বিদিশার বিরুদ্ধে মামলা ও পরে তাকে তালাক দিয়েও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ স্বাভাবিক সুরেই কথা বলেছেন বিদিশার মা'র সঙ্গে। সোমবার সকাল 6টার দিকে ল্যান্ডফোনে এরশাদের সঙ্গে কথা হয়েছে বিদিশার মা আনোয়ারা সিদ্দিকের। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে এরশাদকে মামলা তুলে নেবার অনুরোধ করেছেন। এরশাদ তাকে আশ্বস করে বলেছেন, 'আম্মা, আপনি চিন া করবেন না। বিষয়টি আমি দেখছি।' সোমবার বেলা পৌনে 12টার দিকে আনোয়ারা সিদ্দিক রাজশাহীতে তাদের নিজেদের বাসায় বসে সমকালের সঙ্গে আলাপকালে জানান এ কথা। তখনও তিনি জানেন না, তার মেয়ে বিদিশাকে এরশাদ তালাক দিয়েছেন। বিষয়টি তিনি জেনেছেন বেলা 12 টার পর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত এ সংক্রান খবর দেখে। আর এরশাদ-বিদিশার তালাকের বিষয়টি জানার পর থেকেই আনোয়ারা সিদ্দিক মুচ্র্ছা যাচ্ছেন ঘন ঘন। তবে বিকেল সোয়া 5 টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন বিদিশার রাজশাহীর বাসায় তালাকের কোনও চিঠি আসে নি।
সাংবাদিকতার স ত্র ধরে বিদিশার মা'র বাসাটিতে আগেও একবার যাওয়া হয়েছিলো 2002 সালে। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ তখন কেবলমাত্র বিদিশাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স ীর স্বীকৃতি দিয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামঙ্াস সংলগ্ন কাজলা এলাকায় ছিমছাম সেই বাসায় এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে এখনকার মতোই তখনও থাকতেন বিদিশার মা আনোয়ারা সিদ্দিক। সেই সময় 'মুখ খুলবেন না খুলবেন না' করেও বিদিশার মা অনেক কথাই বলেছিলেন। সত্তুরোধর্্ব জামাতা এরশাদের ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ঝরেছিলো আনোয়ারা সিদ্দিকের কণ্ঠে। প্রায় 3 বছর পরও বাসাটি তেমনি আছে_ অপরিবর্তিত, শুধু বদলে গেছে বাসার মানুষের কথাবার্তা আর দৃষ্টিভঙ্গী। সাংবাদিক পরিচয় পেলে এখন বাসার ভেতরেই ঢুকতে দিচ্ছেন না তারা। 'কথা বলবো না বলবো না' করেও দু'য়েকটি কথা যা বললেন তাতে ফুটে বেরুলো এরশাদের প্রতি পরিবারের সদস্যদের বিরূপ মনোভাবের কথা।
কাজলা এলাকার যে অংশটিতে বিদিশার মা'র বাসা, সেখানে আশেপাশে সবই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক-পরিবার। সোমবার বাসাটিতে গিয়ে দেখা গেলো, 3 বছর আগে যেমন রঙবিহীন ছিলো বাইরের দেয়াল, এখনও ঠিক তেমনি আছে। কোলাবসিবল গেটের ওপরের কার্নিশের এককোণে জমেছে সবুজাভ শৈবাল। 3 বছর আগের মতোই এখনও বাইরের গেটে শব্দ করতেই ভেতর থেকে শোনা গেলো পোষা কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক। দরজা খুললেন বিদিশার ছোট ভাই সোয়েব সাম্য সিদ্দিক। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সাম্যর চেহারা রঙ হারালো। 'আমরা কোনও সাংবাদিককেই ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছি না। আপনি দয়া করে চলে যান।' বেশ খানিকণ অনুরোধ করার পর একটু নরম হলেন সাম্য। ভেতর থেকে মা'র সম্মতি আনলেন। 