মুখাবয়বে তাচ্ছিল্য, তীর্যক হাসি ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ, কটূক্তিপূর্ণ ও মুখরোচক মন্তব্য নিয়ে ঘরে-বাইরে সমালোচিত ও আলোচিত রাজনীতিক সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
Published : 01 Oct 2013, 03:43 PM
যুদ্ধাপরাধের মামলার শুনানিতে আদালতে দাঁড়িয়েও বিভিন্ন সময় ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেন ছয়বারের এই সংসদ সদস্য, যা ট্রাইব্যুনাল ও উচ্চ আদালতের রায়েও উঠে আসে।
মুসলিম লীগ নেতা একেএম ফজলুল কাদেরের ছেলে সালাউদ্দিন সারা দেশে সাকা চৌধুরী নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে কয়েকটি দল ঘুরে সর্বশেষ তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য।
তবে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করে দলের ভেতরেই সমালোচিত হন তিনি।
তারেকের কর্মকাণ্ডে খালেদার নীরব সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে সাকা বলেন, “আগে কুকুর লেজ নাড়াত, এখন লেজ কুকুরকে নাড়ায়।”
আবার বিএনপি চেয়ারপারসনকে নিয়ে ‘তালাকপ্রাপ্ত বউয়ের ঘর করি না আমি’- মন্তব্য করেও দলে ক্ষোভের মুখে পড়েন সাকা চৌধুরী।
তার অশালীন ও আপত্তিকর মন্তব্যের শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও।
২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলায় নিজের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ নাকচ করে ওই সময়ের সরকারি দল বিএনপির এই নেতা বলেন, “আমি গ্রেনেড মারলে সেটাতো মিস হত না।”
শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা দাবি করে এই বিএনপি নেতা বলেন, “ছাত্রজীবনে শেখ মুজিব আমার বাবার শিষ্য ছিলেন।”
আওয়ামী লীগের একটি মহল ‘হাসিনার বিরুদ্ধে তাকে উসকে দিচ্ছে’ অভিযোগ করে সালাউদ্দির কাদের বলেন, “ওই মহলটি জানে না যে তারা যে বিলের মাছ, আমি সালাউদ্দিন ওই বিলের বক।”
গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ওআইসিএর মহাসচিব পদে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রার্থী করা হয়। এর সমালোচনা করেন আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
জবাবে সাকা বলেন, “বাবু ওআইসি নিয়ে কথা বলার কে? উনাকে ওআইসি নিয়ে কথা বলতে হলে, আমি ছোট বেলায় যে জিনিসটা কেটে ফেলে দিয়েছি, আগে ওই জিনিসটা কেটে ফেলতে হবে। তারপর বাবুকে ওআইসি নিয়ে কথা বলতে বলেন।”
নারী নির্যাতন বিষয়ে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের একটি বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সাকা চৌধুরী বলেন, “তিনি কেরানীগঞ্জের একজন প্রমোদ বালক- এটা কি আমি কখনও বলেছি?”
নবম সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা ‘নেই’ উল্লেখ করেন সাকা চৌধুরী। অসত্য তথ্য দেওয়ায় নির্বাচনী আইন অনুযায়ী তার সংসদ সদস্য পদ খারিজের উদ্যোগ নেয় বিগত নির্বাচন কমিশন। সে সময় নির্বাচন কমিশনকে ‘গমচোর’ বলে আখ্যা দেন তিনি।
তার আসনটি শূন্য ঘোষণার জন্য স্পিকারকে অনুরোধ জানালেও আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে তা আর এগোয়নি।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলাকালেও নানা তীর্যক মন্তব্য করেন সালাউদ্দিন কাদের।
২০১৩ সালের ১৭ জুন থেকে নিজের প্রথম সাফাই সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করেন বিএনপির এই নেতা; আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “আমার না হলে, ফাঁসি কারো হবে না।”
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে সাফাই সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণের আদেশ দেওয়ার পর ওই বছরের ১৩ জুন সালাউদ্দিন কাদের বলেন, “কলকাতার জেলে পাঠাবেন না।”
৩০ জুন নিজের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্যে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষক হলে আমিও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক।”
হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের আটটি ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার দায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।
চলতি বছর ২৯ জুলাই আপিলের রায়ে চার অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলেও রাউজানের সতীশ চন্দ্র পালিতকে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর অভিযোগ থেকে তিনি খালাস পান, যাতে তাকে ২০ বছরের সাজা দেয় ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালে বিচার চলাকালীন সময়েও নানা ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করেন তিনি, আদালতে করা একটি মন্তব্যের জন্য স্ত্রীর ধমকও খান সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে সাকা বলার যৌক্তিকতা তুলে ধরে ২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রসিকিউটর জেয়াদ-আল-মালুম ট্রাইব্যুনালকে বলেন, “সাকা আমাকে হালুম বলেন।”
ওই বছর ১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়ে বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর বলেন, সালাউদ্দিন কাদের ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু বিচার চলাকালে আদালতের প্রতি তার আচরণ ছিল অসম্মানজনক।
তবে এ বিষয়টি রায়ে প্রভাব ফেলেনি বলে উল্লেখ করেন বিচারক।
ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার সময়ও রায়ের নানা প্রসঙ্গে পাল্টা কথা বলে আসছিলেন তিনি। ব্যঙ্গও করছিলেন মাঝে মাঝে।
রায়ের এক পর্যায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিচারককে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তোমার বোনকে বিয়ে করার কথা ছিল, সেটা বল না?”
