আব্বা এলো অনেক রাত করে। ইদানিং প্রায়ই দেরী করে আসে। ভীষণ ক্লান্ত থাকে তখন। বেশীর ভাগ সময়েই আব্বার সাথে দেখা হয় না রাতে। তিতলি রণক দুজনেই ঘুমিয়ে থাকে তখন। তবে আজকের পরিবেশ আলাদা। কাল স্কুল ছুটি, আর মা ও বেশ ব্যস্তভাবে রান্না করছে তাই ওরা যে জেগে আছে এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি।
আব্বা এসেই পাগলা হুজুরের কথা শুনলো। বেশ গম্ভীর দেখালো তাকে। এতক্ষণে তিতলি বুঝতে পেরেছে পাগলা হুজুর এ বাড়ীতে থাকুক এটা কারোই মনোঃপুত হচ্ছে না। আব্বা বসার ঘরে এলো।
- আসসালামুআলাইকুম। আমি আপনার শিক্ষক ছিলাম, আপনার বোধহয় স্মরণে নাই।
- ওয়ালাইকুম আস সালাম। মনে থাকবে না কেন? আপনি বসেন।
আব্বার সাথে একবার চিড়িয়াখানা দেখতে গিয়েছিল তিতলি। সেখানে আব্বার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হাবিব চাচার সাথে দেখা হয়েছিল । আব্বা তাঁকে পা ছুঁয়ে সালাম করেছিল। তিতলিকেও সালাম করতে বলেছিল। তিতলি ভেবেছিল হুজুরের বেলায়ও আব্বা তাই করবে। আর ইনি যেহেতু আরো অনেক বেশী বুড়ো, নিশ্চয়ই তাঁর সম্মানও বেশী। কিন্তু সে রকম কিছুই করলো না আব্বা। সোফায় বসে কথা বলতে লাগলো।
- এই বুঝি আপনার নাতি?
- জ্বী হঁ্যা বাবা।
- তুমি কোন ক্লাসে পড়?
কালাম কোন জবাব দিল না। মাথা নিচু করে সোফার হাতল খুঁটতে লাগলো। তিতলির বেশ রাগ হলো দেখে। বললো -
- এই তুমি ওরকম সোফার হাতল খুঁটছো কেন? ছিঁড়ে যাবে তো!
ছেলেটা ভয়ে ভয়ে হাত সরিয়ে নিল। তিতলি ভেবেছিল ওর কথা শুনবেনা ছেলেটা। যখন দেখলো একবার বলতেই শুনে ফেললো, ওর একটু মনটা খারাপই হলো এভাবে বকেছে বলে । সে কিছু না বলে চুপ করে রইল।
- কোথায় পড় বলবে না?
- কেলাস ফাইবে পড়ি।
- আচ্ছা খুব ভালো কথা। ঢাকা কেমন লাগছে তোমার?
- জে ভালো।
- আচ্ছা হুজুর। আপনারা বসেন । আমি আসছি। কিছু খেয়েছেন আপনারা?
- জি্ব বৌমা মাশাল্লা খুব বড় ঘরের মাইয়া। যত্ন কইরা খাওয়াইছে। আমি কোনদিন রেজালা খাই নাই। আইজকা খাইয়া বুঝতে পারছি এর এত নাম ডাক ক্যান।
খাসীর মাংসের রেজালা
খাইছি বইসা এক থালা
- আচ্ছা দেখি রাতের খাবারের কি বন্দোবস্ত হোল।
আব্বা উঠে এল। আব্বার পিছন পিছন তিতলিও। রান্নাঘরে মা খাবার সাজাচ্ছিল। দাদী সাহায্য করছিল মাকে। আর রেজা মামা বসে বসে গল্প করছিল। রণককে কিছুক্ষন আগেই ঘুম পাড়ানো হয়েছে।
তিতলি ঢুকতে ঢুকতে মামার হাসি শুনলো।
- আপা তোমার বাসা টা না একটা সরাইখানা।
- কি করবো বল। এভাবে কেউ চলে এলে তো আর না করতে পারি না।
-তুমি কোনদিনই না বলা শিখলে না। মনে আছে দুলাভাই মেজোভাইয়ের গায়ে হলুদের দিন কি হয়েছিল?
আব্বা মিটিমিটি হেসে বললো - মনে থাকবে না আবার! প্রথম প্রথম খুব বীরত্ব দেখিয়ে মানুষকে খাওয়াতে গেল। প্রথম ব্যাচেই সব খাবার শেষ। তখন বলে এবার তোমরা খাওয়াও। পরে চাইনিজ থেকে খাবার এনে মেহমান বিদায় দিতে হলো।
- এই তিতলি, যাতে হুজুরকে খেতে ডাক।
তিতলি ঘরে ঢুকে দেখে হুজুর খুব অবাক হয়ে টেলিভিশানের দিকে তাকিয়ে আছে।
- ওটা টেলিভিশান
- এইডাত ছবি দেহে?
- না। আল্লাহর দুনিয়াত কত কিছু দেখলাম। বড়ই তাজ্জব ব্যাপার।
- চলেন, খেতে চলেন । মা ডাকছে।
- একটু অজু করতে হইব।
- আসেন।
অজু করতে করতে হুজুর বললো -
- এইডার নাম মগ
এইডা দিয়া মুখ ধুইতে বড় ঢক।
তিতলি হেসে বললো
- ঢক মানে কি?
- ঢক মানে মজা
সন্দেশ আর গজা।
খেতে বসে কাবাব দেখে হুজুরের সে কি আহ্লাদ।
- খা কালাম। এইডা হইল নবাবী কাবাব। বাপের জন্মেও দেখস নাই।... আম্মা আল্লাহ আপনার ভালো করবে, আমি এত তৃপ্তি নিয়া কোনদিন খাই নাই।
মা শুধু একটু হাসলো আর খুব যত্ন করে হুজুরকে খাওয়ালো।
প্রকাশ: পরবাস
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০