- আরে মামা! তুমি না কাল আসবে?
- আজই চলে এলাম। আমার তিতলি ভুতটাকে দেখতে ইচ্ছা হলো ।
মামা থাকে রাজশাহী। ওখানের ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করছে। ছুটি হলেই চলে আসে।
তিতলীর খুশীতে নাচতে ইচ্ছা হচ্ছিল। মায়ের উপর কিছুক্ষণ আগের অভিমান কোথায় যে উড়ে চলে গেল। মামা এলেই বাসায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। মা মজার মজার রান্না করে। আর আব্বাও হাসিখুশী মুখে ঘুরে বেড়ায়। তিতলি আর রণকের তো মজাই আলাদা। কত জায়গায় যে বেড়ানো হয়।
আব্বা এখনো আসেনি। মামার সাথে কথা আর ফুরায়ই না তিতলির। বিকাল হয়ে গেল। হঠাৎ দরজায় কে যেন কড়া নাড়লো। ভিখিরিরাতো এই সময় আসে না সাধারণত। ঘরে ফিরে যায় নিশ্চয়ই। তাহলে কে হতে পারে?
দরজা খুলে দেয় তিতলি। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বুড়ো হয়ে যাওয়া একজন মানুষ। শরীরটা নুয়ে পড়েছে প্রায়। পরনে লুঙ্গি এবং পাঞ্জাবী। পুরানো হলেও পরিস্কার। মুখের চামড়ায় অনেক ভাঁজ পড়েছে। একটু খানি হাসি মেখে আছে ঠোঁটের প্রান্তে। ভালো করে দেখলে বোঝা যায় বৃদ্ধ বেশ বিব্রত।
তিতলি অবশ্য এইসব কিছু খেয়াল করছিল না। তার দৃষ্টি ছিল বুড়োর পেছনে লুকানো প্রায় দশ এগারো বছর বয়সের ছেলেটার দিকে। প্রথমে দেখেই ছেলেটাকে ভালো লাগলো না তার। কেমন যেন একটা পাজী পাজী চেহারা। আর মনে হয় অনেকদিন ধরে গোসল করেনি। যে বিশ্রী গন্ধটা তিতলির নাকে লাগছে তা এই ছেলের গায়ের গন্ধও হতে পারে। বুড়োর হাতে একটা চটের ব্যাগ। মনে হয় কাপড় চোপড় রাখা আছে। সে তিতলিকে দেখে বললো -
- এইডা আমার নাতি
হাতে নাই ছাতি
- বাঃ! আপনি সবসময় এইরকম করে কথা বলেন?
বৃদ্ধ কিছু না বলে মিটিমিটি হাসলো।
- আপনি কে?
- আমার নাম জনাব মুনসী আবদুর রব। তুমি রাজীবের মাইয়া?
- জি্ব। আমার আব্বার নাম রাজীব আহমেদ।
- তোমার বাপে কই?
- আব্বা তো বাসায় নাই। অফিসে গেছে।
- আইচ্ছা...আর কেউ নাই বাসাত?
তিতলি কিছু বলার আগেই মা এসে দাঁড়াল।
- আসসালামুআলাইকুম। আপনি আমারে চিনবেন না। আমি মতলব মাদ্রাসায় পড়াই।
- ও আচ্ছা। স্লামালাইকুম। ভিতরে আসেন। সাথে কে?
- এর নাম আবদুল কালাম, আমার নাতি। এর লাইগাই আইলাম। পেডের মধ্যে বলে পাথর হইছে। কাইট্টা বাইর করন লাগতো।
- আচ্ছা। আসো কালাম।
মা নিয়ে তাদের বসার ঘরে বসালো। মাকে বেশ চিন্তিত মনে হলো। দাদী বারান্দার জানলা দিয়ে বসার ঘরে একটু উঁকি দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে মাকে বললো
- এইডা তো পাগলা হুজুর। কলিজা ভাজা ভাজা কইরা ছাইরা দিবো। থাকার লাইগ্যা আইছে মনে হয়। লগে নাতিরে আনছে।
- হুম। কোথায় থাকতে দেই তাই ভাবছি। পার্টিশান ঘরে তো রেজা ঘুমাবে। বসার ঘর ছাড়া তো জায়গা নাই।
- আরে থাকতে দেয়া লাগতো না। রাজীব বাসাত আইলে আপদ বিদায় করো।
- আজ রাতটা তো অন্তত থাকতে দিতে হবে। আপনার ছেলে আসতে আসতে তো রাত হবে অনেক। এত রাত করে কোথায় যাবেন বুড়ো মানুষ? আর দেখেও কেমন মায়া হচ্ছে আমার। আম্মা আপনি বরং বসার ঘরে গিয়ে কথাবার্তা বলেন উনার সাথে
- আইচ্ছা।
তিতলি গিয়ে দেখে কালাম সিটিং রুমের সোফার ওপরে জুতাসহ পা তুলে দিয়ে বসে আছে। এটা মায়ের খুব শখের সোফাসেট। তিতলি আর রণককেই বসতে দিতে চায় না । অনেকদিন জল্পনা কল্পনার পর টাকা জমিয়ে জমিয়ে কেনা হয়েছে এটা। এর আগে বসার ঘরে ছিল নাইলনের চেয়ার।
তিতলির খুব রাগ হলো ছেলেটাকে ওভাবে দেখে।
- এই তুমি অমন পা তুলে সোফায় বসেছ কেন?
ছেলেটা না শোনার ভান করে এক কাত হয়ে শুয়ে পড়লো।
আরে আজব তো! দাদীকে দেখেও একটু বিরক্ত মনে হচ্ছে। এমনিতে কুমিল্লা থেকে লোক এলে দাদী খুশীতে আত্মহারা হয়ে যায়। কোনটা রেখে কোনটা করবে ভেবেই পায় না। এনার বেলায় এমন করছে কেন কে বলবে।
পাগলা হুজুর তিতলিকে কাছে ডাকলো। তিতলি পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতেই বললো -
- তুমি হইলা তিতলি রানী
আমার লাইগ্যা আন পানি
- পানি খাবেন?
- হ। ফিরিজের ঠান্ডা পানি খাইতে মন চায়।
আচ্ছা এনে দিচ্ছি।
তিতলি পানি এনে দিল । হুজুর পানি না খেয়ে তিতলি কে বললো - বামহাতে গুরুজনদেরকে কিছু দিতে হয় না। নেও ডাইন হাত দিয়া দেও।
বেশ বিরক্তই হল তিতলি । এহ ঢং কত! পানি এনে দিয়েছে। আবার ডান হাত দিয়েও দিতে হবে। কিন্তু কিছু বললো না ও।
কলিং বেল বেজে উঠলো। রণক এলো নিশ্চয়ই। মায়ের বকাবকিতে বুঝতে পারলো রণকই এসেছে। সে তার দৈনন্দিন অভ্যাস মত আজও নিশ্চয়ই মায়ের অাঁচলে ঘাম মুছে দিয়েছে ।
সাধারণত রণক খেলার মাঠ থেকে ফেরার পর গোসল না করা পর্যন্ত তিতলি তাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু আজকের ব্যাপার আলাদা। সে তাড়াতাড়ি রণকের কাছে গেল পাগলা হুজুরের গল্প করতে।
(চলবে)
প্রকাশ: পরবাস
ছবি: সাহিদুর রহমান