somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হায় প্রবাস, স্বপ্নের প্রবাস

২৬ শে আগস্ট, ২০০৬ রাত ৩:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"আমি আগেই জানতাম এ রকম একটা কিছু হবেই, কিন্তু তোর বাবা তো শুনল না, আমেরিকান ছেলে দেখে মজে গেল। ছোটলোকের বাচ্চা- এনগেজমেন্ট এর দিন কেউ এভাবে বিয়ে ভেঙে দেয়। আরে বান্দর, তোর গলায় কি আর মুক্তার মালা মানাবে।"-মিলির খালা এক নিশ্বাসে কথা কটি বলে দম নেন।

মিলি মনে মনে তিন বার উচ্চারণ করে, মুটকি- মুটকি- মুটকি-এটা মিলির রাগ কমনোর নিজস্ব পদ্ধতি। মিলির বিয়ের ব্যাপারে এই খালার উৎসাহই ছিল সবচেয়ে বেশী।

নতুন ম্যাজেশিয়ানের পকেটে যেমন সব সময় এক প্যাকেট তাস থাকে, তেমনি মিলির এই মুটকি খালার হাত ব্যাগে সব সময় থাকবে এক গাদা পাত্র-পাত্রীর ছবি। সুযোগ পেলেই এই মহিলা উনার তাসের খেলা দেখাতে শুরু করে দেন। প্রথমে ব্যাগ খেকে বের হবে জোকার-অর্থাৎ সাধারণ মানের পাত্র-পাত্রীর ছবি, তারপর রাজা-রানী এবং সবশেষে টেক্কা। আগের ছবিগুলি দেখে কেউ যদি হাল ছেড়ে দেয়া শুরু করে তখন খালা টেক্কাগুলি ফেলে বিজয়ীর বেশে দর্শকের দিকে তাকাবেন। এরা উনার দৃষ্টিতে সেরা মানের পাত্র-পাত্রী। এ রকমই এক টেক্কা (আমেরিকা প্রবাসী ছেলে)-র সাথে তিনি মিলির বিয়ে ঠিক করেছিলেন।

লজ্জায় মিলি চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
আজ সকালে ছেলের মা ফোন করেছিলেন-ছেলে তিন মাসের ছুটিতে দেশে এসেছিল, ইচ্ছে ছিল এর মধ্যে মেয়ে পছন্দ হলে বিয়ে করে পরবর্তীতে এসে বউ নিয়ে যাবে। কিন্তু আজ কি এক জরুরী কাজে তাকে আমেরিকা ফিরে যেতে হচ্ছে। মিলির খালার ধারণা এটা তাদের ছেলেকে বিয়ে না করানোর একটা অজুহাত। মিলির খালার বোধ হয় আরও কিছু বলার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মিলির মা এর কারণে বলতে পারেন না। মিলির ধারণা তার মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা দের একজন। নিজের সত্তানের যে কোন বিপদে তিনি সবসময় তাদের আগলিয়ে রেখেছেন। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে কিন্তু তিনি মিলিকে কিছু বুঝতে দিচ্ছেন না। যেন খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। ধীরে ধীরে এক সময় মিলি সবকিছু ভুলে যেতে শুরু করে।

এর কিছুদিন পরে আমেরিকা থেকে মিলির নামে একটা চিঠি আসে-

মিলি,
প্রথমেই তোমাকে তুমি করে বলার জন্যে ক্ষমা চাচ্ছি। তুমি বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট হবে তাই তুমি করেই বলছি। আমার পরিবারের পক্ষ থেকে আমি হাত জোড় করে তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। বিয়ে ভেঙে দেয়াটা ছিল আমার একক সিদ্ধান্ত, আমার পরিবারের কোন ভূমিকা এখানে ছিল না। এর কারণটা বলার জন্যেই তোমাকে চিঠি লেখা, ব্যাখাটা তোমার কাছে গহণযোগ্য মনে হবে কিনা আমি জানি না। তারপরও বলছি-

আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছি প্রবাসে। আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব হীন এক নিঃসঙ্গ জীবন। দেশ থেকে চিঠি আসলে বেশির ভাগই আমি পড়তাম না, কারণ সেগুলিতে টাকা পাঠানোর তাগিদ ছাড়া আর কিছুই থাকত না। কারো পরীক্ষার ফি, কারো ব্যাবসার জন্যে টাকা, কারো বা চিকিৎসার খরচ। আমি যেন টাকা পাঠানোর একটা মেশিন ছাড়া আর কিছু না। মনে পড়ে প্রথম যেদিন দেশে ফোন করি বাবা ফোন ধরেন। এত দিন পর দেশ থেকে পরিচিত কারো কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে নিজের অজান্তেই আমার চোখ ভিজে আসে। বাবা প্রখম যে কথাটি বলেন তা হচ্ছে-'তুই টাকা পাঠাতে এত দেরী করছিস কেন? আমারতো এখানে প্রচুর দেনা, এত টাকা খরচ করে তোকে বিদেশে পাঠালাম।' ফলে দেশে আসার আগ্রহ আমি কখনই অনুভব করিনি।

দীর্ঘ এক যুগ পর আমি দেশে আসি। তোমাকে আমি প্রথম যেদিন দেখি সেদিন আমি একটা ধাক্কার মত খাই। আমার তখন মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে রুপসী তরুণীটি আমার সামনে বসে আছে। কেন যেন তখন আমার নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছিল। নিজেকে তখন 'বিউটি এন্ড দ্য বিস্ট' এর সেই দৈত্যের মত মনে হচ্ছিল। তখন মনে হল ইচ্ছে করলেই আসলে সব কিছু আবার আগের মত নতুন করে শুরু করা যায় না। সময় সব কিছু বদলে দেয়। আমি ইচ্ছে করলেই এখন পুথিবীর সবচেয়ে লেটেস্ট মডেলের গাড়ীটি কিনে ফেলতে পারি, কিন্তু ইচ্ছে করলেই নিজের বয়সের চেয়ে অর্ধেক বয়সের তরুণীর হাত ধরে ভালবাসার কথা বলা অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেই সময়টুকু আমি অনেক আগেই পার করে এসেছি।

যাক্ চিঠি আর দীর্ঘ করছি না। হঠাৎ করে আজ কেন যেন কোমাকে লিখতে ইচ্ছে হল তাই এই চিঠি লেখা। নিজের সমস্যার কথা আসলে অন্যকে বলতে ভাল লাগে না।

মিলি বেঁচে থাকাটা বোধ হয় খুব একটা খারাপ না, যদি নিজের মত করে বেঁচে থাকা যায়। এই যে আমার একাকী জীবন এটাকে এখন আর খুব একটা খারাপ বলে মনে হয় না। কি দরকার নতুন করে সম্পর্কে জড়িয়ে। এভাবেই হয়ত ভাল আছি।

প্রার্থনা করি খুব চমৎকার হৃদয়বান একটি ছেলের সাথে যেন তোমার বিয়ে হয়। যার হাত ধরে র্নিভাবনায় বাকী জীবনটা তুমি কাটিয়ে দিতে পার-

চিঠি এখানেই শেষ। নাম ঠিকানা কিছুই নেই।
আশ্চর্য এ মুহুর্তে মিলি কিছুতেই লোকটার নাম মনে করতে পারছে না, কিন্তু কেন যেন জানতে খুব ইচ্ছে করছে।

-----------0-----------

(আমাদের দেশের কোন এক সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার বন্ধ করে দেয়া উচিত, যেহেতু তারা দেশে না থেকে বিদেশে থাকে। কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন আমাদের দেশের অর্থনীতি দেশে পাঠানো প্রবাসীদের টাকার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সখ কোের কেউ বিদেশে থাকতে চায় না, পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করে। আমাদের ধারণা বিদেশে আমাদের দেশের লোকজনেরা সম্ভবত রাজার হালে আছেন। কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার কামাচ্ছে। কিন্তু দেশের জন্যে যখন তাদের মন আকুলি -বাকুলি করে তখন তাদের সেই কান্না আমরা দেখতে পাই না।

কবি জীবনান্দ দাসের সেই কবিতার লাইনটি আমার মাঝে মধ্যে মনে পড়ে-
'হায় চিল সোনালী ডানার চিল'
প্র্রবাসীদের আমার কাছে সেই চিলের মতো মনে হয়, যার ডানা দুটি ভাঙ্গা। সীমাহীন আকাশ তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সে সেই আকাশে ডানা মেলতে পারছে না।)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০০৮ বিকাল ৩:২৫
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×