somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতির শহর থেকে-(শামসুর রহমানের 'স্মৃতির শহর' গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

২৪ শে আগস্ট, ২০০৬ সন্ধ্যা ৬:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শহরের নাম ঢাকা। এ শহরে একটা সরু গলিতে যখন আমি প্রথম চোখ খুলেছিলাম, তখন ঢাকা ছিল কেমন ফাঁকা ফাঁকা। এত দরদালান ছিল না, বাস ছিল না, মোটর ছিল না, এমনকি রিকশাও ছিল না, রাস্টায় রাস্টায় ছিল না সারি সারি পিঁপড়ের মতো মানুষের ভিড়। ছিল ছোট ছোট পথ, একটি কি দুটি বড় রাস্টস্না। ছিল অনেকগুলো গলি, সেসব চুলের ফিতের মতো গলির ভেতর ছিল জনমনিষ্যির বসতি। পাড়ায় পাড়ায় ঘাস-বিচালির গল্পব্দ-ছড়ানো আস্টস্নাবল ছিল, আর ছিল ঘোড়ার গাড়ি। গাড়োয়ানের চাবুক ঝিকিয়ে উঠত হাওয়ায়, রোদ্দুরে। কাছে-দহৃরে মজাদার শ্বন্ধ করে ঘোড়া ছুটত দিগ্গি্বদিক-খট্ খট্ আর গাড়োয়ান লাগাম নেড়ে বলত হট্ হট্ হট্।
আমি যে পাড়ায় জন্মেছি তার নাম ছিল খুব সুন্দর। মাহুতটুলি। অনেক অনেক আগে হয়তো শুধু মাহুতদের বসবাস ছিল পাড়াটায়, সেই রাজা-বাদশাহদের আমলে। মাহুতটুলিতে কিন্তু আমি কোনো হাতিশালা দেখিনি, হাতি দেখিনি, হাতির হাওদা দেখিনি, দেখিনি মাহুত_ সেই যারা হাতি চালায়। মাহুতটুলির যে গলিতে থাকতাম, সেখানে ছিল না সোনার গাছ, যে গাছে ফলে থোকা থোকা হীরের পল। ছিল না সোনার দাঁড়ে বাঁধা হীরামন তোতা। টলটলে ফোয়ারা ছিল না কোনো, যার রুপোলি পানির ছিটায় পাথর হয়ে যাবে টুকটুকে রাজপুত্তুর। সেই সোনার ছেলে সব, যারা ঘর ছেড়ে, ঘোড়া ছুটিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল আশ্চর্য ফুলের খোঁজে। মাহুতটুলির গলিতে পালগ্ধক ছিল না, সোনা-রুপোর কাঠি ছিল না, ছিল না ঘিয়ের প্রদীপ। কিন্তু ছিল একটা বাতি, গলির শেষ সীমায় দাঁড়ানো। রোজ সল্পেব্দ্যবেলা কাঁধে মই ঝুলিয়ে আসত বাতিঅলা। তার গলায় মাদুলি, মাথায় ফতুয়া। খালি-পা, হাঁটত হনহনিয়ে। আমি রোজ অপেক্ষা করতাম, কখন সহৃর্যিমামা পশ্চিম আকাশ থেকে তার রঙিন গালিচাটা গুটিয়ে নেবেন, কখন ছায়া নামবে গলিতে। কারণ সহৃর্যের আলো ফুরুলেই বাতিঅলা আসবে আলো জ্বালানোর খেলা খেলতে। গলির শেষে সীমার বাতিটায় আলোর ফুল ধরবে, নরম তুলতুলে আলোর ফুল। বাতিঅলা মই বেয়ে উঠবে, ফতুয়ার পকেট থেকে কী একটা বের করবে, তারপর গলিতে আলোর কলি, যেন কোনো জাদুকর সল্পেব্দ্যর বোঁটায় ঝুলিয়ে দিয়েছে আলোর ফুল, আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে। তখন ইচ্ছে হতো বাতিঅলাকে ডেকে বলি : 'বাতিঅলা করছ তুমি/কী যে মজার কাজ।/পরিয়ে দিয়ে সাঁঝের গায়ে/আলো-জরির সাজ।' কিন্তু শখ করে মনে মনে বানানো কথাগুলো কখনো জানানো হতো না তাকে। শুধু দেখতাম ওকে, দহৃর থেকে জানালার শিকের ফাঁক থেকে দেখতাম আলোর ফুল। চোখ জ্বলজ্বলে। কোনো দিন ওর কাছে যাইনি। ভয় হতো, যদি অাঁতকা আমার মুখ থেকে এমন কোনো বোকা বোকা কথা ছিটকে বেরিয়ে পড়ে, যা শুনে বাতিঅলার মেজাজ বিগড়ে যাবে, আড়ি দেবে সে আমার সঙ্গে, আর কোনো দিন আমাদের বাড়িঘেঁষে দাঁড়ানো বাতিটায় আলো জ্বালবে না সল্পেব্দ্যবেলায়। সে হয়তো রাগ করে আসবেই না আর আমাদের গলিতে। আর সে না এলে ছোট্ট গলিটা মুখ কালো করে রাখবে সারা সল্পেব্দ্যবেলা, রাতে হাসি ফুটবে না ওর ঠোঁটে। তাই চুপচাপই থাকতাম, শুধু দেখতাম চেয়ে চেয়ে। গলি বেয়ে ছায়া নামত, অল্পব্দকার হামাগুড়ি দিয়ে আলো ফুটত বাতিঅলার হাতের ছোঁয়ায়, আলো ফুটলে সে খানিক মাথা নোয়াত মই থেকে নামার আগে, একবার দেখে নিত কাচের ভেতরকার আলোর পদ্মটাকে। কখনো মনে হতো, বাতিঅলা একেবারে মিশে গেছে বাতিটার গায়ে, শুধু শহৃন্য মই দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে। এই খেলা কত কত দিন যে দেখেছি একা একা, জানালার সরু সরু শিকে গাল লাগিয়ে, তার আর কোনো লেখাজোখা নেই। আলো জ্বালানোর খেলা সাঙ্গ করে বাতিঅলা যেত চলে কাঁধে মই ঝুলিয়ে, শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে_ যেন মিলিয়ে যেত হাওয়ায়। গলায় মাদুলি, মাথায় কিস্টিস্নটুপি, কাত করে পরা। তারপর ছেলে ঘুমাত, পাড়া জুড়াত। বিছানায় গা এলিয়ে দিলে