এ সময় এই দাপুটে বিএনপি নেতাকে ধমক দিয়ে স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী বলেন, ‘হেই..... কী বলছো তুমি এ সব?’
বিচারক তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনানোর সময় সাকা বলতে থাকেন, ‘বল বল কীভাবে কি করছি……বল….তোর বোনকে কি করছি বল….
‘……হু ধানের কল চুরি করছি ঘরে ঢুকছি তারপর কি করছি বল…….’
‘………লাল মিয়া, সোনা মিয়া…বল….পাঁচ কেটে ছয় করার দরকার কি…মিয়া তো ঠিকই আছে……’
আদালতে করা সাকার অন্য অধিকাংশ মন্তব্য তার স্ত্রী-স্বজনদের হাসির খোরাক যুগিয়েছে। অবশ্য সাকা আরো বেশ কিছু অশ্লীল মন্তব্য করেন। সে সময় প্রতিক্রিয়াহীন দেখা যায় তার স্ত্রী-সন্তানদের।
গ্রেপ্তার হওয়ার আগে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ নানা বক্তব্য দেন সাকা চৌধুরী, আপিল বিভাগে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকার পর যা ব্যাপকভাবে ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়া ফুটেজে স্বভাবসুলভ উদ্ধত ভঙ্গিতে সালাউদ্দিন কাদেরকে বলতে শোনা যায়, “সাক্ষীর অভাব আল্লাহর মেহেরবানিতে মঈনুদ্দিন আমলেও হয়নি। এই সরকার, কী যুদ্ধ অপরাধ কী, ট্রাইব্যুনাল ওনাদেরও অভাব হবে না। আগামী দিনেও ইনশাল্লাহ সাক্ষীর অভাব হবে না।”
ভিডিওটির একটি অংশে তাকে বলতে শোনা যায়, “গ্রেফতার! আমারে খাসি চুরি, গরু চুরি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছিল, ২০ মাস ২ কম্বলে শোয়াইছে মঈনুদ্দিন আমলে।
“আর প্রমাণের কথা বলছেন, তাহলে বলি… আশা করি মনে কষ্ট পাবেন না কেউ। সাক্ষী দিয়েছেন, আমার প্রধানমন্ত্রী, আমার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সাক্ষী দিয়েছেন কারা কারা … শেখ সেলিম, আব্দুল জলিল।”
একাত্তরে চট্টগ্রামের ত্রাস হিসেবে পরিচিত সালাউদ্দিনের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। একইদিন রায়ের অনুলিপিও প্রকাশিত হয়। এরপর নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারির পর ১ অক্টোবর তা আসামিকে পড়ে শোনায় কারা কর্তৃপক্ষ।
এরপর এই যুদ্ধাপরাধী রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল বিভাগে আবেদন করেন। শুনানি শেষে বুধবার আদালত তা খারিজ করে দেয়।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারকের আপিল বেঞ্চের দেওয়া রায়ে বলা হয়, আপিল শুনানির পর দেওয়া রায়ে কোনো ত্রুটি বিচারকদের নজরে আসেনি। সুতরাং দণ্ড পুনর্বিবেচনার কোনো কারণও তারা খুঁজে পাননি।
দণ্ড কার্যকরের আগে দুই যুদ্ধাপরাধীর শেষ আইনি সুযোগ ছিল রিভিউ আবেদন। তা খারিজের মধ্য দিয়ে আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়।
প্রাণ রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে ভুল স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চান সাকা চৌধুরী। কিন্তু রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সেই আবেদনে সাড়া না দেওয়ায় রোববার প্রথম প্রহরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।