'একটু দাঁড়ান, কুকুরটি সামলে রাখি।' কথা বলতে বলতেই কুকুরটিকে শেকলে আটকালেন। তারপর গেট খুলে ভেতরে নিয়ে বসতে দিলেন ড্রয়িংরুমে। বাসার ছিরিছাঁদ অপরিবর্তিত থাকলেও আনোয়ারা সিদ্দিককে কোনওভাবেই 3 বছর আগের সঙ্গে মেলানো যাচ্ছিলো না_ বেশ খানিকটা শুকিয়েছেন, গাঢ় কালি জমেছে দু'চোখের কোণ জুড়ে। ঘরে এসেই ছুঁড়ে দিলেন একগাদা প্রশ্ন, 'অনেক তো লিখেছেন। আর কী লিখবেন? কী লেখার আছে আর?' সব তো লেখা হয় নি। বিদিশার পরিবারের সদস্যরা যে গুমরে মরছেন আর দশজনের স্বজনের মতোই_ একথা তো লেখা হয় নি। সে কথাই লিখতে এসেছি বলতেই নরম হলেন বিদিশার মা, 'দল এরশাদের। দলে তিনি কাকে রাখবেন না রাখবেন তা তার সিদ্ধান । কিন্তু কোনও মিথ্যা দিয়ে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। সাময়িকভাবে হয়তো মিথ্যে দিয়ে কোনও সত্য চাপা দেয়া যায়। কিন্তু একদিন না একদিন আসল সত্য বেরিয়ে আসে। এটাই নিয়ম।' মা হিসেবে আপনি কি মনে করেন বিদিশার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য? একটি দীর্ঘশ্বাস চেপে আনোয়ারা সিদ্দিকের জবাব, 'দু'দিন আগেও মোবাইলে ওর (বিদিশার) সঙ্গে কথা হয়েছে। তখন থেকেই ও একটা ষড়যন আঁচ করছিলো। কিন্তু তা যে এতোটা নির্মম হবে ভাবি নি। এখন আমার মেয়েটা কী করবে? তার তো সংসার হলো না, রাজনীতিও করতে পারলো না। পুলিশ তো এখন ওর ওপর বিনাদোষে নির্যাতন চালাবে। মেয়েটা আমার পুলিশের নির্যাতন সহ্য করবে কী করে?' ষড়যন কারী কে হতে পারে? এবার যেনও কণ্ঠ একটু রূঢ় হলো বিদিশার মা'র, 'এরা একজন নয়। অনেকে মিলেই ষড়যন করেছে। বিদিশা বরাবরই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। রংপুরে দলের মসহাসচিব হোটেলে কেলেঙ্কারি করেছে। বিদিশা তার প্রতিবাদ করেছে। এই কেলেঙ্কারি যারা করেছে, তারাই এটা করিয়েছে। আর বাইরে থেকে আসা চাপের কারণে এরশাদ এ সিদ্ধান নিয়েছেন। এরশাদ তো চলেনই এভাবে। তিনি তো নিজের সিদ্ধান নিজে কখনও নিতে পারেন নি।' এরশাদের সঙ্গে কথা হয়েছে কি না এ ব্যাপারে বিদিশার মা জানান, 'সোমবার সকাল 6 টার দিকে ল্যান্ডফোনে এরশাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। সে স্বাভাবিক স্বরেই কথা বলেছে। আমি মামলা প্রত্যাহারের অনুরোধ করায় সে বলেছে, আম্মা, আপনি চিন া করবেন না। বিষয়টি আমি দেখছি।' বিদিশার ভাই সাম্য জানান, সামনেই তার মাস্টার্স পরীা। বিদিশার এ ঘটনা তার পরীায় প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। বাসা থেকে চলে আসার আগে তিনি বলেন, 'দুলাভাইয়ের কাজ দুলাভাই করেছে। আমরা এখন ন্যায় বিচার চাই।'
তালাকের খবর জানার পর বিকেলে ফোনে কথা বলতে চাইলে বিদিশার ছোট ভাই সোয়েব সাম্য সিদ্দিক বলেন, 'মা এখন আর সুস্থ্য নেই, তাকে নিয়ে আমরা বড়ই বিব্রতকর অবস্থায় আছি। মার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে পরে আসুন।' এরশাদ-বিদিশার তালাকের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এ সময় সাম্য বললেন, 'বিমানবন্দরে এরশাদ সাংবাদিকদের বলেছেন বিদিশার নাকি দু'জন স্বামী। আমাদের প্রশ্ন হলো, তিনি যখন যেচে পড়ে বিদিশাকে বিয়ে করেন, তখন কি বিষয়টি জানতেন না? তিনি অবশ্যই জানতেন যে বিদিশা তার আগের স্বামীকে তালাক দিয়েছে। এখন যে ঘটনাগুলো ঘটছে তা দেখে-শুনে বোঝা যাচ্ছে সবই প র্বপরিকল্পিত। দেশের মানুষও বুঝতে পারছে সবই সাজানো নাটক।' সাম্যর মতে, অন্য কারো ইশারায় এরশাদ এসব ঘটনা ঘটিয়ে বিদেশে পালিয়েছে।
এই প্রতিবেদনটি 7 জুন 2005 সমকালে প্রকাশিত হয়।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০