কোনো দিন চট করেই হাজির হতেন ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি। আমার নানির বাটাভরা পানের দিকে নজর না দিয়ে, পিঁড়ি ডিঙিয়ে, পালগ্ধক ছেড়ে নিরিবিলি ওরা এসে বসতেন আমার চোখের পাতায়। একজোড়া চোখে ওদের ছায়া-রঙের অাঁচল লুটিয়ে পড়লে টুপ করে ডুব দিতাম ঘুমের নিঝুম সরোবরে। কোনো কোনো দিন আবার ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসির দেখা মিলত না অনেক রাত অ্বিন্ধ। নানা ধরনের শ্বন্ধ হতো_ খুট্ খুট্ ঠক্ ঠক্, মক্ মক্, চিক্ চিক্, ঝিক্ ঝিক্, আরো কত শ্বন্ধ, বিদঘুটে, কুটকুটে সব শ্বন্ধ, আর আমি খামোখা জ্বন্ধ হতাম বিছানায় শুয়ে শুয়ে।
এক সময় চেনা আওয়াজ বাজত হাওয়ায়, রাতের বুকে। আওয়াজটা উঠে আসত গলির কৌটো থেকে, যেন প্রাণভোমরার শ্বন্ধ। পথ হাঁটার শ্বন্ধ শুনতে পেতাম, গুনতে পারতাম শ্বন্ধগুলোকে এক এক করে। জুতো পায়ে কেউ গলি পেরুচ্ছে। জুতোর শ্বেন্ধ অল্পব্দকারের কালো কালো কিছু মিহি রেশমি সুতো ছিঁড়ে যাচ্ছে, আমি শুনতে পেতাম। কান পেতে, বালিশে মাথা রেখে। আলীজান ব্যাপারী পামঙ্সু পায়ে গলি পেরুচ্ছেন, চলেছেন নিজের বাড়ির দিকে। বেশ রাত করে বাড়ি ফিরতেন আলীজান ব্যাপারী। কোনো এক রাতে একটা শ্বন্ধ শুনে চমকে উঠে নানির কাছে এসে, বুকঘেঁষে জানতে চেয়েছিলাম, শ্বন্ধটা কিসের। নানি আমার চুলে আঙুল বুলোতে বুলোতে বলেছিলাম, আলীজান ব্যাপারীর জুতোর শ্বন্ধ ওটা। এক সময় আলীজান ব্যাপারীর সাবান আর তামাকের দোকান ছিল মস্টস্ন। দোকানপাট বল্পব্দ করে ঘরে ফিরতেন তিনি অনেক রাতে। তাকে কোনো দিন পাজামা পরতে দেখিনি, কিংবা চোগা-চাপকান। কান-ঢাকা পাগড়িও পরতেন না তিনি। পরতেন লুঙ্গি, কখনো একরঙা, সাদাসিধে, কখনো ডোরাকাটা, আর পরতেন পাঞ্জাবি। সবসময় মাথায় গোল একটা টুপি থাকত কাপড়ের। পায়ে পামঙ্সু। সারা মহল্ক্নার কান খাড়া হতো তার পামঙ্সুর শ্বেন্ধ। মহল্ক্নার সর্দার ছিলেন তিনি, জবরদস্টস্ন মানুষ। তার এক ডাকে সবাই হতো হাজির, না এলে যেন জবাই করে ফেলবেন তিনি, এমনই তাদের হাবভাব। বলতে হয়, দাপট ছিল আলীজান ব্যাপারীর, তবে তার জুলুমের কথা কিছু শুনিনি। করলেও সেসব বোঝার বয়েস তখন হয়নি। ঢাকার লোক পুকুরকে বলে তালাও। আমি কোনো দিন সেই পুকুরে নামিনি। মুরবি্বদের বারণ ছিল। তাই পা বাড়াতে পারিনি তালাওয়ের দিকে। পাঁচকড়ি মিঞার বাড়ির পাশেই ছিল সেই তালাও। লোকে পুকুরটার নাম দিয়েছিল ভগতের গাড়া। এই নামকরণের পেছনে কোনো ইতিহাস আছে কি-না জানি না। পাঁচকড়ি মিঞা ছিলেন বড়সড়, লল্ফ্বা-চাওড়া মানুষ। শ্বন্ধ করে হুক্কো টানতেন আর খুলে দিতেন গল্কেপ্পর ফোয়ারার মুখ। সত্যি বলতে কি, পাঁচকড়ি মিঞার চেহারা শাহী শাহী মনে হতো আমার কাছে; কিন্তু তার একটা পা ছিল বিশ্রী, বিকট ফোলা ফোলা। অর্থাৎ পাঁচকড়ি মিঞার পায়ে ছিল গোদ। খোদ তিনি সজাগ উপহার। পাঁচকড়ি মিঞা আমাকে কোনো উপহার দেননি কখনো। তবু ওকে খুব ভালো লাগত আমার। তিনি যখন হাত নেড়ে নেড়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে দাড়িতে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে কথা বলতেন কিংবা লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াতেন পুকুরটার সামনে, আমি অবাক হয়ে দেখতাম তাকে। আমার নানার সঙ্গে ভাব ছিল তার। তিনি প্রায় রোজই আসতেন নানার কাছে, গল্কপ্পসল্কপ্প করতে। বড় গোল্কেপ্প ছিলেন ভদ্রলোক। পাঁচকড়ি মিঞা এলে নানাও খুব খুশি হতেন, দেখেছি। তিনি এলেই হুক্কোটা বাড়িয়ে দিতেন নানা, পাঁচকড়ি মিঞা গুড়গুড় শ্বন্ধ করে হুক্কো টানতেন আর খুলে দিতেন গল্কেপ্পর ফোয়ারার মুখ। সত্যি বলতে কি, পাঁচকড়ি মিঞার চেহারা ছিল বিশ্রী, বিকট ফোলা ফোলা। অর্থাৎ পাঁচকড়ি মিঞার পায়ে ছিল গোদ। খোদ তিনি সজাগ ছিলেন তার এই খুঁত সমঙ্র্কে, বুঝি তাই বারবার চেয়ে দেখতেন নিজের পায়ের অদরকারি অংশটুকু। নিজের পায়ের মাংসের এই বাড়াবাড়ি তিনি হয়তো মেনে নিতে পারেননি কোনো দিন।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এলজিবিটি নিয়ে আমার অবস্থান কী!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১০ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৫

