চোখ। ভাল লাগল খুব। আবার আসব বলে বের হলাম।
তারপর দু'টো রাস্তায় হাঁটলাম কিছুক্ষণ। কিছু Buddhist Temple আর মসজিদ চোখে পড়ল। ছোট্ট সিঙ্গাপুরের আরো কতখানে এখনো যাওয়া হয়নি ভেবে অবাক হলাম।
যেকোন রেস্টুরেন্ট এরিয়ায় আমি থাই ফুডের দোকান খুঁজে বেড়াই। এখানেও পেয়ে গেলাম Tuk Tuk Thai Kitchen নামের একটা দোকান। ব্যাস! ঢুকে পড়লাম। সেখান থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁেছ গেলাম Far East Square বলে আরেকটা মজার জায়গায়। সেখানে একদিকে ফুটপাথ জুড়ে যে যার মত পুরনো জিনিস-পত্র বিক্রি করছে আর আরেকদিকে কিছু বুড়োবুড়ি মিউজিকাল যন্ত্রপাতি বাজিয়ে গান-বাজনা শুরু করেছে। বেশ একটা ফেস্টিভ ভাব। ওখানেও কিছুক্ষণ মুখোশের সন্ধানে ঘুরলাম - পেলাম না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির একটা পুরনো ইস্যু কিনলাম 1 ডলার দিয়ে। কাভারে প্রাচীন মিশরীয় একটা মুখোশ - দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো।
এই দিকে আসিনি কোনদিন। হঠাৎ করেই যেন পুরনো কোন এক নগরীতে চলে এসেছি মনে হচ্ছিল। চারদিকে ছড়ানো ছিটানো পুরনো আমেজ। পুরো সন্ধ্যাটাই কেমন যেন ঘোরে কাটল। কিছু ছবি তুললাম, তেমন ভাল হল না। অদ্ভুত দোকানটার ছবি তোলা হয়নি, মনে হয় না অনুমতি পেতাম।
ফেরার পথে হারবারফ্রান্ট হয়ে ফিরলাম। পুরনো এক শহর থেকে যেন অত্যাধুনিক কোন নগরীতে প্রবেশ করলাম। কোন মিল নেই। তখনো ঘোর কাটছে না। বাড়ি ফেরার বাসে আমার আর আরেক ভারতীয় ভদ্রমহিলার মাঝখানে একটা পিচ্চি এসে বসে খুব জোরে-সোরে মাথা চুলকাতে লাগল। তাই দেখে আমি আর সেই অচেনা ভদ্রমহিলা একটা হাসি বিনিময় করলাম। পুরোপুরি অচেনা কারো সাথে হঠাৎ করেই এভাবে মুহূর্তের জন্য ভাবনা এক হয়ে যায়। অদ্ভুত! নাহ! পৃথিবীটা আসলেই একটা ইন্টারেস্টিং জায়গা।
এভাবেই আমার আজকের সন্ধ্যাটা কাটল বেশ অদ্ভুত এক ঘোরে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০০৬ রাত ১২:০৬