অনেকেই আমাকে ট্রান্স জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে একজন সাধারণ মানুষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত- সে বিষয়ে মতামত চেয়েছেন। কারণ আমি মধ্যপন্থার মতামত দিয়ে থাকি। এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আব্বাসীয় কুরাইশ বেশি যোগ্য

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৫




সূরাঃ ২ বাকারা, ১২৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
১২৪। আর যখন তোমার প্রতিপালক ইব্রাহীমকে কয়েকটি বাক্য (কালিমাত) দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন, পরে সে তা পূর্ণ করেছিল; তিনি বললেন নিশ্চয়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ফতোয়া দিতেছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


আপন খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো বোনের বা ছেলের, মেয়েকে বিবাহ করা যায়, এ সম্পর্কে আমি জানতে ইউটিউবে সার্চ দিলাম, দেখলাম শায়খ আব্দুল্লাহ, তারপর এই মামুনুল হক ( জেল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুমার নামাজে এক অভূতপূর্ব ঘটনা

লিখেছেন সাব্বির আহমেদ সাকিল, ১০ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০



মসজিদের ভেতর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাহিরে বিছিয়ে দেয়া চটে বসে আছি । রোদের প্রখরতা বেশ কড়া । গা ঘেমে ভিজে ওঠার অবস্থা । মুয়াজ্জিন ইকামাত দিলেন, নামাজ শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×